নিজস্ব সংবাদদাতা,উত্তর ২৪ পরগনাঃ
বুধবার রাত তখন এগারোটা। ঘরের টালির ছাউনির উপর ভেঙে পড়ল গাছ। হুড়মুড়িয়ে পড়ে গেল ইটের দেওয়াল। পরিবারের সবাইকে নিয়ে ঝড়-বৃষ্টি মাথায় করে তারপরেই আশ্রয় নিয়েছেন পাড়ার স্কুলে। শনিবার দেগঙ্গার এক ত্রাণশিবিরে বসে সে কথাই বলছিলেন ৫৫ বছরের বৃদ্ধা লুৎফান বিবি। শিবিরে বেঞ্চি মুছতে মুছতে তিনি বলেন, “প্রাণ বাঁচাতে ঘর ছেড়ে বাইরে বেড়িয়েই দেখি, আকাশে লাল আগুনের কুণ্ডলি পাকানো গোলা এক পাশ থেকে অন্যপাশে গো-গো শব্দে ছুটছে। ভয়ঙ্কর সে দৃশ্য। আমি জীবনেও দেখিনি।”
এদিন দুপুর তখন ১টা। দেখা গেল, আহত এক শিশুকে কোলে নিয়ে দেগঙ্গার ত্রাণ শিবিরে ঢুকছে এক মা। শিবিরের মেঝেতে পলিথিন পেতে ছয় মাসের শিশুকে আগলে রয়েছেন আরেক মা। ঘুম ভেঙে শিশুটি কীসের ভয়ে কেঁদে কেঁদে উঠছে? শিশুটির মা সাবেরা বিবি জানান, ঝড়ের রাতে ঘরে দোলনায় ছেলে ঘুমোচ্ছিল। ঝড়ে একটি টালি ভেঙে তার মাথায় পড়ে।
সাবেরা বলেন, “ওই অবস্থায় ছেলেকে কোলে নিয়ে ঘর ছেড়ে ছুট লাগাই। চারদিকে অন্ধকার। রাস্তায় এক হাঁটু জল। কি ভাবে যে এই ত্রাণশিবিরে উঠেছি নিজেও জানি না।” ঝড় থেমে গেলেও এ দিনও দেখা গেল শেষ সম্বলটুকু বগলদাবা করে বাচ্চার হাত ধরে স্কুলে ঢুকছেন কেউ কেউ। এ দিন ওই স্কুলের ঘরে ঢুকে দেখা গেল, কেউ ক্লান্তিতে শুয়ে। পাশে ছোট বাচ্চা। কারও মুখে মাস্ক নেই ঠাসাঠাসি ভিড়ে লাটে উঠেছে দূরত্ব বিধি।
আরও পড়ুনঃ ঘূর্ণিঝড়ে বিপর্যস্ত রায়দিঘি, সুন্দরবন
শিবিরের বাইরে ‘পানীয় জল’ দিচ্ছে দেগঙ্গার চৌরাশি পঞ্চায়েত। এক হাঁটু জলে দাঁড়িয়ে সেখান থেকে বোতলে জল ভরছিলেন চম্পা মণ্ডল আর বছর দশেকের নূরুজ্জামান শেখ। কারও রমজান মাসে রোজার কথা মনে নেই, দু দিন বাদেই ইদ।
আকাশের দিকে তাকিয়ে বৃদ্ধা ফতেমা দোয়া করে চলেছেন, ‘আল্লাহপাক, আর শাস্তি দিয়ো না।” দেগঙ্গার আসিফ বলেন ” ইদের খুশি কি করে পালন করবো, যেভাবে ঘরবাড়ি সব ঝড়ে ভেঙে নিরাশ্রয় হয়ে পড়লাম”!
আমপানের প্রবল রোষে শুধু গাছপালা, বাড়ি-ঘর ভাঙচুরই নয়, ঝড়ের দোসর ছিল প্রবল বৃষ্টি। টানা সেই বৃষ্টিতে ভেসে গিয়েছিল বাড়ি ঘর। চাষের জমি। দেগঙ্গার বিভিন্ন রাস্তায় হাঁটু সমান জল, কোথাও জুতো হাতে জল পেরোতে হচ্ছে।
আরও পড়ুনঃ আমপান দুর্যোগ মোকাবিলায় নানা দাবিতে সিপিআইএমের প্রতিবাদ কর্মসূচি
ঝড়ের রাতে কোনওমতে পরিবার নিয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে রাত কাটিয়েছেন দিব্যেন্দু ঘোষ। কিন্তু এ দিন ভোরে তলায় দুটো ঠান-ইঁট পাতা চৌকিও যখন ছাপিয়ে গেল তখনই পরিবার নিয়ে শিবিরে আশ্রয় নিয়েছেন দিব্যেন্দু। তিনি বলেন, “নিরুপায় না হলে কেউ কি ভিটে ছাড়তে চায়?” যেমন ঘর আঁকড়ে পড়ে রয়েছেন বেড়াচাপার চিন্ময় চট্টোপাধ্যায়। বৃদ্ধা মা, স্ত্রী লক্ষী আর বছর সাতেকের ছোট্ট মেয়েকে নিয়ে সারা রাত খাটের উপর দাঁড়িয়ে কাটিয়েছেন চিন্ময়। সকালে তিনি বলেন, “খাট থেকে একটু জল নেমেছে। কিন্তু কোথায় রান্না করব, কোথায় কি করব কিছুই বুঝতে পারছি না।”
উত্তর ২৪ পরগনা জেলা শাসক চৈতালি চক্রবর্তী এ দিন বলেন “এই জেলার প্রায় ৫০ লক্ষ মানুষের ক্ষতি হয়েছে। প্রায় ৪৫ লক্ষ বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত, ক্ষতি হয়েছে চাষবাসের, এই দুর্যোগে ২১ জন মানুষের মৃত্যুও হয়েছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় ১৫৯৭ টি ত্রাণ শিবিরে প্রায় আড়াই লক্ষ মানুষকে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে।
ত্রাণশিবিরে আশ্রয় নেওয়া তাহমিনা বিবি,রিজিয়া বিবি ও জাহাঙ্গীর গাইনেরা বলেন, জানিনা কবে ঘরে ফিরতে পারবো। দেগঙ্গা বিডিও সুব্রত মল্লিক জানিয়েছেন, “ত্রাণশিবিরগুলোই আশ্রয় নেওয়া মানুষের খাবারের ব্যবস্থা প্রতিটি পঞ্চায়েতের মাধ্যমে তদারকি করা চলছে।”
WhatsApp এ নিউজ পেতে জয়েন করুন আমাদের WhatsApp গ্রুপে
আপনার মতামত বা নিউজ পাঠান এই নম্বরে : +91 94745 60584