রাজীবও চলে গেল!

0
75

মোশারফ হোসেন:

বিশেষ একটা বিষয়ে লেখায় ব্যস্ত থাকায় বিকেলের পর থেকে ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপ প্রভৃতির দিকে এক ঝলকও তাকানো হয়নি। হাতের কাজটা কিছুটা সামলে নিয়ে পৌনে দশটা নাগাদ মেল চেক করতে গিয়েই চমকে উঠলাম। কলকাতা প্রেস ক্লাবের পাঠানো মেল। সেই মেল-বার্তায় সাংবাদিক রাজীব ঘোষের প্রয়াণ সংবাদ! প্রথমে বিশ্বাস করতেই মন চাইছিল না। কিন্তু পরক্ষণেই ভাবলাম, প্রেস ক্লাব ভুল খবর দেবে কেন? বিশেষ করে বার্তাটা ক্লাব সভাপতি স্নেহাশিস সুরের সই করা। অনেক পুরনো কথা মনে পড়ে গেল।

Mosaraf Hossain

স্নেহাশিস, রাজীব, আমি এবং আরও একঝাঁক তরুণ-তরুণী ১৯৮৪ সালের নভেম্বরে একই দিনে বর্তমান পত্রিকায় যোগ দিয়েছিলাম। ট্রেনি জার্নালিস্ট পদে। বরুণ সেনগুপ্তের ‘বর্তমান’ তখনও প্রকাশিত হয়নি। প্রকাশের তোড়জোড় চলছে। নতুন একটা দৈনিক। নতুন যুদ্ধ। সেই যুদ্ধে কিংবদন্তী সাংবাদিক বরুণবাবুর নেতৃত্বে আমরা তরুণ তুর্কিরা একেকজন সৈনিক। মৌলালি জোড়া গির্জার উল্টোদিকে লালরঙের বাড়িটির ভিতরের সাজগোজ তখনও সম্পূর্ণ হয়নি। কাজ চলছে জোরকদমে। একতলায় ছাপার মেশিন বসছে, দোতলায় বিভিন্ন বিভাগের কর্মীদের বসার জায়গা তৈরি হচ্ছে। ফলে, আমাদের প্রশিক্ষণের জায়গা হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছিল পাশের অনুষ্ঠান বাড়িটিকে।

অবশ্য তারও মাসখানেক আগে আমাদের চাকরির লিখিত পরীক্ষাটি হয়েছিল হাজরা রোডে ন্যাশনাল হাই স্কুলে। বেশ কয়েকশো পরীক্ষার্থী। পরবর্তী ধাপে মৌখিক ইন্টারভিউ হয়েছিল ওই অনুষ্ঠানবাড়িতেই। আমরা বলতাম বিয়েবাড়ি। লিখিত ও মৌখিক ইন্টারভিউয়ে ঝাড়াই বাছাইয়ের পর প্রশিক্ষণপর্বটি চলে প্রায় একমাস। কাগজ বেরয় ৭ ডিসেম্বর। সেবছরই লোকসভা ভোট হয় ২৩ ডিসেম্বর। সেই ভোটেই যাদবপুরে সিপিএমের জাঁদরেল প্রার্থী সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়কে পরাজিত করে সংসদীয় রাজনীতির আকাশে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নামের একটি নতুন নক্ষত্র আত্মপ্রকাশ করেছিলেন।

যাইহোক, প্রশিক্ষণ পর্বেই আমাদের একদলকে রিপোর্টিং ও অন্যদের নিউজ ডেস্কের জন্য বেছে নেওয়া হল। নিউজ এডিটর আমাকে প্রথমে ডেস্কের তালিকায় রেখেছিলেন। কিন্তু আমি রাজি হইনি। আব্দারের সুরে বলেছিলাম, রিপোর্টিংয়ে না নিলে আমি কিন্তু চাকরিটা করব না। সম্ভবত স্নেহের জলেই চিঁড়ে ভিজেছিল। সেদিন থেকেই রাজীবরা আর আমরা যথাক্রমে ডেস্ক ও রিপোর্টিং- দুই আলাদা বিভাগের লোক বলে চিহ্নিত হয়ে গিয়েছিলাম।

আমাদের বস চিফ রিপোর্টার, ওদের নিউজ এডিটর। যদিও একই হলঘরে বসা, একই ক্যান্টিনে খাওয়া, একসঙ্গে হই-হুল্লোড় করাটা অব্যাহতই ছিল। ফলে দিনে দিনে বন্ধুত্ব বাড়ছিল। রাজীব অবশ্য খুব বেশিদিন বর্তমানে থাকেনি। সম্ভবত বছর পাঁচেক পর ‘আজকাল’ পত্রিকায় যোগ দিয়েছিল। দেবব্রত ঠাকুর, প্রচেত গুপ্তও। স্নেহাশিস চলে গেল দূরদর্শনের চাকরিতে। ফলে আমাদের অনেকটাই ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল।

মাঝে কমন বন্ধুদের দু-একজনের বিয়ে-বৌভাতে দেখা হলেও সেরকম নিয়মিত যোগাযোগ ছিল না। অনেকদিন বাদে ফের মুখোমুখি হলাম। এবছরের ফেব্রুয়ারির গোড়ায়। অশোক বসুর উদ্যোগে গত কয়েক বছর প্রেস ক্লাবে ‘প্রাক্তন বর্তমানী’দের বার্ষিক গেট টুগেদার হচ্ছে। আমি এবছরই প্রথম তাতে শামিল হয়েছিলাম। অলোকপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, দেবব্রত, পুলকেশ ঘোষ, স্নেহাশিস, প্রচেত, দেবাশিস দাশগুপ্ত, দীপঙ্কর দাশগুপ্ত, শুভজিৎ মজুমদার, সুদেষ্ণা বসু, কৃষ্ণশর্বরী দাশগুপ্ত, দেবযানী গাঙ্গুলি, রাই বড়ুয়া প্রমুখ সেই প্রথম যুগের একঝাঁক ‘বর্তমানী’। সঙ্গে ফটোগ্রাফার জয়ন্ত সাউ, সুব্রত দত্ত, অমিত দত্ত, গৌতম রায়, শুভম দত্ত প্রমুখও।

রাজীব এসেছিল সস্ত্রীক। বউ স্বর্ণালীকে সঙ্গে নিয়ে। গান গল্পে, পুরনো দিনের স্মৃতিচারণ, খুনসুঁটি, ছবি তোলা, খাওয়াদাওয়ায় জমজমাট আসর। আসর ভাঙার মুখে হন্তদন্ত হয়ে হাজির হয়েছিল জয়ন্ত ঘোষাল। অন্য একটা কাজে আটকে পড়ায় আমাদের আসরে যথাসময়ে হাজিরা দিতে পারেনি। দুটো রাজভোগ দিয়েই ওর ভোজনপর্ব সম্পন্ন হয়েছিল। রাজীবকে বরাবরই কথা কম বেশি কাজের মানুষ হিসেবে দেখেছিলাম। সেদিনও আমাদের অনেকের মতো ও অতটা প্রগলভ হয়নি। কিন্তু আড্ডায় সঙ্গ দিয়েছিলে একশো শতাংশ।

ওই মিলনানুষ্ঠানের কয়েক সপ্তাহ বাদে এক সন্ধ্যায় হঠাৎই রাজীবের ফোন পেলাম। আজকাল পত্রিকার যুগ্ম সম্পাদক রাজীব। সেদিনই অন্য একটি দৈনিকে আমার একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল। রাজনীতি বিষয়ে। সেটা উল্লেখ করে রাজীব বলল, শোন মোশারফ, আমাদের পত্রিকার জন্যও ওই বিষয়েই তোকে একটা পোস্ট এডিটরিয়াল লিখে দিতে হবে। আগামী পরশুর মধ্যে দিস কিন্তু!

বন্ধুর কথা ফেলিনি। নির্দিষ্ট দিনেই লেখাটা পাঠিয়েছিলাম। পরদিনের কাগজেই সম্পাদকীয় পৃষ্ঠায় গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশিত হয়েছিল। সকালেই রাজীবের প্রতিক্রিয়া পেলাম- সাবাস! আরও চাই কিন্তু! ওর অনুরোধেই আরও বেশ কয়েকটি লেখা লিখেছিলাম। প্রায় প্রতি সপ্তাহে একটি করে। প্রতিটি লেখাই গুরুত্ব সহকারে প্রকাশিত হয়েছিল। রাজনীতি ছাড়া অন্য বিষয়েও। বিধানসভা ভোটের অষ্টম পর্বের মুখে শেষ লেখাটা লিখেছিলাম।

২৯ এপ্রিল আমার বাবা আচমকাই অসুস্থ হয়ে পড়েন। ব্রেন স্ট্রোক। নির্বাক। অচৈতন্য। রাজীবকে মেসেজ করে জানালাম। বললাম, আপাতত তোদের জন্য আর লেখা দিতে পারছি না। দীর্ঘ আঠাশ দিনের লড়াইয়ের পর গত ২৬ মে বাবা চলে গেলেন। তারপরও অনেকগুলো দিন কেটে গেল। বাবার অসুস্থতা ও মৃত্যুর ঘটনাটি আমার কাছে একেবারেই অপ্রত্যাশিত ছিল। ফলে সব যেন অগোছালো হয়ে গেল। নিজেকে এখনও পুরোপুরি স্বাভাবিক করে তুলতে পারিনি। কারও সম্পর্কেই তেমন খোঁজখবর নেওয়া হয়নি। এরই মধ্যে রাজীব কবে অসুস্থ হয়েছিল জানতে পারিনি। আজ যখন জানলাম, তার ক’ঘণ্টা আগেই সে চিরকালের জন্য বিদায় নিয়েছে। প্রথম কর্মক্ষেত্রের বন্ধুত্ব অনেকটা স্কুলের বন্ধুত্বের মতো। ভোলা কঠিন। রাজীবকেও ভুলতে পারব না। রাজীব যেখানেই থাক, ভালো থাক। ওর স্ত্রী ও পরিবারের অন্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাই।

নিউজফ্রন্ট এর ফেসবুক পেজে লাইক দিতে এখানে ক্লিক করুন
WhatsApp এ নিউজ পেতে জয়েন করুন আমাদের WhatsApp গ্রুপে
আপনার মতামত বা নিউজ পাঠান এই নম্বরে : +91 94745 60584

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here