মোহনা বিশ্বাস, কলকাতাঃ
“আকাশে কেঁপেছে বাঁশিসুর…আঁচলে উড়েছে ময়ূর…চলে যাই বলেছিলে চলে যাই…মহুল তরুর বাহু ছুঁয়ে…যে গেছে অশ্রুময় বন অন্তরালে…” মহীনের ঘোড়াগুলি’র অন্যতম সৃষ্টি ‘চৈত্রের কাফন’-এর লিরিক্সে এমনই কিছু কথা লিখেছিলেন শিল্পী রঞ্জন ঘোষাল।
মহীনের আস্তাবলের অন্যতম ‘ঘোড়া’ ছিলেন এই শিল্পী। বৃহস্পতিবার ভোরে নিজের বাড়িতে ঘুমের মধ্যেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন রঞ্জন ঘোষাল। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৫ বছর। এই দুঃসংবাদটি পাওয়া মাত্রই শোকের ছায়া নেমে আসে বাংলা সঙ্গীত জগতে।
খবরটা শুনে আমিও আর স্থির থাকতে পারলাম না। শিল্পী রঞ্জন ঘোষাল সম্পর্কে জানার আগ্রহটা আরও বেড়ে গেল। তাই তিন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বের সঙ্গে ফোনেই যোগাযোগ করেছিলাম আমি।
আরও পড়ুনঃ প্রয়াত মহীনের আরেক ঘোড়া রঞ্জন ঘোষাল
এরপর আমার সঙ্গে ফোনালাপে প্রয়াত শিল্পী রঞ্জন ঘোষাল-এর স্মৃতিচারণ করেন মহীনের অন্যতম সদস্য তাপস(বাপি) দাস, জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি অরুণ কুমার চক্রবর্তী এবং বাংলা ব্যান্ড তেপান্তরের বাবী ব্যানার্জি।
মহীনের অন্যতম সদস্য তাপস(বাপি) দাস বলেন, “১৯৭৫ সালে সাত যুবক মিলে তৈরি হয়েছিল প্রথম স্বাধীন বাংলা ব্যান্ড মহীনের ঘোড়াগুলি। কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতা থেকেই এই ব্যান্ডের নামকরণ হয়। মহীনের ঘোড়াগুলির অন্যতম সদস্য ছিল রঞ্জন ঘোষাল।
মহীনের অজানা উড়ন্ত বস্তু বা অ-উ-ব, সুধীজন, চৈত্রের কাফন-এর মতো বেশ কয়েকটি গান লিখেছিল রঞ্জন। মহীনের ঘোড়াগুলিতে ৬ বছর আমরা একসঙ্গে ছিলাম। তারপর রঞ্জন কর্মসূত্রে বেঙ্গালুরু চলে যায়। বেঙ্গালুরুর বাড়ির নাম রেখেছিল ইয়েলো সাবমেরিন।
আরও পড়ুনঃ দক্ষিণ দিনাজপুরে ঘোষিত হল ৪৭ টি কনটেনমেন্ট জোন
মাঝে মধ্যে কলকাতায় এলে আমার সঙ্গে আর মণি দা-র সঙ্গে দেখা করতো ও। তারও আগে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র ছিল। মহীনের একেবারে শুরু থেকে আমরা সবাই একসঙ্গে ছিলাম। শুধু সঙ্গীতের দুনিয়াতেই রঞ্জন ঘোষালের বিচরণ ছিল এমনটা নয়, লেখক ও নাট্যব্যক্তিত্ব হিসাবেও সমাদৃত হয়েছিল রঞ্জন।
বেঙ্গালুরুতে ওঁর স্ত্রী সঙ্গীতার গ্রুপ থ্রি নামে একটি থিয়েটার দলের সঙ্গে ইংরেজি নাটক পরিচালনা এবং পারফর্ম করতো। রোমান্টিক কবিতা লিখতো রঞ্জন। এছাড়াও বেশ সুন্দর সুন্দর ছোট গল্প, অনুগল্পও লিখতো। তার মধ্যে ‘নরম পাক, গরম পাক’ এবং ‘মাখা সন্দেশ’ এই দুটো অনুগল্প সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। আজ ওঁর মৃত্যুর খবর পেয়ে মর্মাহত হয়েছি আমি। আমার অত্যন্ত প্রিয় বন্ধু ছিল। ও যেখানেই থাকুক ভালো থাকুক। ওঁর আত্মার শান্তি কামনা করি।”
আরও পড়ুনঃ রাস্তা সারাইয়ের দাবিতে পথ অবরোধ গ্রামবাসীদের
রঞ্জন ঘোষাল-এর স্মৃতিচারণ করে জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্ত কবি অরুণ কুমার চক্রবর্তী বলেন, “ রঞ্জন ঘোষাল আমার ভাইয়ের মতো ছিল। ৭০-এর দশকে তৈরি প্রথম বাংলা ব্যান্ড ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’র অন্যতম সদস্য ছিল রঞ্জন ঘোষাল। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র ছিল।
এরপর বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দেখা হয়েছিল ঠিকই। তবে কিছুদিন পর কর্মসূত্রে বেঙ্গালুরু চলে যায় রঞ্জন। তাই যোগাযোগ কমে যায়। এরপর বেঙ্গালুরুর একটা লোক উৎসবে রঞ্জন ঘোষালের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। তখন বলেছিল কলকাতায় এলে আমার সঙ্গে কেঁন্দুলি মেলায় যাবে। কিন্তু যাওয়া আর হল না। আজকে ওঁর মৃত্যু সংবাদ পেয়ে মনটা খারাপ হয়ে গেল। ওঁর আত্মার শান্তি কামনা করি।”
আরও পড়ুনঃ একাধিক দাবিতে ডেপুটেশন ‘অ্যাবেকা’ -র
বাংলা ব্যান্ড তেপান্তরের বাবী ব্যানার্জি বলেন, “আমরা যারা এই প্রজন্মে বাংলা ব্যান্ড করি। আমাদের রোল মডেল ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’। মহীনের ঘোড়াগুলির থেকেই বাংলা গানে বিপ্লবের সূত্রপাত। সেটাকেই আমরা এখনও অনুসরণ করে যাচ্ছি। ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’র প্রাণপুরুষ গৌতম চট্টোপাধ্যায়-কে অনেক আগেই হারিয়েছি আমরা। এই ক্ষতি কোনওদিন পূরণ হবে না।
বর্তমানে আমার সৌভাগ্য যে কাজের সূত্রে মহীনের আদি ঘোড়া বাপি দা-র সঙ্গে আমার একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ওঁনার থেকে অনেক কিছু শিখেছি, আগামী দিনেও শিখব। রঞ্জন ঘোষাল -এর চলে যাওয়াটা অপূরণীয় ক্ষতি। এমনই রঞ্জন ঘোষাল এমন একটা ব্যক্তিত্ব যাঁর জ্ঞানটা ছিল মারাত্মক। উনি রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে বাংলা ব্যান্ড পুরোটাকে এত ভালো লিঙ্কাপ করতেন।
ওঁনার কথাবার্তা সমস্ত কিছেতেই। কবিতায়, নাটকেও উনি অসম্ভব পারদর্শী ছিলেন। উনি বহুগুণ সম্পন্ন একজন মানুষ। রঞ্জন ঘোষালের চলে যাওয়াটা বাংলা ব্যান্ডের এক অপূরণীয় ক্ষতি। ওঁনার আত্মার শান্তি কামনা করি। এঁদের কখনো মৃত্যু হয়না। রঞ্জন দা, মণি মামা-এঁনারা চিরকাল আমাদের গিটারে বেঁচে থাকবেন।”
WhatsApp এ নিউজ পেতে জয়েন করুন আমাদের WhatsApp গ্রুপে
আপনার মতামত বা নিউজ পাঠান এই নম্বরে : +91 94745 60584