বিশেষ প্রতিবেদন,সুমিত ঘোষ,কোলকাতা:-
১০ই নভেম্বর, ২০১৭… বিশ্ব মানবাধিকার দিবসেই প্রান্তিক যৌনতার মানুষেরা বেছে নিল ‘ কলকাতার ১৬তম রেনবো প্রাইড ওয়াক’ ও ‘ট্রান্সজেন্ডার ডে অফ রেজ’ সংগঠিত করার জন্যে।
মিছিল শুরু হয় দেশপ্রিয় পার্কে, শেষ হয় পার্ক সার্কাস সেভেন পয়েন্ট ক্রসিং-এর কাছে। অনেক সাধারণ মানুষও এই মিছিলে যোগদান করে প্রান্তিক যৌনতার মানুষের লিঙ্গ পরিচিতি ও সামাজিক অধিকারের দাবীর সমর্থনে। বিভিন্ন ন্যায়বিচার মঞ্চ, রাজনৈতিক সংগঠন ও আইনজীবীদের কালেক্টিভ তাদের নিজস্ব পরিচিতি ও পতাকা উহ্য রেখে রামধনু পতাকার তলায় মিলিত হয়।
যৌনতার বিষয়ে সামাজিক সচেতনায় আমাদের দেশ বিশেষ অগ্রগতি না দেখালেও, এই মিছিলে সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের বিশেষ কারণ কি? আসলে, বর্তমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতা থাবা বসিয়েছে লিঙ্গ স্বীকৃতির আন্দোলনের উপরেও।
২০১৪-র সুপ্রিম কোর্টের ‘নালসা’ রায় রূপান্তরকামী ও অন্যান্য প্রান্তিক লিঙ্গ ও যৌনতার মানুষের নাগরিকত্বের অধিকারকে স্বীকৃতিদান করলেও বর্তমান কেন্দ্রীয় ‘সামাজিক ন্যায়বিচার ও ক্ষমতায়ন মন্ত্রালয়’ আসন্ন সংসদের শীতকালীন অধিবেশনে এমন একটি বিল পাশ করতে চলেছে যা এই প্রান্তিক লিঙ্গ ও যৌনতার মানুষের অধিকারকে খর্ব করবে।
এই প্রস্তাবিত ‘ট্রান্স্ জেন্ডার পার্সন্স্ বিল, ২০১৬’ ‘নালসা’ রায় স্বীকৃত মানসিক লিঙ্গ পরিচিতির বদলে শারীরিক লিঙ্গ চিহ্নকেই লিঙ্গ নির্ধারণের একক হিসেবে গণ্য করছে; লিঙ্গ নির্ধারণের জন্য একটি কমিটি গঠনেরও প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে! আসলে, ‘নালসা’ রায় খুব সূক্ষ্মভাবে বিচার করলে দেখা যাবে যে এই রায় সুচতুরভাবে রূপান্তরকামী ও হিজড়ে সম্প্রদায়কে বিশেষ স্বীকৃতি দিয়ে রামধনুর ছটার বাকি রঙ বা লিঙ্গ পরিচিতিগুলির অধিকারের আন্দোলনকে দ্বিধাবিভক্ত করেছিল। বর্তমানে প্রস্তাবিত বিল সেই চতুরতার বেড়া পেরিয়ে সরাসরি প্রান্তিক যৌনতার মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। রাষ্ট্রসংঘের প্রান্তিক যৌনতার মানুষের মৃত্যুদণ্ড বিরোধী একটি রেজলিউশানের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছে ভারত; কেন্দ্রীয় সরকারের মানসিকতা ফলে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। আন্দোলনকারীরা তাই স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত করেছে রাজপথঃ ‘শাড়ি কাপড় খুলবো না, টি জি বিল মানব না’, ‘প্রতিবাদের লাল আগুনে টি জি বিল জ্বলছে, জ্বলবে’... এই বিল হিজড়ে ও কোতি সম্প্রদায়ের বিকল্প জীবিকার ব্যবস্থা না করেই তাদের ভিক্ষাবৃত্তি (ছল্লা)-কে অপরাধ হিসেবে গণ্য করতে চলেছে। প্রতিবাদে সামিল প্রিয়া, সোনালী, ক্রান্তি হাজি, সিমরান–রাও তাই বলছে, ‘তাহলে আমরা খাব কি? এই বিল আমরা পাশ হতে দেব না।’… সুপ্রিম কোর্ট বাধ্যতামূলক আধার সম্পর্কিত মামলায় ‘ব্যাক্তিগত গোপনীয়তা’-কে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে যৌন পছন্দকে ব্যাক্তিগত বিষয় বলে ধার্য করে, লিঙ্গ বৈষম্যের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় এবং লিঙ্গ-যোনি সঙ্গম ছাড়া বাকি প্রাপ্তবয়স্কদের সম্মতিপ্রাপ্ত যৌনাচারকে বেআইনি সাব্যস্ত করা ৩৭৭ ধারার বৈধতা নিয়েও প্রশ্ন তোলে। এই পরিস্থিতিতে ১৭ই ডিসেম্বর, ২০১৭-য় সংসদের সামনে এই কালাকানুনের বিরুদ্ধে ধর্নার ডাক দেওয়া হয়েছে। তবে, প্রান্তিক যৌনতা স্বীকৃতির এই আন্দোলনকে শুধুই আইনি লড়াইয়ে সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না, তার সমাজ সংস্কারক অভিমুখ একান্ত প্রয়োজন। প্রয়োজন প্রান্তিক যৌনতার মানুষের সামাজিক ন্যায়, সুরক্ষা ও অর্থনৈতিক উত্তোলনের পথ প্রশস্তের দাবীর উন্মেষ।
‘নালসা’ রায়ে উল্লিখিত সংরক্ষণের উপদেশ কেন্দ্রীয় সরকার মানতে নারাজ। এমতাবস্থায় প্রগতিশীল বামপন্থী মহলকে আরও সচেতন হতে হবে। সাম্প্রতিক আইসিসের বিরুদ্ধে সিরিয়ায় গজিয়ে ওঠা রামধনু মুক্তিবাহিনী বিপ্লবে তাদের ঐতিহাসিক প্রয়োজনীয়তা সিদ্ধ করেছে। বর্তমান ফ্যাসিবাদী আস্ফালনের পরিস্থিতিতে আন্দোলনকারীদের ‘উদযাপন’ ও ‘আন্দোলন’-এর মধ্যে পার্থক্য উপলব্ধি করা একান্ত প্রয়োজন। প্রাইডের স্পিরিটকে অক্ষুণ্ণ রেখে আন্দোলনের গাম্ভীর্যতা না বজায় থাকলে জনমানসে এই অসম ও কঠিন লড়াই আরও প্রতিকূল বিরোধিতার সম্মুখীন হবে, দুর্বল হয়ে পড়বে। ‘আমার শরীর, আমার মন, দূর হঠো রাজ শাসন’ …
?প্রতিবেদনে-সুমিত ঘোষ,‘চলিত কুয়াশা’ পত্রিকা গোষ্ঠীর সদস্য।
WhatsApp এ নিউজ পেতে জয়েন করুন আমাদের WhatsApp গ্রুপে
আপনার মতামত বা নিউজ পাঠান এই নম্বরে : +91 94745 60584