নিজস্ব সংবাদদাতা,দক্ষিণ দিনাজপুরঃ
স্বাধীনতা আন্দোলনের অনেক ঘটনার মধ্যে অন্যতম একটি ঘটনা হল হিলি মেল ডাকাতির ঘটনা । যা এখনও শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে থাকে জেলাবাসী । জনশ্রুতি যা নাকি চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠনে অর্থবল জুগিয়েছিল।
স্বাধীনতার ৮৭ বছর পর বিস্মৃতির অন্তরালে চলে যাওয়া ঘটনা অর্থাৎ দেশকে বৃটিশ মুক্ত করার জন্য বীর স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সেই হিলির মেল ডাকাতির ঘটনাকে আজ শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করল দক্ষিণ দিনাজপুর জেলা পুলিশ। সেই দার্জিলিং মেল ডাকাতির ঘটনায় জড়িত স্বাধীনতা সংগ্রামীদের গ্রেফতার করেছিল তৎকালীন অখন্ড ভারতের দিনাজপুর জেলার পুলিশ।
আজ বলতে গেলে সে সময়ের পুলিশের ভুমিকার প্রায়শ্চিত্ত করতেই দক্ষিণ দিনাজপুর জেলা পুলিশের উদ্যোগে জেলার সেই সীমান্ত শহর হিলিতে এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তৎকালীন স্বাধীনতার বীর সেনানীদের বীর গাথা তুলে ধরে দেশকে স্বাধীন করে তুলতে তাঁদের অবদান আবার ও জেলাবাসীকে স্মরণ করিয়ে দেশকে এক এবং অখন্ড রাখার বার্তা দিল জেলা পুলিশ।
সালটা ছিল ১৯৩৩ আর তারিখ ছিল ২৮ অক্টোবর। আর স্থানটা ছিল অবিভক্ত দিনাজপুর জেলার হিলি রেল স্টেশন। পরাধীন দেশকে স্বাধীন করতে বীর বিপ্লবী সন্তানরা তখন দেশের নানা প্রান্তে আন্দোলনের দিকে ঝাঁপিয়েছে । কিন্তু পরাক্রমশালী বৃটিশদের বিরুদ্ধে লড়তে শুধু লোকবল যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন ছিল অর্থবলের ও। তাই তখনকার এই দিনাজপুর জেলার স্বাধীনতা আন্দোলনের বীর সেনানীরা অর্থ সংগ্রহের জন্য বেছে নিয়েছিল মেল ডাকাতি।
তৎকালীন হিলি ছিল সমৃদ্ধশালী একটি ব্যবসায়িক স্থল। ওখানকার ব্যবসায়ীরা প্রতিদিন তাদের ব্যবসায়িক প্রয়োজনে হিলি স্টেশন থেকে যাতায়াতকারী দার্জিলিং মেল (ডাক) মারফৎ কলকাতায় তাদের অর্থ পাঠিয়ে থাকতেন।বিপ্লবী সেনানীদের চোখ যায় সে দিকে। ১৯৩৩ এর ২৮ অক্টোবর রাত তিনটে নাগাদ প্রাণকৃষ্ণ চক্রবর্তীর নেতৃত্বে সশস্ত্র ১৫ জন বিপ্লবী বীর সেনানী অর্থ জোগাড়ের জন্য স্টেশন থেকে মেল ব্যাগ ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য হানা দেয় হিলি স্টেশনে।কিন্তু প্ল্যাটফর্মে শুয়ে থাকা কুলিদের চিৎকারে ততক্ষণে স্টেশন মাষ্টার বন্দুক নিয়ে বাইরে বেড়িয়ে এসে টাকা ভর্তি মেল ব্যাগ রক্ষা করতে গুলি চালাতে থাকে। পাল্টা গুলি চালিয়ে মেলব্যাগ ডাকাতি করে পালায় স্বাধীনতা সংগ্রামীরা। পরে অবশ্য ধরা পড়েন ১৩ জন ।
আরও পড়ুনঃ কোচবিহারে অস্থায়ী শিক্ষা কর্মচারীদের অবস্থান বিক্ষোভ
বাকি ২ জনকে তৎকালীন পুলিশ ধরতেয পারেননি। এই ১৩ জনের মধ্যে ৩ জন অবশ্য ভয়ে রাজসাক্ষী হয়ে ছিলেন। ১৯৩৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারী দিনাজপুর জেলার স্পেশাল ট্রাইবুন্যাল কোর্টের ৩ বিচারক বাকি ১০ জনের মধ্যে ৪ জন তাঁরা হলেন প্রাণকৃষ্ণ চক্রবর্তী, ঋষিকেষ ভটচার্য, সরোজ বসু ও সত্যব্রত চক্রবর্তীকে ফাঁসির নির্দেশ দেন। পরে উচ্চ আদালতের নির্দেশে আন্দামানে যাবজ্জীবন কারাবাস হয় তাঁদের ।এছাড়াও যাদের বয়স কম ছিল তাদের কয়েক বছর কারাবাসের আদেশ হয়। এভাবেই হিলি মেল ডাকাতি দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছিল । যা আজ ফের দেশবাসী তথা জেলাবাসীকে জানান দিতে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করল জেলা পুলিশ।
আরও পড়ুনঃ মেদিনীপুর সমন্বয় সংস্থার উদ্যোগে জন্মদিনে দেশপ্রাণ বীরেন্দ্রনাথ শাসমল স্মরণ
আজকের জেলা পুলিশের উদ্যোগে আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন সেদিনের তিন বিপ্লবী কালিপদ সরকার, রামকৃষ্ণ সরকার ও কিরণ চন্দ্র সরকারের পুত্রগন। অনুষ্ঠান শুরুর আগে হিলি বাস স্ট্যান্ডে থাকা হিলি মেল ডাকাতির স্মৃতিতে নির্মিত বেদীতে ফুলের মালা ও পুষ্প অর্পণ করে শ্রদ্ধা জানান জেলা পুলিশ সুপার দেবর্ষি দত্ত সহ জেলার পুলিশের উচ্চপদস্থ আধিকারিকগন । পাশাপাশি উপস্থিত ছিলেন তিন বিপ্লবীর পুত্রগন যথাক্রমে প্রণব কৃষ্ণ সরকার, প্রদীপ চন্দ্র দে ও কুমার সরকার। এই অনুষ্ঠানে আজ জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে তাঁদের সংবর্ধনা জ্ঞাপন করা হয়।
আরও পড়ুনঃ ঘোষিত হল বীরভূম জেলায় বিশ্ববাংলা শারদ সম্মানের ফলাফল
এছাড়াও আজকের এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন হিলির বিশিষ্ট অধ্যাপক হিমাংশু সরকার ও বালুরঘাটের প্রাক্তন বিধায়ক শংকর চক্রবর্তী। উপস্থিত ছিলেন জেলার ইতিহাসবিদ সমিত ঘোষ ও শিক্ষাবিদ তথা সাহিত্যিক কৃষ্ণপদ মন্ডল। হিলির বিশিষ্ট অধ্যাপক হিমাংশু সরকার, সমিত ঘোষ ও কৃষ্ণপদ মন্ডল হিলি মেল ডাকাতির কিছু কিছু পুরোনো ইতিহাস উপস্থিত মানুষদের কাছে তুলে ধরেন। মঞ্চে বক্তব্য রাখেন উপস্থিত থাকা বীর বিপ্লবীর পুত্রগনও।
ইতিহাস ও ঐতিহ্য যেখানে হাত ধরাধরি করে চলে সেই হিলি তে দাঁড়িয়ে অনুষ্ঠান মঞ্চ থেকে জেলা পুলিশ সুপার দেবর্ষি দত্ত স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে হিলি মেল ডাকাতির উল্লেখযোগ্য অবদানকে স্মরণ করে জানান যে তাদের এই অনুষ্ঠান করার উদ্দেশ্য হল নতুন প্রজন্মকে এই জেলার ইতিহাস সম্পর্কে অবগত করা, পাশাপাশি দেশ মাতৃকার প্রতি তাঁদের বলিদান সকলের সামনে তুলে ধরে তাঁদের প্রতি সম্মান জ্ঞাপন করা ।
WhatsApp এ নিউজ পেতে জয়েন করুন আমাদের WhatsApp গ্রুপে
আপনার মতামত বা নিউজ পাঠান এই নম্বরে : +91 94745 60584