পিয়া গুপ্তা,উত্তর দিনাজপুরঃ
ভাল কাজ করার ইচ্ছে থাকলে যে বয়সও কোনও বাধা হয় না,তার জলজ্যান্ত উদাহরণ হয়ে উঠেছে রায়গঞ্জের ৮ বছরের ঋষিকা।
রায়গঞ্জের উকিল পাড়ার বাসিন্দা কৌশিক চক্রবর্তীর ছোট্ট মেয়ে ঋষিকা।আট বছর বয়সেই কাঁধ ছাপানো একঢাল ঝলমলে কালো চুল দেখে সকলেই মুগ্ধ হতো।হিংসেও যে কেউ কেউ করত না,জোর দিয়ে বলা যায় না।সেই মেয়েই এক দিনে হঠাৎ ন্যাড়া হয়ে গেল!না,কোনও দুর্ঘটনা বা দুঃখের কারণে নয়।আনন্দে।
নিছক আনন্দে মাথা ফাঁকা করে ফেলল আট বছরের ছোট্ট ঋষিকা !এত আনন্দের কারণ,সে জানে, তার এই এত দিন ধরে যত্ন করে বড় করা চুলগুলো কাজে লাগবে তারই মতো কোনও কোনও ছোট্ট মেয়ের মাথা ভরাতে।
যে মেয়েরা হয়তো তার মতোই চুল ভালবাসত,কিন্তু মারণ রোগ ক্যানসার কেড়ে নিয়েছে তাদের সব চুল!ঋষিকার ডাক নাম তিতির।রায়গঞ্জের সারদা বিদ্যামন্দির স্কুলের ছাত্রী সে।
নিউজফ্রন্ট প্রতিনিধিকে সে জানাল,লম্বা লম্বা চুলগুলো তার খুবই প্রিয় ছিল,কিন্তু যে কাজটা সে করেছে,সেটাও তার খুবই প্রিয়।সে শুধু এই বার নয়,এর পরেও বারবার করবে এই কাজ।
ফোনের ও-পার থেকে কচি গলায় ভেসে এল,“আমি চুল দিয়ে দিয়েছি,ক্যানসার পেশেন্টদের জন্য।ওদের তো কেমোথেরাপি নেওয়ার পরে চুল পড়ে যায়,তাই।আমি পরে আবার দেব চুল,বড় করি আগে!”
কিন্তু এত বড় মেয়ে এ রকম হঠাৎ করে নেড়ু হয়ে গেল, তার কি একটুও খারাপ লাগছে না?
ছোট্ট তিতিরের উত্তর,“কাল স্কুল খুলবে,সবাই আমায় নিয়ে মজা করবে।কিন্তু আমি তো সবাইকে বলব,আমি কেন চুল কেটেছি।
আমার একটু একটু তো খারাপ লাগছে, কিন্তু যাদের চুল নেই,অসুখের জন্য পড়ে গেছে সব,তাদের তো অনেক বেশি খারাপ লাগে।তারা অনেক বেশি ‘স্যাড’ থাকে চুল হারিয়ে। ওদের জন্য চুল পাঠাতে পেরে আমার আর খারাপ লাগছে না।আমার খুব ভাল লাগছে। আমি আমার বন্ধুদেরও বলব, ওরাও পাঠাক এরকম। আমায় বাবা বলেছে,চুল না থাকলে কেউ কম সুন্দর হয় না।”
আরও পড়ুনঃ টাটা মেডিকেল সেন্টারের উদ্যোগে ক্যান্সার স্ক্রিনিং শিবির
ঋষিকার বাবা কৌশিক চক্রবর্তীই আসলে মেয়ের এই উদ্যোগের কাণ্ডারী।পেশায় ব্যবসায়ী কৌশিক বহু বছর ধরেই নানা রকমের সমাজসেবী কাজের সঙ্গে যুক্ত।সেই সব কাজকর্ম ছোটবেলা থেকেই দেখছে আদরের তিতির।হয়তো অবচেতনে কোথাও ভালবাসা তৈরি হয়েছিল এই ধরনের কাজকর্মের প্রতি, জানালেন কৌশিক।
তিনি বললেন,“বেশ কিছু দিন আগে,মেয়ে তখন আরও অনেকটা ছোট।ওকে কথায় কথায় বলেছিলাম, ‘তোর তো এত সুন্দর চুল, তোর মতো যে সব বাচ্চাদের চুল নেই, তাদের জন্য দিবি?’ কেন চুল নেই সেটাও বুঝিয়ে দিয়েছিলাম। কতটা বুঝেছিল জানি না, কিন্তু তখনই খুব লাফিয়ে লাফিয়ে রাজি হয়েছিল।
পারলে তখনই কাটে। তার পরে ওকে বোঝালাম, অন্তত ১২ ইঞ্চি লম্বা হতে হবে। তার পর থেকে আর চুল কাটেনি ও। অপেক্ষা করে করে বাড়িয়েছে। ওকে বলেছি, চুল থাকলে ও খুব সুন্দর, কিন্তু চুল ছাড়াও কম সুন্দর নয়।”
হাসিখুশি মুখে সেলুনে গিয়ে সব চুলটা কাটিয়ে ফেলে ঋষিকা। ন্যাড়া হয়ে যায় নিজে। তার পরে নিজেই যত্ন করে প্যাকেটবন্দি করে, কেটে ফেলা চুল। তার পরে নির্দিষ্ট ঠিকানা লিখে কুরিয়ার করে ফেলার পালা।
এর পরেই গোটা ঘটনাটি ফেসবুকে পোস্ট করেন কৌশিক। কিছু ক্ষণের মধ্যেই সে পোস্ট ভাইরাল হয়ে যায় রীতিমতো। অনুপ্রেরণার আর এক নাম হয়ে ওঠে ছোট্ট ঋষিকা। ভাল কাজ করার ইচ্ছে থাকলে যে বয়সও কোনও বাধা হয় না, তার জলজ্যান্ত উদাহরণ হয়ে উঠেছে সে।
রূপ দেখে গুণ বিচারে অভ্যস্ত এই সমাজকে যেন রায়গঞ্জের ছোট্ট মেয়েটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে, ‘বড় হও সমাজ, বুকে আগুন জ্বালো, মানবিক হও,জীবনের জন্যে বাঁচো…বাঁচানোর জন্যে বাঁচো.. হাসতে হাসতে বাঁচো…!’
WhatsApp এ নিউজ পেতে জয়েন করুন আমাদের WhatsApp গ্রুপে
আপনার মতামত বা নিউজ পাঠান এই নম্বরে : +91 94745 60584