মোহনা বিশ্বাস, ওয়েব ডেস্কঃ
বৈদ্যনাথ বসাক। নামটা শুনলেও ব্যক্তিটিকে চেনেন না, দুর্ভাগ্যজনকভাবে এমন মানুষের সংখ্যাটাই বেশি। বৈদ্যনাথ বসাক শুধু একটা নাম নয়, বৈদ্যনাথ বসাক হলেন একটা যুগ। এককালীন চলচ্চিত্র জগতের এই চিত্রগ্রাহককে এক ডাকে চিনতেন খ্যাতনামা তারকারা। নীরবে চলে গেলেন এই শ্রেষ্ঠ চিত্রগ্রাহক। বৃহস্পতিবার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন টলিউডের সেরা চিত্রগ্রাহক বৈদ্যনাথ বসাক। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৯৬ বছর। বার্ধক্যজনিত কারণেই প্রয়াত হন বৈদ্যনাথ বাবু।
রাজ কাপুর থেকে উত্তমকুমার, সিনেমা জগতের তাবড় তাবড় ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে কাজ করেছেন তিনি। কিন্তু তাঁর শেষ জীবন কেটেছিল অত্যন্ত দুঃখে। স্বর্ণযুগের এই চিত্রগ্রাহককে ভুলেই গিয়েছিলেন সবাই। রহড়ায় প্রতিদিন চার কিলোমিটার হেঁটে রামকৃষ্ণ মিশনে যেতেন আসতেন বৃদ্ধ মানুষটি। শুধুমাত্র দু’বেলার ভাতের জন্য এত কষ্ট। আশ্রমের দরিদ্রভোজনে এক সারিতে বসে যেতেন তিনি। তাঁকে কেউ চিনতেও পারতনা। এভাবেই ভিক্ষুকের মতো দিনযাপন করে বেঁচে থাকতেন বৈদ্যনাথবাবু। অথচ তাঁরই চিত্রগ্রহণে তোলা পুরনো বাংলা ছবিগুলো এখনও প্রত্যেক বাঙালির ঘরে-ঘরে চলে। কিন্তু কেউ তাঁকে চিনতেই পারেন না, সম্মান দেওয়ার কথা আর নাই বা বলা হল।
আরও পড়ুনঃ মুম্বাইয়ে প্রয়াত কিংবদন্তী পরিচালক বাসু চট্টোপাধ্যায়
২০১৮ সালে খবরে আসেন বৈদ্যনাথ বসাক। তখনই জানা যায় তাঁর দুর্দশার কথা। এই বৃদ্ধ মানুষটিকে নিয়ে তখন উত্তাল হয়ে উঠেছিল সোশ্যাল মিডিয়া। খবরটা পৌঁছে গিয়েছিল টালিগঞ্জের স্টুডিও পাড়াতেও। কারণ টলিউডের বিখ্যাত চিত্রগ্রাহক ছিলেন এই মানুষটি। বয়সের তাঁর কথা সামনে আসার পরে এই অসহায় বৃদ্ধের পাশে দাঁড়ান সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়, গৌতম ঘোষ, মাধবী মুখোপাধ্যায়, মমতা শংকর থেকে শুরু করে দেবও।
উত্তমকুমারের সঙ্গে সবচেয়ে বেশি কাজ করেছেন বৈদ্যনাথবাবু। মহানায়কের ৭২টি ছবিতে সিনেমাটোগ্রাফার হিসাবে কাজ করেন তিনি। তার মধ্যে ছিল ‘অগ্নি পরীক্ষা’, ‘সাগরিকা’র মতো বিখ্যাত ছবি। এছাড়াও, সবার উপরে, লালু ভুলু, সাগরিকা, সোনার খাঁচা, সূর্যসাক্ষী, অগ্নিপরীক্ষা, খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন, ছদ্মবেশী, নায়িকা সংবাদ, বাদশা, অপরাহ্নের আলো, আপন ঘরে-র মতো বহু উল্লেখযোগ্য ছবিতে সিনেমাটোগ্রাফার হিসাবে কাজ করেছেন বৈদ্যনাথবাবু।
আরও পড়ুনঃ ওটিটি, সিনেমা হল দুটি শিবির নয়ঃ অর্ঘদীপ চ্যাটার্জি
রাজ কাপুরের সঙ্গেও কাজের অভিজ্ঞতা ছিল তাঁর। ১৯৫৪ সালে রাজ কাপুরের ‘বুট পলিশ’ ছবিতে প্রযোজনার কাজ করেন তিনি। সেই ছবিতেই চিত্রগ্রাহক হিসেবে প্রথম কাজ করেছিলেন তরুণ তুর্কী বৈদ্যনাথ। পরের বছরই রাজকাপুর নিজেই পরিচালনা করেন ‘শ্রী ৪২০’। সেই ছবিতেও বৈদ্যনাথকে ক্যামেরায় থাকার জন্য আমন্ত্রণ জানান রাজ কাপুর। কিন্তু রাজ কাপুরের আমন্ত্রণে আর সাড়া দিতে পারেননি তিনি।
কারণ, ততদিনে বম্বে থেকে তিনি চলে এসেছেন কলকাতায়। চুক্তি করেছেন অগ্রদূত পরিচালিত উত্তম-সুচিত্রা অভিনীত ‘অগ্নিপরীক্ষা’ ছবির জন্য। বাংলা ও হিন্দি ছাড়াও মালয়ালম, ওড়িয়া ও ভোজপুরী ছবিতেও কাজ করেছেন বৈদ্যনাথ। তাঁর শেষ কাজ রাজ বন্দ্যোপাধ্যায় পরিচালিত ছবি ‘পাড়’। এই ছবিতে অশীতিপর বৈদ্যনাথ বসাককে সিনেমাটোগ্রাফার হিসেবে ব্যবহার করেছেন পরিচালক।
মাধবী মুখোপাধ্যায় অতীতের স্মৃতি ঘেঁটে বলেন, “বৈদ্যনাথবাবুর সঙ্গে ‘ছদ্মবেশী’তে কাজের কথা মনে পড়ছে। উনি খিদে পেলেও বলতেন না। কাজটা আগে করতেন।” খিদে সহ্য করতে পারা সেই মানুষটিই শেষজীবনে দরিদ্রভোজনের লাইনে বসতেন খিদের জ্বালায়। এর চেয়ে বেশি নিষ্ঠুরতা বোধহয় আর হয় না জীবনের। শেষ জীবনে ছেলের সংসারেই ঠাঁই হয়েছিল বিপত্নীক বৈদ্যনাথবাবুর। ছেলে সঞ্জয় একটি ডেকরেটার্সের দোকানে মাসমাইনের কর্মচারী। সব মিলিয়ে অভাবের সংসার। অভাবের মধ্যেই জীবন কাটাতেন তিনি।
অবশেষে বৃহস্পতিবার নীরবে ইহলোক ত্যাগ করলেন সেরা চিত্রগ্রাহক বৈদ্যনাথ বসাক। বৈদ্যনাথবাবু একা নন, এভাবেই অন্ধকার ছায়া গ্রাস করে চলচ্চিত্র জগতের টেকশিয়ানদের। এভাবেই নীরবে বিদায় নেন বহু বৈদ্যনাথ বসাক। তারকার আড়ালে থাকা এই সকল তারকারা আজীবন সকলের কাছে অচেনাই থেকে যান।
WhatsApp এ নিউজ পেতে জয়েন করুন আমাদের WhatsApp গ্রুপে
আপনার মতামত বা নিউজ পাঠান এই নম্বরে : +91 94745 60584