প্রীতম সরকার
“বহু দিন ধরে, বহু ক্রোশ দূরে/ বহু ব্যয় করি, বহু দেশ ঘুরে /দেখিতে গিয়েছি পব্বর্ত্মালা / দেখিতে গিয়েছি সিন্ধু। /দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া / ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া / একটি ধানের শিষের উপরে / একটি শিশির বিন্দু”।
শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
৭ই পৌষ ১৩৩৬
শান্তিনিকেতন।।

এই বিখ্যাত কবিতাটি কবিগুরু লিখে দিয়েছিলেন সত্যজিতকে।বছর দশেক বয়সে সত্যজিৎ রায় প্রথমবার রবীন্দ্রনাথের দর্শন পেয়েছিলেন। তার বহু আগেই তাঁর বাবা সুকুমার রায়ের মৃত্যু হয়েছে। বাবা সুকুমার রায় বা ঠাকুরদা উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরির সঙ্গে লেখালেখির কারনে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে পরিচয় ছিল। সত্যজিৎকে প্রথম শান্তিনিকেতনে নিয়ে গিয়েছিলেন, তাঁর মা সুপ্রভা দেবী।

যখন রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করতে তাঁরা উত্তরায়নে গিয়েছিলেন, সেসময় সত্যজিতের ভীষন শখ ছিল, তাঁর অটোগ্রাফ সংগ্রহের খাতায় রবীন্দ্রনাথকে দিয়ে সই করিয়ে নেওয়ার। রায় পরিবারের সাহিত্য চর্চার সঙ্গে রবীন্দনাথ আগে থেকেই পরিচিত ছিলেন। এমনকী উপেন্দ্রকিশোরের সম্পাদিত ‘সন্দেশ’ পত্রিকাতে ছোটদের জন্য দু-একটি ছড়া কবিতাও লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। যখন সত্যজিতের আড়াই বছর বয়সে তাঁর বাবা সুকুমার রায় মারা যান।

সত্যজিতের জন্ম হয়েছিল উত্তর কলকাতার গড়পার রোডের বাড়িতে। সে বাড়ি থেকেই সন্দেশ পত্রিকাটি প্রকাশিত ও ছাপানো হতো। সুকুমারের অকাল মৃত্যুর পরে সেটা তখনকার মতো বন্ধ হয়ে যায়।যাইহোক, দশ বছর বয়সে দেখা রবীন্দ্রনাথ সারা জীবন ধরেই সত্যজিতের জীবনে নানাভাবে প্রভাব বিস্তার করে গিয়েছেন। শান্তিনিকেতন থেকে সত্যজিতের অর্জন করা বিভিন্ন অভিজ্ঞতা নানাভাবে তাঁর ‘কাজে’ ঘুরে ফিরে এসেছে।

বস্তুত, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আরও এক প্রতিভাধর বাঙালি সত্যজিতের ‘সম্পর্ক’ গড়ে ওঠে সেই প্রথম দিন থেকেই। পরে অবশ্য সত্যজিৎ রায় শান্তিনিকেতনের কলা ভবনের ছাত্র হয়েছিলেন। পূর্বসুরীদের থেকে অর্জন করা শিল্পী সত্যজিৎ রায়ের রক্ততেই ছিল। যেকারনে পরে জীবনে নিজেকে বিজ্ঞাপন জগতের শিল্পী হিসাবে প্রতিষ্টিত করতে বেগ পেতে হয়নি।

তবে সত্যজিৎ খুব বেশিদিন কলাভবনের ছাত্র হিসাবে থাকেননি। সত্যজিৎ বিভিন্ন জায়গায় স্বীকার করে গিয়েছেন, তাঁর জীবনে রবীন্দ্রনাথের সান্নিধ্যে শান্তিনিকেতনে থাকার ‘মূল্য’ অনেক বেশি। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর এক বছর পরেই ‘আর্ট’এর ডিপ্লোমা’শেষ না করেই সত্যজিৎ শান্তিনিকেতন ছেড়ে আসেন। তবে শান্তিনিকেতন বা রবীন্দ্রনাথের প্রভাব সারা জীবনের নানা কাজের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায়।

সিনেমাতে তো বটেই, অনেক পরে যখন লেখক হিসাবে সত্যজিৎ আত্মপ্রকাশ করলেন, তখনও রবীন্দ্রনাথ বা শান্তিনিকেতনকে তিনি এড়িয়ে থাকতে পারেননি। বিখ্যাত ‘ফেলুদা’ সিরিজের গল্পে ফুটে উঠেছে শান্তিনিকেতনে ছাত্র হিসাবে থাকার সময় তাঁর ‘এসর্কাশনে’ অজন্তা ইলোরাতে যাওয়ার অভিজ্ঞতা। ১৯৭৩ সালে তিনি লিখেছিলেন ফেলুদার রহস্য উপন্যাস ‘কৈলাসে কেলেঙ্কারী’ ।

সেকাহিনীর খসড়া খাতায় নাম ছিল ‘কৈলাস রহস্য’। পরে ছাপার সময় নাম বদলে দেন সত্যজিৎ। এমনকী জীবনের শেষ ফেলুদা উপন্যাস ‘রবার্টসনের রুবি’, যেটা লেখা তিনি শুরু করেছিলেন ১৯৯১ সালের ২১ মে- সেই উপন্যাসের পটভুমি তো খোদ রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন। এছাড়াও বিভিন্ন ছবির লোকেশনে তিনি শান্তিনিকেতন বা বীরভূমকে নানাভাবে টেনে এনেছেন। তৈতি করেছেন রবীন্দ্রনাথের বিতর্কিত উপন্যাস ‘ছিন্নপত্র’ কে নিয়ে চারুলতা ছবি।

আবার ‘ঘরে বাইরে’র মতো রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস নিয়ে ছবি। সত্যজিতের প্রথম ছবি ‘পথের পাঁচালী’র চিত্রনাট্য তিনি লিখেছিলেন লন্ডন যাওয়ার সময় জাহাজে বসে। চিত্রনাট্যের সাথে তিনি ছোট ছোট করে দৃশ্যের ছবিও এঁকে রাখতেন। শিল্পী সত্যজিত কিন্ত দিনে সূর্যের আলোয় ছাড়া ছবি আঁকতেন না। যার শিক্ষা তিনি পেয়েছিলেন খোদ শান্তিনিকেতন থেকে।

১৯৬৫ থেকে শেষ জীবন পর্যন্ত সত্যজিৎ রায় লিখে গিয়েছেন একের পর এক উপন্যাস। ফেলুদা, শঙ্কু কাহিনীর মতো জনপ্রিয় উপন্যাস। ফেলুদার রহস্য রোমাঞ্চ কাহিনীগুলি তো রীতিমতো একেকটি ভ্রমন গাইড। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে তৈরি করেছেন ডকুমেন্টারি ফিল্ম। নিয়েছেন রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন গান। যা তাঁর সিনেমাতে ব্যবহার হয়েছে।


ছোট বয়সে যে রবীন্দ্রনাথের সাক্ষাত পেয়ে পরে তাঁর সান্নিধ্যে কিছুকাল কাটিয়ে ছিলেন, সেই রবীন্দ্রনাথ ছিল সত্যজিৎ রায়ের আজীবন সঙ্গী। প্রথম বাঙালী হিসাবে সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন, আর প্রথম বাঙালী চলচ্চিত্রকার হিসাবে ‘লাইফ টাইম’ এভিভমেন্টের জন্য সত্যজিৎ রায় পেয়েছিলেন ‘অস্কার’ পুরস্কার। রবীন্দ্রনাথের প্রকৃত উত্তরসূরী সত্যজিৎ রায়।।
WhatsApp এ নিউজ পেতে জয়েন করুন আমাদের WhatsApp গ্রুপে
আপনার মতামত বা নিউজ পাঠান এই নম্বরে : +91 94745 60584