মোহনা বিশ্বাস
শবরদের সেকাল-একাল
“ধনধান্য পুষ্পভরা আমাদের এই বসুন্ধরা। তাহার মাঝে আছে দেশ এক সকল দেশের সেরা। ও সে স্বপ্ন দিয়ে তৈরি সে দেশ স্মৃতি দিয়ে ঘেরা। এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি। ও সে সকল দেশের রাণী সে যে আমার জন্মভূমি।”
দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের এই কবিতাটার সঙ্গে আমাদের দেশের একটু বেশিই মিল পাওয়া যায়। বৈচিত্রের দিক থেকে সমস্ত পৃথিবীতে ভারতবর্ষের জনবসতির জুড়ি মেলা ভার। এখানে যে কত ধর্ম আর বর্ণের মানুষ আছে তার কোনো হিসাব নেই। এখানে অগণিত জনগোষ্ঠীর বাস।
সব মিলেমিশে এক হয়ে গেছে এই দেশে। এখানে সকলের ঠাঁই হয়। তাহলেই বলুন এই দেশের থেকে সেরা আর কোনো দেশ কী আছে পৃথিবীতে? নাহ্, নেই। আর সেজন্যই অন্য জনগোষ্ঠীগুলির মতো শবরদেরও অস্তিত্ব আছে এদেশে।
‘শবর’ নামটি খুব বেশি মানুষের কাছে পরিচিত নয়। শবর কোনো একজনের নাম নয়, এটি একটি জনগোষ্ঠীর নাম। বর্তমানে ভারতে এই শবর জনগোষ্ঠী একটি অন্যতম সমস্যা হিসেবে প্রভূত হয়েছে, অবশ্য তাতে শবরদের কোনো হাত নেই।
জগতের নিয়ম সম্ভবত এমন যে, সংখ্যাগরিষ্ঠরা দিনে দিনে আরও বড় হয়, আর সংখ্যালঘুরা দিনকে দিন পড়ে পড়ে মার খায়। শবররা আর দশটা অধিবাসীর মতোই ভারতের অধিবাসী। কিন্তু তাদের ঘিরে রয়েছে অগণিত বিতর্ক। কিন্তু কেন? শবররা আসলে কারা? কী করে এরা?
শবর কথাটির উৎপত্তি হয়েছে ‘সগর’ থেকে। স্কাইথিয়ান ভাষায় ‘সগর’ শব্দের অর্থ হলো কুঠার। অতএব, বোঝাই যাচ্ছে, শবররা কুঠার হাতে বনে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতেন। সেখান থেকেই শবর নামটির প্রচলন হয়। শবররা বাস করেন পশ্চিমবঙ্গ, চেন্নাই, মধ্যপ্রদেশ, ছোটনাগপুর আর উড়িষ্যায়।
বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া জেলার বরাবাজার থানা এলাকায় রয়েছে কয়েকঘর শবর। এবার এই শবরদের জীবনের নানান গল্প নিয়েই হাজির নিউজফ্রন্ট।
শবরদের অতীত যথেষ্ট গৌরবের। প্রাচীন মহাকাব্য মহাভারত, রামায়ণ, হর্ষচরিত, চর্যাপদ আর পুরাণে শবরদের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সাহিত্য কিংবা লোকগাঁথা ছাড়াও ধর্মচর্চায়ও শবররা মর্যাদার দাবিদার।
বলা হয়ে থাকে, পুরীর জগন্নাথ নাকি এই শবরদেরই দেবতা। জগন্নাথের এই লীলাভূমি সকল সনাতন ধর্মাবলম্বীর পবিত্র স্থান। চর্যাপদে শবরদের সম্পর্কে লেখা আছে, “উঁচা উঁচা পাবতে তোঁহি বসতি শবরী বালি”।
ক্রুদ্ধ ইংরেজরা ১৯১৬ সালে শবরসহ বেশ কিছু জনগোষ্ঠীকে ‘অপরাধপ্রবণ আদিবাসী’ হিসেবে চিহ্নিত করে। সেই চিহ্ন তারা আজও বয়ে বেড়াচ্ছে। গাছ কাটা ও শিকার করাই শবরদের মূল কাজ ছিল।
তবে বর্তমানে এই দুটো কাজই আইনত অপরাধ বলে চিহ্নিত করা হয়। তাই বাধ্য হয়ে এই জীবিকা ছাড়তে হয়েছে শবরদের। এমতাবস্থায় কিছুটা অভাবে আবার কিছুটা স্বভাবের কারণে তাঁরা প্রায়শই অপরাধমূলক কাজ করে থাকে।
বর্তমানে পুরুলিয়ার বরাবাজার এলাকার শবরদের বেশিরভাগই একশো দিনের কাজে নিযুক্ত হয়েছে। বেশ কয়েকজন আবার হস্তশিল্পের কাজও করে। এদের শিক্ষাগত যোগ্যতা নেই বললেই চলে।
কয়েকবছর ধরে বরাবাজার থানার উদ্যোগে প্রথম শবরের সন্তানদের প্রাথমিক শিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। রাজ্য সরকারও এই শবরদের উন্নয়নে এগিয়ে এসেছে। শুধু তাই নয়, তিরন্দাজিতেও শবররা যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে।
আরও পড়ুনঃ বাঙালীর গর্বের সেতু
অন্য জাতির মানুষের থেকে যে তাঁরা কোনো অংশে কম নয় তা প্রমাণ করতে প্রতিমুহূর্তে লড়ে চলেছে শবররা। এই লড়াইয়ে তাঁদের পাশে দাঁড়িয়েছেন বরাবাজার থানার পুলিশকর্মীরা। এ বিষয়ে বিস্তারিত থাকবে নিউজ ফ্রন্টের এই নতুন সিরিজের পরের পর্বে।
WhatsApp এ নিউজ পেতে জয়েন করুন আমাদের WhatsApp গ্রুপে
আপনার মতামত বা নিউজ পাঠান এই নম্বরে : +91 94745 60584