জানি, এরকম কোন শব্দ আপনি বাপের জন্মে শোনেননি। না আমিও আগে শুনিনি।ধরে নিন শব্দটা আমার সৃষ্টি। মানে ইংরেজি শব্দ pseudocyesis এর বাংলা ভাবার্থ – গর্ভভ্রম।
দুটো ছোট ছোট গল্প বলি বরং, কেমন? একটু বোধহয় খোলসা হবে ব্যাপারটা!
গল্পই বা কি করে বলি! বরং একদম বাস্তব অভিজ্ঞতা।
প্রথমটি আজ থেকে প্রায় বছর দশেক আগে। আমি তখন ইডেন হাসপাতালে।
মানে ঐ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।
আরে বাবা! মেডিকেল কলেজ মানে দি মেডিকেল কলেজ। হ্যা মেডিকেল কলেজ নামে গোটা ভারতে একটি মাত্রই কলেজ আছে। ৮৮ কলেজ স্ট্রিটের ঠিকানায়। বাকি মেডিকেল কলেজ গুলোর কিছু না কিছু একটা নাম আছে আগে।
জাকগে, তো আমি তখন ফার্স্ট ইয়ার। এম ডি করছি। শনিবার। এমারজেন্সি ডিউটি করছি।
সংগে আমার আর একজন জুনিয়র ইন্টার্ন রয়েছে।
তার ইন্টার্নশিপ শেষের দিকে। আর আমারও ফার্স্ট ইয়ার শেষের দিকে। তো দুজনের কনফিডেন্সই আকাশ ছোঁয়া। কিন্তু ওগুলো যে আসলে সিউডো-কনফিডেন্স ছিল, সেটা বুঝেছি আরও কিছুদিন বাদে।
তো ব্যাপার হল, একজন মহিলা এসেছেন লেবার পেইন নিয়ে।
রাত প্রায় সাড়ে বারোটা।
খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার।
সামান্যতম চিন্তাভাবনার বিষয়ই নয়।
আমার ইন্টার্ন ভাইটি খুবই দয়াপরবশ হয়ে বলল- ‘
দাদা তোমার তো আবার কাল ২৪ ঘন্টা ডিউটি! আমি দেখছি, তুমি ঘুমোও।’
এতে চিন্তার বিশেষ কিছু ছিলও না। সত্যি ভর্তির মত কেস হলে আমার কিছু করারও থাকত না। শুধু বাচ্চার হার্ট সাউন্ড দেখে ফর্ম ফিলাপ করে তিন তলায় লেবার রুমে পাঠিয়ে দেওয়া। সেটা এখন ঐ ভাইটিও করতে শিখে গেছে।
কিন্তু হঠাৎ করেই খটকা লাগলো, একটা কথা শুনে। পেশেন্টের বাড়ির লোক বলছে- ‘পেচ্ছাপের পরীক্ষা কি আবার একবার করতে হবে?’
ইন্টার্ন ভাইটি দেখলাম একটু বিরক্তই হল। সেটাই স্বাভাবিক। যে লেবার পেইন নিয়ে রাত বারোটায় ভর্তি হতে এসেছে, সে কিনা সিওর নয় পেটে বাচ্চা আছে কিনা! মামদোবাজি নাকি?
ঘুম চটকে গেছে। বাইরে এসে জিজ্ঞেস করলুম। বাচ্চা নড়ছে?
– হ্যা। কিন্তু সন্ধ্যে থেকে একটু কম নড়ছে।
তো বাচ্চা নড়ছে আবার পেচ্ছাপের পরীক্ষা করাতে চাইছেন কেন?
– ডাগতারবাবু, কুড়ি বছর পর বাচ্চা এসেছে কিনা তাই সন্দেহ যেচ্ছি না।
ধীরে ধীরে ধন্ধ তৈরি হচ্ছে।
ওদের জিজ্ঞেস করলাম- তো শুরুতে তো করিয়েছিলেন পরীক্ষা?
জুনিয়ারটিকে জিজ্ঞেস করলাম- হ্যা রে হার্ট সাউন্ড ঠিক আছে?
দুটো উত্তরেই আমার মাথা ঘামতে শুরু করল।
-ডাক্তারবাবু, পেচ্ছাপের পরীক্ষা করিয়েছিলাম। একটা করেই দাগ আসে। আশা দিদিমণি পোলিও কার্ড করে দিল না। কিন্তু আমার মা বলেছে এই মেয়ে পোয়াতি।
দশ মাস এমসি বন্ধ।
কিছু খেতি পারে না, টক খায় খালি!
সবাই কইল প্যাটের ফটোক করতি।
গরিব মানুষ।
পেশেন্ট ভাল আছে।
বাচ্চা ভাল নড়ছি।
কি হবেক ছবি করায়ে?
– ওদিক থেকে উত্তর এলো- রাজীবদা, তুমি একবার দেখো তো! খুব হাল্কা একটা কিছু আছে মনে হচ্ছে। সিওর হতে পারছি না।
স্টেথো নিয়ে খুব মনযোগ দিয়ে দেখেও বাচ্চার কোন সাড়া শব্দ পেলাম না।
পেট টিপে ভেতর থেকে হাত দিয়ে পরীক্ষা করেও ঠিক নিশ্চিত হতে পারলাম না। কিন্তু ব্যাথা বেশ বেশি থাকায় ভর্তি করে দিলাম। পরদিন খবর পেলাম ইউ এস জি তে একটা বড় জরায়ুর টিউমার পাওয়া গেছিল। কিন্তু মেয়েটির খুব বাচ্চা নেবার শখ ছিল। বহু চেষ্টাতেও কিছু হচ্ছিল না। এরকম অবস্থাতেই একদিন হঠাৎ করে মেয়েটির মাসিক বন্ধ হয়ে যায়। একদিন একটু বমি আর দুর্বলতা। এর থেকে মোক্ষম আর কি ডায়াগনোস্টিক মেথড করতে পারে!
মা-শাউড়ি ঘোষণা করে দিলেন- মা হবি রে তুই এবার ক্ষেপি!
দ্বিতীয় গল্প একেবারে হাতে গরম। গ্যালো হপ্তায়। ক্লিনিক্যাল হিস্ট্রি নিচ্ছিলাম-
-কি সমস্যা?
-ডেলিভারি
-হুম, তো অসুবিধে কি?
-কিছু অসুবিধে নেই। ষোল বছর পর বাচ্চা আসচে। তাই আগে থাকতি দেখিতে এনু!
– ও বাবা! তো এতদিন বাদে এমনি এমনি চলে এলো? স্বাভাবিকভাবে এলো নাকি টেস্টটিউব বেবি?
– গাছড়া লিতাম আগে।
গ্যালো পাঁচ বছর কিছুই না।
বাইশ বছর বিয়া।
শ্বশুরঘরের সবাই খুব অত্যাচার করছিল।
এখন একটু যদি শান্তি পাই!
– তোমার এখন বয়স কত?
– বত্রিশ।
-মানে? তো বিয়ে হয়েছিল কত বয়সে!
সংগে বুঝি মা ছিল। জানালো, ‘গরিবের ঘর ডাক্তারবাবু! ওর বাপ ৯-১০ এ বিয়া দিল। কিন্তু অভাগীর কপালডাই খারাপ!’
– আপনাদের তো বাড়ি শুদ্ধ জেলে ভরা উচিৎ!
– সে আপনি যা ভাল বুঝেন করেন!
– শেষ মাসিক কবে? ( এক্সপেকটেড ডেলিভারির ডেট বের করতে হবে তো!)
– পাঁচ মাসে আগে একবার মাসিক হয়েই বন্ধ। আর হয় নাই।
-তারিখ কবে? কোন মাস!
– পৌষ মাসের ইংরাজি ১০ তারিখ!
– এই আরেক ঝামেলা। বাংলা মাসের তারিখও মনে রাখতে পারবে না রোজ রোজ! কিন্তু মাসিকের মাস বাংলায় আর তারিখ ইংরেজি! আজব কমপ্লিকেটেড মানুষ।
হিসেব করে বুঝলাম জানুয়ারি ১০ তারিখ।
-কিন্তু সার সেন্টারে পেচ্ছাপে বাচ্চা নাই কইল।
বোঝা গেল।
সাব সেন্টারের দিদিমণিরা ইউরিন টেস্ট করেছেন। কিন্তু টেস্ট নেগেটিভ।
পেটে হাত দিয়েও মনে হল বাচ্চা অন্তত তিন মাসের কম বা বাচ্চা আসেইনি। ইউরিন টেস্ট করে ফের জানা গেল পেটে বাচ্চা নেই।
পরের দিন আল্ট্রাসোনোগ্রাফি করেও কোন সুরাহা হল না। বরং আদৌ মেয়েটির জরায়ু আছে কিনা তাই পরিস্কার হল না। তাকে সিটি স্ক্যানের জন্যে বলা হল।
তো এই দুই ক্ষেত্রেই মহিলা দু’জন ভুগছিলেন একটি রোগে। মানসিকই রোগই বলা যায়। যেখানে তারা বাচ্চার জন্যে চেষ্টা করছেন দীর্ঘদিন কিন্তু কিছুতেই সফল হচ্ছেন না।
হঠাৎ করেই তাদের একটা প্রেগনেন্সির খুব সামান্য একটা উপসর্গ দেখতে পেয়েই সেটাকে আঁকড়ে ধরেন। মেডিকেল শিক্ষায় এটার নাম pseudocyesis।
এটা কিন্তু নতুন কিছু কিন্তু নয়। বহু প্রাচীন কালেও এর অস্তিত্ব ছিল।
হিপোক্রিট সর্বপ্রথম এইটি লিপিবদ্ধ করেন সেই খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০ সালে। তিনি বারোটি বিভিন্ন মহিলার কথা লিখে গেছেন যারা এই রোগের শিকার হয়েছিলেন।
তার মধ্যে সব থেকে বিখ্যাত ছিলেন ইংল্যান্ডের রানী মেরী তুদর (১৫১৬-১৫৫৮)।
তিনি প্রেগন্যান্ট না হওয়া সত্ত্বেও নিজেকে প্রেগন্যান্ট বলে দাবি করছিলেন। আর তার নাম বিখ্যাত হয়েছিল ব্লাডি মেরী হিসেবে। কারণ একবার সে খুব রক্তাক্ত কান্ড ঘটিয়ে ফেলেছিল এটা জানার পর যে সে আসলে প্রেগন্যান্ট নয়।
যদিও আজকের দিনে যখন প্রেগন্যান্সি ধরার একাধিক পদ্ধতি বের হয়েছে তখন এই রোগ খুব কমে গেছে। কিন্তু খুব নিম্নবিত্তের মানুষদের মধ্যে আজও এটি পাওয়া যাচ্ছে।
WhatsApp এ নিউজ পেতে জয়েন করুন আমাদের WhatsApp গ্রুপে
আপনার মতামত বা নিউজ পাঠান এই নম্বরে : +91 94745 60584