সুদীপ পাল,বর্ধমানঃ
কাঁকর বিছানো লাল মোরামের রাস্তা দিয়ে সোজা চলে এলে যে গ্রামটির দেখা আপনি পাবেন তার নাম সাতকাহনিয়া। অধুনা পশ্চিম বর্ধমানের বনকাঠি গ্রাম পঞ্চায়েতের অধীন এই সাতকাহনিয়া গ্রামেই দীর্ঘদিন ধরে চলছে একটি আস্ত থিয়েটার ভিলেজ। গ্রামের মানুষদের হৃদয়ের অমূল্য রত্নটি ঘেরা হয়েছে। জায়গাটা ‘তেপান্তর’ নামে চেনে সবাই।
প্রশ্ন উঠবে থিয়েটার ভিলেজ মানে কি? যে গ্রামের বাসিন্দারা সবাই নাট্যকর্মী। গ্রামের বাসিন্দাদের বয়সের তারতম্যতা নাটকের কোন সমস্যা সৃষ্টি করে না বরং নাটকের চরিত্রায়নের সমৃদ্ধতা ঘটায়। প্রথম ১৯৯৬ সালে গ্রামেরই জনা ২০ ছেলেকে নিয়ে তৈরি হল নাটকের দল “এবং আমরা” । অধিকাংশই কৃষক পরিবারের সন্তান। গ্রাম্য লোককথা, জীবনের কথা, গ্রামের সমস্যা ইত্যাদি উঠে আসত নাটকের কথায়। একসময় নাট্যকর্মী প্রবীর গুহ ও বাদল সরকারের মতো নাট্যকর্মীরা অনুপ্রাণিত করেছেন এঁদের। ঠিক হয়েছিল গ্রামের পতিত জমিতে সব্জি চাষ, ফলের বাগান তৈরি, হাঁস-মুরগি পালনের মতো কাজ করবে এই ‘এবং আমরা’। তার আয়ের একটা অংশ দিয়ে দল চালানো হবে বাকি অংশটা তুলে দেওয়া হবে পরিবারগুলির হাতে। এভাবেই যাত্রা শুরু হয়েছিল সর্বক্ষণের নাট্য দলের।
জমির মালিকের থেকে অনুমতি নিয়ে ১৯৯৯ সালে গ্রামের প্রান্তে ১২ বিঘা বুনো গাছের জঙ্গলকে বেছে নেওয়া হয়েছিল। ২০০৪ সালে পুরো ক্যাম্পাসটির নিজেরা কিনে নাম দেওয়া হয় “তেপান্তর”। ২০০৫ সালে তেপান্তরে এসেছেন বার্লিন থেকে ফ্লাইং ফিশ থিয়েটার কোম্পানি, ২০০৮ সালে মস্কো থেকে রাশিয়ান অ্যাকাডেমি ফর থিয়েটার আর্টস। দিল্লির এনএসডি থেকে শুরু করে দেশ বিদেশের মঞ্চগুলিতে ক্রমশ পরিচিতি পাচ্ছে ‘তেপান্তর’।
‘তেপান্তর’-এর পিছনে প্রধান মস্তিষ্ক যিনি, তাঁর নাম কল্লোল ভট্টাচার্য। কল্লোলবাবু বুঝেছিলেন তাঁর নাট্যকর্মীরা কেউ কেউ বালি খাদানে, কেউ ইটভাটায় আবার কেউ পরের জমিতে দিন-মজুরি করে। ব্যাপক পরিশ্রমের পর নাট্যচর্চা করা অসম্ভব। তখনই এল নিজস্ব ফার্ম -এর ভাবনা। এরপর আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি কল্লোলবাবু সহ অন্য নাট্যকর্মীদের।
‘তেপান্তর’ গ্রামীণ লোক সাংস্কৃতিক পর্যটনকে ভিত্তি করে শুধু ইকো-ট্যুরিজম-এর আদর্শ জায়গা নয় অথবা শুধুই নাট্যগ্রাম নয়, এলাকার অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক উত্তরণের ভরকেন্দ্রও বটে। কেরলে ‘অভিনয় থিয়েটার’ বা ওড়িশার সুবোধ পট্টনায়কের তৈরি নাট্যগ্রামের মতই ‘তেপান্তর’এর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ছে।
অজয় নদের ধারে এই গ্রামটি জীবন যাপনের যে ধারার সন্ধান দেয় তা যে অত্যন্ত স্বতন্ত্র একথা বলার অপেক্ষা রাখে না।
WhatsApp এ নিউজ পেতে জয়েন করুন আমাদের WhatsApp গ্রুপে
আপনার মতামত বা নিউজ পাঠান এই নম্বরে : +91 94745 60584