স্তব্ধতাকে উপেক্ষা করেও পথচলতি-ফুটবাসীদের আহার জোগাচ্ছেন সন্তোষ

0
65

নিজস্ব সংবাদদাতা, পশ্চিম মেদিনীপুরঃ

পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার খড়গপুর স্টেশনের দক্ষিনে একদা সাহেব সুবা দের বাংলো সাইড আর রেলের করনিকদের আদি বাস বাবুলাইনের গা ঘেঁষে গমগমে বাজারের নাম-বোগদা।

Santosh | newsfront.co
সাহায্যের হাত সন্তোষের। নিজস্ব চিত্র

লকডাউনের বাজারে সেই খাঁ খাঁ বোগদাতে কখনও পুরী সবজি, কখনও লুচি আলুর দম, কখনও আবার ইডলি ওপমা নিয়ে বসে থাকা ‘সন্তোষ’কে দেখে লকডাউনের বাজারেও কাজে যেতে হচ্ছে এমন মানুষ মুচকি হেসেছে! আর মনে মনে বলেছে, ছেলেটা জাত মাড়োয়ারি। সু্যোগ বুঝে পুলিশকে ম্যানেজ করে ঠিক ব্যবসা ফেঁদে বসেছে।

 distribution | newsfront.co
নিজস্ব চিত্র

মানুষের মনে করার মধ্যে অবশ্য খুব একটা দোষের নেই। বোগদার বাজারে পুরী সবজি, ইডলি , ধোসা, বড়া , ওপমা থেকে শুরু করে চপ পাকোড়া, ভাত, রুটির খান পঁচিশেক দোকান থাকলেও সন্তোষ খালি চা আর বিস্কুটই বেচে আসছে এতদিন।

আরও পড়ুনঃ নিয়ম রীতি মেনে মেদিনীপুরে চলছে লকডাউন, দাবি প্রশাসনের

cooking | newsfront.co
খাবার বানাতে ব্যস্ত। নিজস্ব চিত্র

আর সেই সব দোকান এখন বন্ধ। সেই বাজারে যদি সন্তোষ এমন একটা দোকান হঠাৎ করে খুলে বসে, তাহলে মানু্ষকে দোষ দেওয়া যায় না। সন্তোষের আরও সমস্যা তার নামের পেছনে কী করে যেন মাড়োয়ারি পদবিটা জুটে গেছে। তাই সব কিছু মিলিয়ে সন্তোষ এই দুর্দিনের সু্যোগ নিয়ে টাকা কামানোর ভাল বন্দোবস্ত করে নেবে এতে আশ্চর্যের কী ?

তবে এই ভুলটা ভেঙে যেতেও সময় লাগে না বেশিক্ষন। পথ চলতি এক রেলবাবু বাড়ি থেকে খেয়ে বেরোনোর সময় তাকে পায়নি সে দিন। বাড়ি থেকে টিফিন করে সন্তোষের দোকানে গাঢ় দুধের চিনি ছাড়া এক কাপ চা খেয়েই অফিসে ঢোকা তাঁর রোজের রেওয়াজ।

আরও পড়ুনঃ করোনার কঠিন পরিস্থিতিতে মাস্ক তৈরিতে ব্যস্ত বাঁকুড়ার পুরপিতা নীলাদ্রি

কিন্তু এই লকডাউনের বাজারে সন্তোষ আবার চা বিক্রি করছে না, বরং এখন সে বিকোচ্ছে শুধুই নাস্তা। তো বাধ্য হয়েই সেই রেলবাবু চার পিস পুরী সবজি খেয়ে, মানি ব্যাগে হাত দিতেই সন্তোষ বলল, ”পয়সা লাগবে না।” রেলবাবু অবাক ! হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন কিছুক্ষন।

আর তারপরই আরও অবাক হওয়ার পালা! সকাল ৭ টার পর পিল পিল করে লোক আসতে শুরু করল আর সন্তোষ তাদের তুলে দিতে লাগলেন সেদিন সকালের মেনু পুরী আর সবজি!

জানা গেল লকডাউনে শেষবার যে ট্রেন থেমে গিয়েছিল খড়গপুর জংশনে। তাঁর জনা তিরিশেক মানুষ যাঁদের বাড়ি ভিন জেলায় কিংবা ভিন রাজ্যে। যাঁদের আবাস এখন খড়গপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের বাংলো যাওয়ার পথের এই ফুটপাত।তাদের মধ্যে জনা ২০ ফুটপাতবাসীর যাঁদের এখন ভিক্ষেই জোটে না। আর সব মিলিয়ে প্রায় শতাধিক মানু্ষের সকালের নাস্তা যোগান দিচ্ছেন সন্তোষ।

লোক মুখে জানা যায়, এই সন্তোষ মাড়োয়ারি পোশাকি নাম আসলে ‘সন্তোষ কুমার হালওয়াসিয়া’। উড়িষ্যার কটকের বিমানী গ্রামের বাসিন্দা সন্তোষ আজ থেকে ৩৪ বছর আগে একটা ট্রেনের কামরায় বিনা টিকিটে যাত্রী হয়ে চলে আসে কাজের খোঁজে এই খড়গপুরে।

তবে কাজ তেমন জোটেনি কিন্তু প্ল্যাটফর্মে ঘুরে ঘুরে পুরী সবজি , চা , কফি ইত্যাদি বিক্রি করতে শুরু করেও কিন্তু বাজার জমাতে পারে নি সে। স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে ডিউটি দেওয়া রেল সুরক্ষা বাহিনী বা আরপিএফের কিছু আধিকারিক আর জওয়ান বুঝে যান সহজ সরল সন্তোষ জমাতে পারবে ব্যবসা।

তাই তাঁরা সন্তোষকে নিয়ে চলে আসেন রাতে দেখভাল করার জন্য আর পি এফ অফিসে। প্রতি রাতে সেখানেই থাকে সন্তোষ। কিন্তু এভাবে তো আর দিন চলে না! বাড়ির জন্য পয়সা চাই যে । বছর বাইশেক আগে আরপিএফ এর আধিকারিকরাই ফের বোগদাতেই তাকে একটি চায়ের দোকান খুলে দেন।

সন্তোষের সেই চায়ের দোকান এখন বিখ্যাত। মোটা দুধের কড়া পাকের সেই চায়ের দোকানে এখন রেলের আধিকারিক, রেল সুরক্ষা বাহিনীর জওয়ান, সাংবাদিক থেকে বিজেপির রাজ্য সভাপতি তথা মেদিনীপুর লোকসভা কেন্দ্রের সাংসদ দিলীপ ঘোষ চায়ের জন্য উপস্থিত হয় তার দোকানে।

তাছাড়াও সাধারণ মানুষ কে না আসেন? কিন্তু কেন এই উদ্যোগ প্রশ্ন করতে সন্তোষ জানায়, ‘একদিন নিঃস্ব অবস্থায় অনাহুত অতিথি হয়ে এসেছিলাম এই খড়গপুরে। তখন আমাকে বিনা হাতে ফিরিয়ে দেয়নি খড়গপুর। আজ সেই খড়গপুরের অতিথি হয়ে কেউ না খেয়ে থাকবে এটা চাইনা। দিনে রাতে প্রশাসন পুলিশ, আর পি এফ কেউ না কেউ খাবার দিচ্ছেন। তাই আমি এই সকালটাই বেছে নিলাম।’

সন্তোষের এই বিনা পয়সার দোকানে দিব্যি খেয়ে যেতে পারেন লকডাউনে বাধ্য হয়ে বাইরে বের হওয়া মানুষও । সন্তোষের এই অদ্ভুত উদ্যোগ মুগ্ধ করেছে খড়গপুরবাসীকে। তাঁর রসদে যেন টান না পড়ে তাই তাঁর পাশে কয়েকদিন হল এসে দাঁড়িয়েছে খড়গপুরের ইন্দা এলাকার অন্যতম বিখ্যাত দুর্গা পুজার আয়োজক বিদ্যাসাগরপুর পূজো কমিটির ক্লাবের সদস্যরাও।

নিউজফ্রন্ট এর ফেসবুক পেজে লাইক দিতে এখানে ক্লিক করুন
WhatsApp এ নিউজ পেতে জয়েন করুন আমাদের WhatsApp গ্রুপে
আপনার মতামত বা নিউজ পাঠান এই নম্বরে : +91 94745 60584

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here