নবনীতা দত্তগুপ্ত, কলকাতাঃ
পরীর দেশে পাড়ি দিলেন সাতের দশকের রাতপরী মিস শেফালি। কলকাতায় আসার আগে তাঁকে সবাই আরতি বলেই চিনত। নাম আরতি দাস। জন্ম বাংলাদেশে।
দেশভাগের পর বারো বছর বয়সে চলে আসেন কলকাতায়৷ চরম আর্থিক কষ্টে তখন কাটছিল জীবন। ছোট থেকেই ভাল নাচতেন আরতি। মাত্র ১৩ বছর বয়সে ফিরপো হোটেলে লিডো রুমে নাচ শুরু করেন রুটিরুজির জন্য৷ ফিরপোর দুই সাহেব সুবেদার ভ্যালে আর ডেভিড তাঁকে ডাকতেন ‘লিটল ফ্লাওয়ার’। তবে, ওখানকার কর্তারা তাঁর নাম দেন মিস শেফালি।
সেদিন থেকেই আরতি নাম ঘুচে গেল তাঁর। তবে আত্মীয় পরিজনেরা তাঁকে ডাকতেন আরতি নামেই। ধীরে ধীরে নাম ছড়ায় মিস শেফালির। সেই সুবাদেই জনপ্রিয় অভিনেতা তরুণ কুমারের সঙ্গে আলাপ হয় শেফালির। তরুণকুমার তাঁকে নিয়ে যান বিশ্বরূপায়৷ রাসবিহারী সরকারের পরিচালনায় ‘চৌরঙ্গী’তে অভিনয় করেন তিনি। এরপর ‘সম্রাট ও সুন্দরী’তে অভিনয় করেন।
আরও পড়ুনঃ প্রয়াত সাতের দশকের রাতপরী ‘মিস শেফালি’
পরিচালক শেখর চট্টোপাধ্যায়ের পরিচালনায় ‘সাহেব বিবি গোলাম’-এ বাইজি চুণীদাসীর চরিত্রে অভিনয় করেন মিস শেফালি। সেই নাটকে নায়িকার ভূমিকায় ছিলেন সুপ্রিয়া চৌধুরী। শেফালির ডাক আসে সত্যজিৎ রায়ের কাছ থেকেও।
সত্যজিৎ রায় পরিচালিত ছবি ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ এবং ‘সীমাবদ্ধ’তে অভিনয় করেন তিনি। ‘সীমাবদ্ধ’ -তে নাচ করেন শেফালি৷ শুটিং হয়েছিল ফিরপো হোটেলের লিডো রুমে। সেখানকার সব ব্যবস্থা শেফালিই করে দেন। খুব বেশিদিন ফিরপো-তে নাচেননি তিনি। একদিন উঠেই যায় ফিরপো।
আরও পড়ুনঃ ইসলামপুরে নাবালিকা ধর্ষণে দোষীর সাত বছরের কারাদণ্ড ঘোষণা
শেফালি চলে আসেন গ্র্যান্ড হোটেলে। মহানায়ক থেকে মহানায়িকা এমনকী সত্যজিৎ রায়- কে না ফ্যান ছিলেন শেফালির? মহানায়ক তো তাঁর বেলি ডান্স এবং হুলা মুভসে একপ্রকার বশীভূত হতেন। মহানায়িকার সঙ্গেও মিস শেফালির বন্ধুত্ব ছিল গাঢ়। ওঁদের আলাপও হয় বেশ নাটকীয় কায়দায়।
একদিন এক পার্লারে মিস শেফালি নিজের পরিচর্যা করাচ্ছেন। এমন সময় কেউ একজন তাঁর পিঠের উপর একটা চড় কষায়। শেফালি সব ফেলে ছোটেন তাঁর পিছনে। এরপর যখন তাঁকে ধরে ফেলেন তখন ‘হাঁ’ হয়ে যান তিনি মানুষটিকে দেখে।
আরও পড়ুনঃ কোচবিহার সাগরদিঘী চত্বরের ফাস্টফুডের দোকানিদের রেজিস্ট্রেশন নাম্বার সহ ডাস্টবিন প্রদান
তিনি সুচিত্রা সেন। মারার কারণ জানতে চাইলে সুচিত্রা সেন বলেন, শেফালি তোয়ালের উল্টোদিক দিয়ে মুখ মুছছিলেন। এতে ত্বকের ক্ষতি হয়৷ সেই শুরু বন্ধুত্বের। এরপর কত আড্ডা কত ডেটিং করেছেন দুজনে তার ইয়ত্বা নেই।
ওয়েব প্ল্যাটফর্মে তাঁর বায়োপিক বানাতে উদ্যোগী হয়েছেন কঙ্কনা সেনশর্মা। অঙ্কের অধ্যাপক তথা পরিচালক তাঁকে নিয়ে বানিয়েছেন ‘ভোরের কুয়াশা’।
আরও পড়ুনঃ বেতন কাঠামো ঘোষণার দাবিতে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি গ্রামীণ সম্পদকারীদের
বিয়ে করেননি। সারাটা জীবন নাচের জন্য উজাড় করে দিয়েছেন মিস শেফালি। ভাইয়ের ছেলেকে নিজের ছেলের মতো মানুষ করেছেন। বাড়ির কাজের মেয়েটিকে ভালোবাসতেন নিজের বোনের মতো। এই ছিল শেফালির সংসার।
আরও পড়ুনঃ সিউড়িতে আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার, ধৃত প্রাথমিক শিক্ষক সহ ৩
এরপর একদিন লাইমলাইট থেকে হারিয়ে যান তিনি। দিনের পর দিন কাজ না পাওয়ার যন্ত্রণায় মানসিক রোগে ভুগছিলেন। শারীরিক কষ্ট থাবা বসিয়েছিল জোড়ালো। কিডনির সমস্যায় ভুগছিলেন দীর্ঘদিন। চিকিৎসার জন্য যথেষ্ট টাকাও ছিল না। ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত একাধিকবার তাঁর দিকে বাড়িয়ে দিয়েছিলেন সাহায্যের হাত৷ কিন্তু কদিন? জীবনশিখা যে কখনও মাথা নোয়ায় না অর্থের কাছে।
তার যখন থামার সে থেমে যাবেই। আজ সকাল ৬টা নাগাদ নিজের সোদপুরের বাড়িতেই নিভে যায় সাতের দশকের রাতপরীর জীবনশিখা। বয়স হয়েছিল ৭৬ বছর। টলিউডে আজ বিষাদের সুর গুনগুন করছে।
একসময় সন্ধে নামলেই কলকাতার রাস্তায় ফিসফিস করে শোনা যেত মিস শেফালির নাম। আজ কলকাতাবাসীর মুখে একটাই কথা- আর নেই মিস শেফালি।
WhatsApp এ নিউজ পেতে জয়েন করুন আমাদের WhatsApp গ্রুপে
আপনার মতামত বা নিউজ পাঠান এই নম্বরে : +91 94745 60584