বিশেষ প্রতিবেদন, নিউজ ফ্রন্ট:ঘড়ির কাঁটা বারোটা ছাড়িয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে চলছে টিক টিক করে।ক্যালেণ্ডারে দিনটি পরিবর্তিত হয়ে ৩রা এপ্রিল হয়ে গেল।সারাদিনের অপেক্ষার ফোনটি এলো না।একবুক অভিমান চেপে খোলা ছাদে হাউমাউ করে কাঁদলাম।অন্ধকার আকাশের এককোনে মধ্যরাত্রের ডুবন্ত চাঁদ ঠিকানা হারানো এই মানুষটির কান্নার সাক্ষী হয়ে রইল।গত বছর আজকের দিনটিতে রেডিয়েশান রুমের সামনে দাঁড়িয়ে আছি হাত দেখিয়ে কাছে ডাকলো,কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো, শুভ জন্মদিন।ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখেছিলাম ঠিক সকাল সাড়ে নয়টা।ভেবেছিলাম দুরারোগ্য রোগযন্ত্রণায় হয়ত ভুলে গেছে।কিন্তু না সেদিন আমায় ভুল প্রমান করে দিয়ে মুচকি হাসি হেসেছিল।পৃথিবীর যেপ্রান্তে যেখানেই থাকি না কেন এই বিশেষ দিনটিতে সকাল সাড়ে নয়টায় এই কন্ঠ আমায় শুনিয়ে দিত,শুভ জন্মদিন।
১৯৮৪ সালের ২ এপ্রিল।সকাল সাড়ে নয়টায় তুমুল যন্ত্রণা সহ্য করে একটি কান্নার চিৎকার কাকে পুলকিত করেছিল জানি না কিন্তু এই মানুষটি যে মুচকি হেসেছিল তা আমি জানি।কারন সারা জীবন আঁকড়ে ধরে মৃত্যুর আগের মূহূর্ত পর্যন্ত সেই শিশুটিকেই খুঁজে ফিরেছে সেই চোখদুটি। পৃথিবীর সব ঝড় জল ঘৃণা প্রতিহিংসা থেকে আগলে রেখেছিল বিগত ৩৪ টি বছর ধরে।আমার সেই মাকে গত ১৮ ই মার্চ বিকেলে কবরে শুয়েই রেখে এসে বুঝেছিলাম কি নিঠুর এই পৃথিবী।আগলে রাখা কাকে বলে আজ প্রতি মূহূর্তে প্রতি পদে বুঝছি।আভিমান করে কত দিন বলেছি, আপনি শুধু ছোট ছেলেকেই ভালোবাসেন আমাকে একটুও ভালোবাসেন না। তখন শুধু বলতো,একদিন বুঝবি।আজ কতো রক্তচোখ আজ একসাথে গিলে খেতে আসছে।কতো অভিযোগের মুখোমুখি হয়ে উপলব্ধি করছি মাতৃহারার যন্ত্রণা।
১৭ মার্চ কলকাতায় আমি। ডাক্তারের খোঁজে।বহরমপুর নার্সিংহোম থেকে ফোন করে ভাই জানালো মা কথা বলছে।বুকের মাঝে যেন প্রান ফিরে এলো।এতোদিন মরে বেঁচে ছিলাম।সন্ধ্যায় ফিরতেই ভাই জানালো,গিয়ে দেখা করে আয়,তোকে খুঁজছে। মনে মনে ভাবছি এই তো বাড়ি নিয়ে যাবো তারপর আবার দুপুরের ফাঁকা বাড়িতে আমি আর মা আবার গল্প করবো।রাগ অভিমান মজা। হাসি মুখে ঢুকলাম ওয়ার্ডে।কাছে ডেকে জিজ্ঞেস করলো, এতোক্ষন কোথায় ছিলিস?জড়িয়ে যাচ্ছে কথা। বললাম। তারপর বললো সন্তুকে দেখিস(আমার ছোট ভাই)।হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লাম।বললাম তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে ওঠেন বাড়ি যেতে হবে।ব্যাণ্ডেজ দিয়ে বেঁধে রাখা হাতদুটো দেখিয়ে বললো খুলে দিতে বল।তখনো বুঝিনি মা সব বন্ধন ছিন্ন করে চাইছে নাফেরার দেশে চলে যেতে।সিস্টার আর এম ও ‘র সাথে কথা বলে বেরিয়ে এলাম।
সকাল ৯:১০ ফোন এলো নার্সিংহোম থেকে কনডিশান খারাপ তাড়াতাড়ি আসুন।এলাম।৯:২৫। সরি সি ইজ নো মোর অ্যাটলাস্ট কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট।কি ছোট্ট একটা শব্দ।ঘুমিয়ে আছে মা আমার।আস্তে আস্তে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম।চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে জল।মা যেন হাসছে।আমার দিকে তাকিয়ে।
সেদিন থেকেই জানি ২রা এপ্রিল সকাল সাড়ে নয়টার এই ফোনটা আর কোনদিন আসবে না কিন্তু তবু আগামী প্রতিটা বছর ওই ফোনাটার অপেক্ষায় থাকবো আমি।কারন আমি ভুল।মা ঠিক।আমার মা শুধু আমাদের দুই ভায়ের।জানি আমার জন্য অপেক্ষা করে আছে অনেক কালবৈশাখী।জানি ঝড়ো মেঘ জমছে চতুর্পাশে কিন্তু আবার এও জানি,মা আছে। আমার কাছেই আছে বলবে, দোস্তি তুই চুপ আমি দেখছি।নিশ্চুপ রাতের আকাশের তারা হয়ে মা বলবে ব্যাটা তুমি কান দিও না ওসব কথায়।চোখ মুছে দেখছি একটা তারা মিটি মিটি করে হাসছে আমার দিকে তাকিয়ে।সেই তারার দিকে তাকিয়ে শুধু বললাম, মা দেখছেন সন্তু কত্তো বড় হয়ে গেছে। আর আপনার চিন্তা নাই।কিন্তু মা গো আমি সেই আপনার গোঁয়ার অবুঝ বাটখারা হয়েই থাকলাম।
পোস্ট টি আবুল খায়ের এর ফেসবুক ওয়াল থেকে নেওয়া
WhatsApp এ নিউজ পেতে জয়েন করুন আমাদের WhatsApp গ্রুপে
আপনার মতামত বা নিউজ পাঠান এই নম্বরে : +91 94745 60584