সাধনবাবুর মৃত্যু

0
71

রাজা বন্দ্যোপাধ্যায়

গভীর রাতে বুকের খাঁচাটার ভিতর এক তীব্র যন্ত্রণায় সাধনবাবু অস্থির হয়ে উঠলেন। সঙ্গে গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো, এক টুকরো মাংস পিণ্ড যেন ওপর দিকে চাগাড় দিয়ে গলার কাছে এসে শ্বাসনালিকে চেপে ধরলো। তিনি একবার চিৎকার করে পাশের ঘর থেকে ঘুমন্ত স্ত্রীকে ডাকবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলেন। গলা দিয়ে কোন আওয়াজ বার হলো না। সাধনবাবু বেশ বুঝতে পারছেন, যে তাঁর পরমায়ু শেষ হয়ে আসছে, অথচ তাঁর কিছুই করার ক্ষমতা নেই। শেষে ধীরে ধীরে তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন।

Cup of tea | newsfront.co
প্রতীকী চিত্র

সকালবেলা স্ত্রীর চিৎকারে আশপাশের বাড়ি থেকে দু’চারজন ছুটে আসলেন। সাধনবাবুর ছানি কাটা নিথর চোখ দুটি খোলা। তিনি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন, স্ত্রী ও আশপাশের প্রতিবেশীদের জটলা। পরিস্কার শুনতে পাচ্ছেন এখন কী কী করণীয়, তাই নিয়ে প্রতিবেশীদের আলোচনা।

“বৌদি, ব্যাঙ্কের চেকবই আর এটিএম কার্ডটা ঠিক জায়গায় আছে তো”?

“কাউকে কোনরকম কষ্ট না দিয়ে কিরকম হঠাৎ করে চলে গেলেন, আপনি ভাগ্যবতী ম্যাডাম। একবার ভাবুন তো কোন নার্সিংহোমে দিলে কী অবস্থা হতো”।

“সে আর বলতে, একবারে ছিবড়ে করে ছেড়ে দিত। আমার ছোট শালার ভায়রাকে মরে যাবার পরেও ওই ভেন্টিলেশন না কী যেন বলে না, তাই দিয়ে সাত দিন রেখে আড়াই লাখ নিয়ে নিল। আপনার ভাগ্য ভালো। তবে এইভাবে দুম করে চলে যাওয়া তো, শেষ সময় একটু জলও পাননি, আপনি কিন্তু অবশ্যই গয়ায় একটা পিণ্ডি দিয়ে আসবেন। তাড়াহুড়োর কিছু নেই, তবে সেই সুযোগে রাজগীর, নালন্দা, বুদ্ধগয়াটাও ঘুরে নেবেন, ফ্যানটাস্টিক জায়গা”।

Raja Banerjee | newsfront.co
রাজা বন্দ্যোপাধ্যায়

“আর ঘোরা, আমার যা শরীরের অবস্থা। আপনারা একটু চা খাবেন তো, আমি চটকরে চায়ের জলটা চাপিয়ে আসছি। ছেলে মেয়েকে খবরটা দেবার ব্যবস্থা করতে হবে, আমি একা হাতে যে কোনদিক সামলাই”।

“হ্যাঁ, ডাক্তারকেও তো একটা খবর দিতে হবে। ডেথ সার্টিফিকেট নিতে হবে তো”।

সাধনবাবু সব কথা শুনতে পাচ্ছেন, একটু ঝাপসা হলেও, সব কিছু দেখতেও পাচ্ছেন, কিন্তু অসুবিধাটা হলো, তিনি মারা যাওয়ায় এদিক ওদিক ঘাড় ফেরাতে পারছেন না। ফলে একটু পাশের লোকজনের কথা শুনতে পেলেও, তাদের দেখতে পাচ্ছেন না।

ছেলে, বৌমা, মেয়ে, জামাই, নাতি, নাতনিরা এসে উপস্থিত হলো। সাধনবাবুর খুব ইচ্ছে করছে নাতি নাতনিকে একটু জড়িয়ে ধরে আদর করেন। কিন্তু একে তো হাত পা অসার, তার ওপর উপস্থিত সকলে ভয় পেতে পারে ভেবে সে চেষ্টা আর করলেন না।

নাতি নাতনি দুটো আগের মতোই দাদুর কাছে যেতে চাইলেও, তাদের পাশের ঘরে পাঠিয়ে দেওয়া হলো। সাধনবাবুর খুব ইচ্ছা করছিল তাদের নিজের কাছে ডাকেন, শেষ বারের মতো তাদের একবার জড়িয়ে ধরে আদর করেন। কিন্তু তাঁর আর সেই ক্ষমতা নেই, অন্য কারোর এই বিষয়ে কোন উৎসাহও দেখলেন না।

ছেলে ও জামাই তাঁর অন্তিম সৎকার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। তাঁকে কোন শ্মশান ঘাটে নিয়ে যাওয়া যায়, কিভাবে নিয়ে যাওয়া যায়, ইলেক্ট্রিক না কাঠের চুল্লি, ইত্যাদি ইত্যাদি।

আরও পড়ুনঃ দলাই লামার গুম্ফায়

সাধনবাবু অনেক সময়েই মনে মনে ভাবতেন, তাঁর বাবাকে যে শ্মশান ঘাটে দাহ করা হয়েছিল, তাঁর মৃত্যুর পর তাঁকেও যেন সেখানেই দাহ করা হয়। কিন্তু এখন আর তাঁর ইচ্ছা-অনিচ্ছার কোন মূল্যই নেই, হয়তো স্থানীয় নোংরা দুর্গন্ধযুক্ত শ্মশানটাতেই তাঁকে দাহ করতে নিয়ে যাওয়া হবে। এই দাহ করার কথা ভাবতেই, তাঁর কিরকম ভয় ভয় করতে শুরু করলো। আগুনে পোড়ার সময় সত্যিই জ্বালা করে না তো, একবার তাঁর হাতে গরম জল পড়ে পুড়ে গেছিল। উঃ সে কী যন্ত্রণা, আজও জায়গাটায় দাগ হয়ে আছে।

স্পষ্ট শুনতে না পেলেও, পাশের ঘরের গুলতানির আওয়াজ তাঁর কানে আসছে। এখন এই ঘরে তাঁর জামাই ও ছেলে ছাড়া আর কেউ নেই। তারা আলমারি খুলে তাঁর সব কাগজপত্র, ব্যাঙ্ক ও পোস্ট অফিসের পাসবই, ফিক্সড ডিপোজিটের সার্টিফিকেট নিয়ে নাড়াচাড়া করছে। মাঝেমাঝেই আর কিছু আছে বা ছিল কী না, এই নিয়ে মতবিরোধ ও সামান্য তর্কাতর্কিও করছে। ব্যাঙ্কের লকার খোলার সময় মা’র সাথে কে যাবে, তাই নিয়েও মতবিরোধ শুরু হয়ে গেছে।

কিছুক্ষণ পরে মেয়ে ও বৌমা ঘর ফাঁকা দেখে এই ঘরে এসে হাজির হলো। কথাবার্তায় বোঝা গেল তারাও একবার আলমারিটা খুলতে চায়, কিন্তু চাবি খুঁজে না পাওয়ায় সেটা সম্ভব হচ্ছে না। মেয়ের খুব ইচ্ছা, তার মায়ের গয়না সমান দুভাগে ভাগ করা হোক। মা’র যেহেতু আর গয়না পরার সুযোগ নেই, তাই ভাগবটরা যা হবার এখনই হয়ে যাওয়াই কাম্য। বৌমার তাতে ভীষণ আপত্তি। সমান দুভাগে ভাগ করার কোন প্রশ্নই ওঠে না।

আরও পড়ুনঃ দীপেন ও সুচেতা

“কেন ঠাকুরঝি, তোমার বিয়েতে বাবা তো তোমায় যথেষ্টই দিয়েছেন, খরচও তো অনেক টাকাই করেছেন বলে শুনেছি। তাতেও তোমার সাধ মেটেনি”?

“আমার আবার সাধ-আহ্লাদ, আমার জন্য বাবা কী করেছেন শুনি? ছোটবেলা থেকেই আমি নেগলেকটেড। ভালো একটা খেলনা, একটা জামা পর্যন্ত কখনও চোখে দেখিনি, অথচ বাবার তো আয় খুব কম ছিল বলে মনে হয় না। সারাটা জীবন একই গল্প শুনে এসেছি, ভবিষ্যৎ, সঞ্চয়, সিকিউরিটি। আরে বাবা ভবিষ্যতে ভালো থাকবো বলে বর্তমানটা নষ্ট করবো, কোন সাধ আহ্লাদ মেটাবো না? কবে সে টাকা ম্যাচিওর হবে, তার জন্য তীর্থের কাকের মতো ঘাড় তুলে বসে থাকো।

ইন্সুরেন্সের টাকাতো আবার না মরলে চোখে দেখা যায় না, সারা জীবন ধরে প্রিমিয়াম দিয়ে যাও। ভবিষ্যতের ভালোর জন্য সারা জীবন কষ্ট করে গেলাম, এখন তুমি এসেছো অধিকার ফলাতে। তোমার বিয়েতে তো তোমার বাবা অনেক শাড়ি, গয়না দিয়েছিলেন, তাই বলে কী তুমি তোমার বাবার সম্পত্তিতে ভাগ বসাবে না। তুমিও বেঁচে থাকবে, আমিও বেঁচে থাকবো, একবার চোখ বুজুক দেখবো কী করো”।

“সে যদি দেয় আমি নেব না? সে তো তোমার দাদা, তোমার ভাইপোর ভালোর জন্যই নেব। তোমার দাদা একটু ভালো থাকুক, তুমি বোধহয় সেটাও চাও না। ধন্যি তোমার লোভ”।

“আমার সংসার নেই, আমার স্বামী একটু ভালো থাকুক, আমার মেয়ে একটা ভালো স্কুলে পড়ুক, তুমি কী সেটা চাইছো”?

সাধনবাবুর একবার মনে হলো একটা উইল করে যাওয়া উচিৎ ছিলো। মেয়ে-বৌমাকে শান্ত করার ইচ্ছাও একবার হলো, কিন্তু এর মধ্যে স্ত্রী ঘরে এসে উপস্থিত হলেন। মেয়ে-বৌমার ঝগড়ার কারণ শুনে, তিনি নিজেকে আর ঠিক রাখতে পারলেন না।

আরও পড়ুনঃ দেবাশিসের চাপ

“মানুষটাকে এখনও ঘাটে তোলা হয়নি, এরমধ্যে তোমাদের ঝগড়া শুরু হয়ে গেল? সব তোমরা দুজনে ভাগ করে নাও, আর আমি শেষ জীবনে ভিক্ষা করে মরি আর কী। তোমাকে আর তোমার দাদাকে মানুষ করতে গিয়ে আমি সারাটা জীবন কষ্ট করেছি। কত ইচ্ছা ছিলো একটা ভালো সাজানো ফ্ল্যাটে থাকি, একটা গাড়ি কিনি, তা না সারা জীবন উনি অফিস করেই মরলেন। আমার সাধ আহ্লাদের কথা না উনি ভেবেছেন, না তোমরা।

আজকাল সকলের বাড়িতেই নিজেদের গাড়ি আছে। আগে একটা গ্যারেজ সমেত ভালো বড় ফ্ল্যাট কেনা হবে, খুব সুন্দর করে সাজানো হবে, তারপর সব কিছু। তোমরাই তো সেই গাড়িতে চাপবে, তোমরাই তো ঝাঁ চকচকে ফ্ল্যাটে থাকবে না কী? স্বামী মারা গেলে কি কেউ গয়না পরে না? খুব মোটা মোটা না হোক হালকার ওপর গয়না এবার আমি গড়াবোই, তোমার বাবা তো সেই নবীন স্যাকরার কাছ থেকে ফিনফিনে কয়েকটা চুড়ি আর একটা হার ছাড়া জীবনে কিছুই গড়িয়ে দেয়নি। তোমাদের জীবন আছে আমার নেই? শেষ জীবনটা একটু ভোগ করবো, তাও তোমরা চাওনা”?

সাধনবাবুর মুখের ওপর দুটো মাছি বসে বড় বিরক্ত করছে। সেদিকে কারো নজর নেই। স্ত্রী গটগট্ করে পাশের ঘরে চলে গেলেন, বোধহয় অতিথিদের জন্য চা করতে। অতিথি নারায়ণ বলে কথা। কলিং বেলটা বেজে উঠলো, বোধহয় ডাক্তার এলেন ডেথ সার্টিফিকেট দিতে।

এই নাও তোমার চা। সাধনবাবুর ঘুম ভেঙে গেল। চোখ মেলে দেখলেন, স্ত্রী চায়ের কাপ রেখে বাইরের দরজা খুলে দিলেন। বাড়ির কাজের লোক দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকলো।

নিউজফ্রন্ট এর ফেসবুক পেজে লাইক দিতে এখানে ক্লিক করুন
WhatsApp এ নিউজ পেতে জয়েন করুন আমাদের WhatsApp গ্রুপে
আপনার মতামত বা নিউজ পাঠান এই নম্বরে : +91 94745 60584

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here