ফেসবুকে দেখে সুদুর জামবনীতে ত্রাণ পৌঁছে দিল মেদিনীপুর কুইজ কেন্দ্র

0
66

নিজস্ব সংবাদদাতা, পশ্চিম মেদিনীপুরঃ

সংকটকালে একমাত্র সোশ্যাল মাধ্যম ফেসবুকও সাহায্যর মাধ্যম হচ্ছে ত্রাণকার্যে। আর এই ভাবে ত্রাণ সামগ্রী পেয়ে কিছুটা হলেও হাসি ফুটল বাদল-অমল-বনমালী-লক্ষ্মী-মালতীদের মনে। দিন দুয়েক আগে মোবাইল ফোনে ফেসবুকের পৃষ্ঠা স্ক্রল করতে করতে হঠাৎ কয়েকটা ছবি আসে স্ক্রিনে। সেটা চোখ আটকে যায় শিক্ষক অরিন্দম দাসের। ছবিতে দুর্দশা গ্রস্ত কিছু মানুষকে দেখে ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ে অরিন্দম বাবুর মন।

help | newsfront.co
প্রত্যন্ত গ্রামে দুঃস্থদের ত্রাণ দান। নিজস্ব চিত্র

এমনকি ছবির সাথে লেখাগুলো পড়ে তিনি বুঝে যান জায়গাটা তাঁর পুরানো কর্মস্থল, তথা জঙ্গল মহলের ঝাড়গ্রাম জেলার জামবনী ব্লকের প্রত্যন্ত একটি এলাকা। যিনি ফেসবুকে এই ছবি শেয়ার করে সাহায্যের আবেদন রেখেছিলেন, সেই রাহুল সমাদ্দার অরিন্দম বাবুর পূর্ব পরিচিত।

food distribution | newsfront.co
খাদ্য সামগ্রী বিলি সংগঠনের। নিজস্ব চিত্র

রাহুল বাবু ওই ব্লকেরই চিল্কিগড় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যায়তনের পার্শ্ব শিক্ষক। এ বিষয়ে ওনার সাথে ফোনে কথা বলে অরিরন্দবাবু জানতে পারেন, পাশের লোধা-শবর অধ্যুষিত গ্রাম গুলির কিছু পরিবারের অবস্থা খুবই শোচনীয়।

আরও পড়ুনঃ চিকিৎসায় ভিন রাজ্যে আটকে পড়া দম্পতিকে আর্থিক সাহায্য পুলিশ সুপারের

গত বছর ছয়েক ধরে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন মেদিনীপুর কুইজ কেন্দ্র সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটির সাথে যুক্ত থেকে অরিন্দম বাবুরা নানান সামাজিক কাজ করে চলেছেন। তাই দেরি না করে তিনি যোগাযোগ করেন কুইজ কেন্দ্রের সম্পাদক সুজন বেরার সাথে। ওই সকল পরিবারগুলোর দুরবস্থার কথা শুনে সুজনবাবু কিছুক্ষনের মধ্যেই ওখানে পৌঁছানোর নির্দেশ দেন অরিন্দমবাবুকে।

পাশাপাশি সুজনবাবু এও বলেন, লকডাউনে ওদের দুরবস্থার কথা পৌঁছে দিতে হবে প্রশাসনের কাছে। কারণ তাঁরা হয়তো প্রাথমিক ভাবে কিছু খাদ্য সামগ্রী বা কিছু জামা কাপড় প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে পৌঁছে দিতে পারেন। কিন্ত তাতে ওদের কিছু দিন চললেও, সারা বছর চলবে না।

তাই সংগঠনের তরফে তাঁদের কাজ হবে প্রাথমিক ভাবে কিছু ত্রাণ পৌঁছে দেওয়ার পাশাপাশি প্রশাসনকে সঠিক বার্তা দেওয়া। যাতে ওদের আগামী জীবনটা বাঁচে। সেই মতো রাহুল বাবুর সাথে আবার যোগাযোগ করে খোঁজ নিয়ে অরিন্দম বাবু জানতে পারেন খাবারের অভাব তো রয়েইছে, এমন কি পরনে কাপড়েরও অভাব রয়েছে কয়েকটি লোধা পরিবারে।

আরও পড়ুনঃ লকডাউনকে উপেক্ষা করে কোথায় হচ্ছে ভিড়, ড্রোনের মাধ্যমে নজরদারি পুলিশের

তাই অরিন্দম বাবুরা ঠিক করেন আপাতত পাঁচটা পরিবারের জন্য রসদ পৌঁছে দিতে হবে। সেই মতো শুরু হয় প্রস্তুতি। পাড়ার এক দোকান থেকে আলু,পেঁয়াজ চিঁড়ে, মুড়ি ,ডাল ,গায়ে মাখা সাবান, কাপড় কাচা সাবান, সাবান গুঁড়ো, লবন,সরিষার তেল চিনি, বিস্কুট, হরলিক্স, সোয়াবিন এবং পাড়ার কাপড়ের দোকানদারকে অনুরোধে করে গোটা কয়েক লুঙ্গি, গেঞ্জী, গামছা, শাড়ি জোগাড় করে নেন অরিন্দম বাবু। পাশাপাশি কিনে নেন বেশ কিছু কাঁচা সবজিও।যদিও কুইজ কেন্দ্রের নির্দেশ ছিল লকডাউন যাতে কোন মতেই উপেক্ষিত না হয়।

তাই সংগঠনের নির্দেশে ছিল মাত্র দুজনকেই যেতে হবে ত্রাণ নিয়ে এবং প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে। সেই মত শনিবার সকালে অরিন্দমবাবু তাঁর এক প্রাক্তন ছাত্র পিকু যে বর্তমানে পেশায় পুলিশ কর্মী ,তাঁকে নিয়ে রওনা দেন জামবনীর পথে।

প্রাথমিক ভাবে সমস্যা না হলেও সমস্যা বাঁধে তাঁদের গাড়ি কংসাবতীর উপর ধেড়ুয়া ব্রীজ পেরিয়ে ঝড়গাম জেলায় ঢোকার মুখে। সেখানে পৌঁছে তারা জানতে পারেন কোন ভাবেই আন্তঃজেলায় যাতায়াত সম্ভব নয়। আগেরদিন রাতে এ নিয়ে বিশেষ অর্ডার এসেছে। অনেক অনুরোধের পর, বিষয়টির গুরুত্ব বুঝে প্রশাসনিক সহযোগিতায় বাইকে যাওয়ার অনুমোদন পান তাঁরা।

ধেড়ুয়া গ্রামের এক পরিচিতের বাইক নিয়ে, স্থানীয় এক সার ব্যবসায়ীর সাহায্যে মালপত্রগুলো দুটো বস্তায় প্যাকিং করে বাইকে করে রওনা দেন গুরু-শিষ্য। বাইকে দীর্ঘ প্রায় চল্লিশ কিমি পথ পেরিয়ে জামবনী পৌঁছে দেখেন এক গাছ তলায় তাঁদের জন্য অপেক্ষা করছেন রাহুল বাবু, অরিন্দম বাবুর আর এক প্রাক্তন ছাত্র স্বপন এবং আরেক যুবক রাজা।ওদের সঙ্গে করে অরিন্দমবাবুরা পৌঁছান দুবড়া পঞ্চায়েতের গোপালপুর গ্রামে।

সেখানে পুরো গ্রামেই লোধা শবরদের বাস। এই গ্রামেরই বাসিন্দা বাদল শবরের ছবি অরিন্দমবাবু ফেসবুকে দেখেছিলেন । বাদলবাবু ষাটোর্ধ বৃদ্ধ। হৃদ রোগের সমস্যায় চলন শক্তি এবং বাক-শক্তি দুইই প্রায় হারিয়েছেন। দেখারও কেউ নেই। বর্তমান পরিস্থিতিতে মৃত্যুর জন্য দিন গোনা ছাড়া আর কোন উপায় নেই তাঁর। এঁদের দেখে হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলেন বৃদ্ধ। উনাকে আশ্বস্ত করে কুইজ কেন্দ্রের তরফে ওনার পরনের নতুন কাপড় এবং খাদ্য সামগ্রী তুলে দেওয়া হয় ওই বৃদ্ধ দম্পতির হাতে।

এর পর তাঁরা যান অমল শবরের বাড়ি। খাবারের অভাবে প্রতিবন্ধী অমল বাবু একেবারে মাটির সঙ্গে এক হয়ে পড়ে রয়েছেন। ওনার স্ত্রীর ও কোন ক্রমে লজ্জা নিবারণের মত পোশাক পড়ে য়য়েছেন। উনাদের জন্য শাড়ি, লুঙ্গি এবং আগামী বেশ কিছুদিন চলে যাওয়ার মতো রসদ তুলে দেওয়া হয় কুইজ কেন্দ্রের তরফে।

তারপর কিছু দুরে লালবাঁধ অঞ্চলের অন্য এক গ্রাম খড়্গপুরে পৌঁছান ওরা। সেখানে বনমালী শবরের বাড়ি। বাড়ি মানে ডালপালা দিয়ে তৈরি একটা ঝুপড়ি মাত্র। যার মধ্যে একটা গরুও ঠিক ভাবে থাকতে পারে না, সেখানেই জীবন যাপন করেন বনমালী ও তাঁর স্ত্রী।

একটু ছেড়েই কিছুটা দূরে ছিটা বেড়ার ঘরের বাসিন্দা দুই শবর বিধবা লক্ষ্মী ও মালতীর হাতেও সাহায্য তুলে দেন অরিন্দম বাবু ও সহ তাঁর বন্ধুরা।এই পরিবারগুলোর কেউই ভিক্ষা করে খায় না। জীবন জীবিকা সবই জঙ্গল নির্ভর। জঙ্গল থেকে কাঠ সংগ্রহ করে পাশাপাশি গ্রাম বা বাজার এলাকায় বিক্রি করে বা পাতা সংগ্রহ করেই দিন চলে হয় এদের। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে কাঠ -পাতা কেনার লোক কোথায়। অপরদিকে এই লকডাউনের জেরে নিজের গ্রাম ছেড়ে যাওয়াও নিষেধ। আর তাতেই নেমে এসেছে চরম সংকট।

রেশনে অল্প হলেও চাল পান সব পরিবারই। কিন্তু শুধুই চাল, নুন টুকুও জোগাড় করা মুশকিল ওদের। পঞ্চায়েত সমিতির সদস্য তথা এলাকার বিশিষ্ট সমাজসেবী সমীর কুমার ধলও অরিন্দমবাবুদের সঙ্গে ছিলেন কিছু সময়। উনি আশ্বস্ত করেন বিভিন্ন সরকারি সাহায্য যত দ্রুত সম্ভব পৌঁছে দেবেন ওদের কাছে।

তবে অরিন্দম বাবুর মতে, বর্তমানে জাতীয় বিপর্যয় চলছে। এই লকডাউনের সময় সব কিছু দেখ ভালের দায়িত্ব সরকারের। আমরা মনে করি এই দায়িত্ব এই মহুর্তে কোনও সামাজিক সংগঠনের নয়। তাই অরিন্দমবাবুরা যোগাযোগ করেন স্থানীয় প্রশাসন, বিডিও ও চিকিৎসা পরিষেবার জন্য বি.এম.ও.এইচ এর সাথে। ওনারা প্রত্যেকেই বিষয়টি আন্তরিক ভাবে গ্রহণ করেন এবং দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহনের আশ্বাস দেন।

এর পাশাপাশি অরিন্দম বাবু এও বলেন,আমরা আশাবাদী। আমরাও নিশ্চয়ই সংঠনগত ভাবে বিষয়টি নজরে রাখবো। তবে সংগঠনের একমাত্র প্রতিনিধি হয়ে আমার ওখানে যাওয়া বা স্বচক্ষে দেখার অনুভূতি ঠিক লিখে বা বলে বোঝানো যাবে না। শেষমেষ ওদের পাশে থেকে কোথাও যেন কিছু একটা করতে পারার তৃপ্তি নিয়ে অবশেষে ছাত্র- শিক্ষক উভয়ই বাড়ির পথে পা বাড়ান।

তবে শাল-মহুয়ার বুক চিরে পিচ রাস্তা ধরে দ্রুত গতিতে এগোতে থাকে তাঁদের বাইক। অন্যদিকে কিছু দিনের বাঁচার রসদ পেয়ে কিছুটা হলেও আশায় বুক বাঁধেন বাদল-অমল-বলমালী-লক্ষ্মী-মালতীরা।

নিউজফ্রন্ট এর ফেসবুক পেজে লাইক দিতে এখানে ক্লিক করুন
WhatsApp এ নিউজ পেতে জয়েন করুন আমাদের WhatsApp গ্রুপে
আপনার মতামত বা নিউজ পাঠান এই নম্বরে : +91 94745 60584

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here