মোহনা বিশ্বাস, বিনোদন ডেস্কঃ
প্রতি কাজে প্রতি পলে, সবাই যে কথা বলে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই কথাগুলি চলচ্চিত্র জগতের মহারাজা সত্যজিৎ রায়-এর সঙ্গে একেবারে মানানসই। সত্যজিতের প্রত্যেকটি কাজই প্রতিক্ষণে সমালোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। তাঁর পরিচালিত চলচ্চিত্রগুলি জনপ্রিয়তার শিখরে বিরাজমান। ১৯২১ সালে ২মে জন্মগ্রহণ করেছিলেন প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা সত্যজিৎ রায়। আজকে আমার আলোচনার বিষয় হল তাঁর পরিচালিত স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবি ‘টু’।
সত্যজিৎ রায়ের প্রায় সব কাজই বেশ প্রশংসা কুড়িয়েছে। তবে তাঁর কাজগুলোর মধ্যে সবথেকে কম আলোচিত হয় ‘টু’-কে নিয়ে। অথচ এই ছোট নির্মাণেই তিনি তাঁর অনবদ্য কাজ দেখিয়েছিলেন। পরিচালনার পাশাপাশি এই ছবির স্ক্রিনপ্লে ও মিউজিকের দায়িত্বও নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন তিনি।
১৯৬৪ সালে ইএসএসও ওয়ার্ল্ড থিয়েটার নামে একটি কোম্পানি সত্যজিৎ রায়কে একটি শর্ট ফিল্ম নির্মাণের অনুরোধ জানায়। এরপরই সত্যজিৎ সাদা-কালো ব্যাকগ্রাউন্ডে একটি শর্টফিল্ম তৈরি করেন। যার নাম ‘টু’। এই ছবিটি ইংরেজি ভাষায় করার কথা বলেন ইএসএসও ওয়ার্ল্ড থিয়েটারের কর্তৃপক্ষ। কিন্তু সত্যজিৎ রায় ইংরেজি ভাষায় ছবিটি করতে মনস্থির করতে পারেননি। ফলে তিনি সংলাপ ছাড়াই নির্মাণ করেন শর্ট ফিল্ম ‘টু’। এটি নির্মাণের জন্য তিনি মাত্র তিনদিন সময় পেয়েছিলেন তিনি। ছবিতে অভিনয় করেছিলেন ৬-৭ বছরের দুই শিশু। এদের মধ্যে একজন ছিলেন রবি কিরণ আর একজন ছিলেন পথশিশু।
মূলত সমাজের শ্রেণীদ্বন্দ্ব ও শিশু মনের ধ্বংসাত্মক মনোভাবের চিত্রই তুলে ধরা হয়েছে এই শর্ট ফিল্মটিতে। ছবির কাহিনী একটি ধনী ও একটি দরিদ্র ছেলেকে ঘিরে। গল্পের শুরুতেই দেখা যায় দোতলা বাড়ির বারান্দায় একটি বাচ্চা ছেলে কোকাকোলার বোতল হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মাথায় মিকি মাউসের ক্যাপ। বাড়ির প্রত্যেকটি দেওয়ালে জমিদারি ছাপ স্পষ্ট। এরপরই দেখা যায়, ছেলেটি নীচের গাড়িতে থাকা মা কে হাত নেড়ে বিদায় জানায়। এই শটটি থেকে বোঝা যায় যে, ধনী পরিবারের সন্তানরা বাবা মায়ের সঙ্গ খুব কমই পায়।
বিদায় দিয়ে তাদের ভেতরের রুমে আসার পর বেলুন আর ফিতা দেখে মনে হয়, এই বাড়িতে হয়তো গতকাল কোনো পার্টির আয়োজন করা হয়েছিলো। মনে করিয়ে দেওয়া হয়, আমাদের সমাজের ধনীদের জন্য পার্টির আয়োজন করা খুব সহজ স্বাভাবিক একটা বিষয়।
এরপরই দেখানো হয় ছেলেটির বাড়িতে খেলনায় ভর্তি। সে গিয়ে একটি সোফায় হেলান দেয়। এরপরই ক্যামেরা টেবিলে ফোকাস করে। সেখানে দেখা যাচ্ছে টেবিলে সিগারেট ও দেশলাইয়ের প্যাকেট পরে রয়েছে। ছেলেটির অভিভাবকরা যে কতটা অসচেতন সেটা এই দৃশ্য দেখলে স্পষ্ট হবে দর্শকের কাছে। ছবিটির বিভিন্ন শটে এরকমই একটি ধ্বংসাত্মক মনোভাবাপূর্ণ শিশু চরিত্রকে তুলে ধরা হয়েছে। এরপর একটা শটে দেখা যায় বাইরে ঝুপড়ির এক দরিদ্র শিশু বাঁশের বাঁশি বাজাচ্ছে। সেই আওয়াজ শুনে ধনী পরিবারের ছেলেটিও জানলায় গিয়ে দাঁড়ায়। দরিদ্র ছেলেটির বাঁশি বাজানো সহ্য করতে না পেরে সেও তার খেলনা ক্লারিওনেট নিয়ে দরিদ্র ছেলেটাকে দেখিয়ে দেখিয়ে বাজাতে থাকে। এখান থেকেই শুরু হয় দ্বন্দ্ব নির্মাণের কাজ।
এরপর এরকমই বিভিন্ন শটে দুই শিশুর মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখানো হয়। একসময় দেখানো হয় যে, দরিদ্র ছেলেটা ঘুড়ি ওড়াচ্ছে। সে হেরে যাওয়ার পাত্র নয়। তাঁর কাছে আছে প্রাকৃতিকভাবে বানানো সব হাতিয়ার। তবে তা কাউকে ধ্বংস করার নিমিত্তে নয়, একেকটা আনন্দের হাতিয়ার। ধনী ছেলেটার কাছে এই খেলনার প্রতিযোগিতা করার মতো কিছু না থাকায় সে ঘুড়ি ধ্বংস করার চিন্তা আঁটে।
প্রথমে তার কাছে থাকা গুলতি দিয়ে চেষ্টা করে। ব্যর্থ হলে সে হাতে তুলে নেয় বন্দুক। গুলি করার পর ঘুড়ি ছিঁড়ে পড়ে যায়। ঘুড়ি কেটে যাওয়ার পর বিষণ্ন মুখ নিয়ে দরিদ্র ছেলেটি ঘরে চলে যায়। অন্যদিকে, বন্দুক হাতে নিয়ে মহানন্দে জানলা থেকে সরে গিয়ে ভিতরে চলে যায় অপর ছেলেটি। সে ভাবতে থাকে যে সে জিতে গেছে। তাই সে ঘরের সব কৃত্রিম খেলনাগুলিকে একসঙ্গে চালনা করে।
কিছুক্ষণ পর আবারও সেই বাঁশির আওয়াজ শুনতে পায় সে। এই শটে ধরা পরে অবহেলায় থেকেও আমাদের দরিদ্রদের হার মেনে না নেওয়ার চিত্র। তাদের যা আছে তা নিয়েই তারা সুখে থাকতে চায়। কারণ তারা স্বাধীনভাবে বেঁচে আছে। অন্যদিকে, অফুরন্ত সুযোগ আর আরামে থেকেও সুখ নেই ধনীদের।
শর্ট ফিল্ম ‘টু’-তে সমাজের দ্বন্দ্ব পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তুলে ধরেছেন। পাশাপাশি শিশু মনে তৈরি হওয়া ধ্বংসাত্মক মনোভাবকেও নিপুণ ভাবে দেখিয়েছেন ১৫ মিনিটের এই ছবিটিতে। সত্যজিৎ রায়ের এহেন কাজ সমাজের বাস্তবতাকে মানুষের কাছে আরও স্পষ্ট করে তোলে। তাঁর এই নির্মাণ চিরকালের জন্য অবিস্মরণীয় হয়ে থেকে গিয়েছে। তাঁর প্রতিভাকে তিনি নিজেই এই ছবির মধ্যে দিয়ে দর্শকের সামনে তুলে ধরেছেন।
WhatsApp এ নিউজ পেতে জয়েন করুন আমাদের WhatsApp গ্রুপে
আপনার মতামত বা নিউজ পাঠান এই নম্বরে : +91 94745 60584