এনপিআর-এনআরসি, আদমশুমারি সংক্রান্ত কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য

0
149

নিউজফ্রন্ট, ওয়েবডেস্কঃ

সারা দেশে সিএএ-এনআরসি বিরোধী আন্দোলন যেমন সরব হয়ে উঠেছে, তাতে একটা বিষয় স্পষ্ট যে যেখানে বেকারত্ব, স্বাস্থ্য, পরিকাঠামো সংক্রান্ত অনেক বিষয়েই কাজ অসম্পূর্ণ রয়েছে, সেখানে এই সময়ে এরকম একটি বিধি সম্পূর্ণ ভাবেই অপ্রয়োজনীয়।

পাশাপাশি ধর্মের ভিত্তিতে তৈরি হওয়া কোনও বিল বা আইন এই ভাবে জনগণের উপর চাপিয়ে দেওয়া যায় না। তবুও অনেকের মনেই এনআর(আই)সি, এনপিআর, সিএএ নিয়ে প্রশ্ন ও সংশয় থেকেই গিয়েছে।

এখন প্রশ্ন হল, জাতীয় জনসংখ্যা নিবন্ধ(এনপিআর) কীভাবে সংকলিত হয়? এটি নাগরিকত্ব এবং দশক ব্যবধানে হওয়া আদমশুমারির সাথে কীভাবে সম্পর্কিত? রাজ্যগুলি কি এনপিআর প্রক্রিয়াতে সহযোগিতা প্রত্যাখ্যান করতে পারে?

এখনও পর্যন্ত কেরল ও পশ্চিমবাংলায় এনপিআর-এর প্রস্তুতি ও আপডেট সম্পর্কিত কাজ স্থগিত আছে। জানা গেছে, ২০২১-এর আদমশুমারি প্রকাশের আগেই এনপিআর তৈরির জন্য জনসংখ্যাতাত্ত্বিক ও বায়োমেট্রিক সম্পর্কিত তথ্যাদি সংগ্রহ ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে সম্পন্ন হবে।

important Information about npr and nrc | newsfront.co
প্রতীকী চিত্র

বেশ কয়েকটি রাজ্যে এনপিআর এর প্রাথমিক কাজ শুরু হয়েছে। বাংলায় নাগরিক অধিকারকর্মীরা এনপিআর সংকলনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করে বলেছেন যে এটির আদমশুমারির সাথে কোনও যোগই নেই, তবে এটি “রাজ্যের জাতীয় নাগরিক নিবন্ধনের প্রথম পদক্ষেপ”।

আরও পড়ুনঃ গ্রেফতার পরোয়ানা জারি সাংসদ-লেখক শশী থারুরের বিরুদ্ধে

নাগরিকত্ব আইন, ১৯৫৫-র ধারা ১৪-এ অনুযায়ী (যা ২০০৪ সালে সন্নিবেশিত হয়েছিল), কেন্দ্রীয় সরকার বাধ্যতামূলকভাবে ভারতের প্রতিটি নাগরিকের নিবন্ধ তৈরি করতে পারে এবং তাকে একটি জাতীয় পরিচয়পত্র প্রদান করতে পারে। এটি ভারতীয় নাগরিকদের একটি জাতীয় নিবন্ধ রক্ষণাবেক্ষণ করবে।

জাতীয় জনসংখ্যা নিবন্ধ(এনপিআর) কী?

এনপিআর হল একটি ডাটাবেস যাতে দেশে বসবাসরত সমস্ত বাসিন্দার নামের একটি তালিকা থাকবে। দশ বছর অন্তর কেন্দ্র সরকার কর্তৃক আদমশুমারিতে যে ‘ঘর তালিকা’ নির্ণয় করা হয়, এটি সেরকমই একটি প্রণালী। সর্বশেষ আদমশুমারিটি হয়েছিল ২০১১ সালে, এবং পরবর্তীটি ২০২১ সালে সম্পন্ন হওয়ার কথা। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের মতে, এবারের নির্ণয় একটি মোবাইল ফোন অ্যাপ্লিকেশনের মাধ্যমে পরিচালিত হবে।

এনপিআর-এর উদ্দেশ্যে সাধারণ বাসিন্দা হলেন এমন এক ব্যক্তি যিনি ছয় মাস বা তারও বেশি সময় ধরে কোনও জায়গায় বাস করেছেন এবং আরও ছয় মাস বা তারও বেশি সময় সেখানে বাস করতে চান।

২০১১ সালের আদমশুমারিতে ২৯ টি শূণ্যস্থান ছিল, যার মধ্যে বাসিন্দার বয়স, লিঙ্গ, বৈবাহিক অবস্থা, শিশু, পেশা, জন্মস্থান, মাতৃভাষা, ধর্ম, অক্ষমতা এবং সে কোনও তফসিলি জাতি বা উপজাতির অন্তর্ভুক্ত কিনা- সেই তথ্য পূরণেরও জায়গা ছিল। তবে এনপিআর বেসিক ডেমোগ্রাফিক ডেটা এবং বায়োমেট্রিক বিশদ বিবরণ সংগ্রহ করবে।

আরও পড়ুনঃ রাজ্যপালের অনুমতি ছাড়া স্থগিত যাদবপুরের বিশেষ সমাবর্তন, ক্ষুন্ন ধনকড়

পরিবারের প্রধানের প্রাথমিক বিবরণ গণনার দ্বারা গ্রহণ করা হলে, তাকে একটি স্বীকৃতি স্লিপ দেওয়া হবে। এই স্লিপটি এনপিআর-এর কাজের সময় প্রয়োজন হতে পারে। একবার স্থানীয় (গ্রাম বা ওয়ার্ড), উপ-জেলা (তহসিল বা তালুক), জেলা এবং রাজ্য স্তরে বিশদ রেকর্ড করা গেলে, এই স্তরের প্রত্যেকটিতে একটি জনসংখ্যার নিবন্ধ থাকবে।

এনপিআর এর আইনী ভিত্তি কী?

১৯৫৫ সালে গঠিত নাগরিকত্ব আইনের আওতাভুক্ত কিছু বিধি, নিয়ম-কানুনই হল এনপিআর। ১৯৪৫ সালে নাগরিকত্ব আইন, ১৯৫৫-এর সেকশন ১৪-এ’তে সন্নিবেশিত হয়েছিল, যাতে ভারতের প্রতিটি নাগরিকের বাধ্যতামূলক নিবন্ধকরণ এবং ‘জাতীয় পরিচয়পত্র’ প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এটি আরও বলেছে যে কেন্দ্রীয় সরকার ভারতীয় নাগরিকদের একটি জাতীয় নিবন্ধ বজায় রাখতে পারে।

আরও বলা হয়েছিল যে ভারতের রেজিস্ট্রার জেনারেল ‘জাতীয় নিবন্ধকরণ কর্তৃপক্ষ’ হিসাবে কাজ করবে। পাশাপাশি নাগরিক নিবন্ধের জেনারেল হিসাবেও কাজ করতে পারে। সেই হিসাবে দেখতে গেলে, রেজিস্ট্রার জেনারেলকে দেশের আদমশুমারী কমিশনার হিসাবেও গণ্য করা যাবে।

এনআর(আই)সি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এনপিআর ছিল প্রথম পদক্ষেপ।

এনপিআর এবং আধার এর মধ্যে কোনও যোগসূত্র আছে?

এনপিআর-এর একমাত্র লক্ষ্য ছিল সরকারের অধীনে দেশবাসীকে সুব্যবস্থা ও সমস্ত প্রয়োজনীয়তা প্রদান করা। এনপিআর তালিকাভুক্তির শুরুর দিনগুলিতে ইউনাইটেড প্রগ্রেসিভ অ্যালায়েন্স রেজিমে-র অন্তর্গত, ইউনিক আইডেন্টিফিকেশন অথরিটি অফ ইন্ডিয়া-র (ইউআইডিএআই) প্রকল্প একই সাথে চালু ছিল।

এনপিআর পরিচালিত কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক এবং ইউআইডিএআই এর মধ্যে একটি দ্বন্দ্ব হয়েছিল, কারণ এই দুই বডিরই কাজ ছিল ব্যক্তিবিশেষে তথ্য ও বায়োমেট্রিক ডেটা সংগ্রহ। ফলত একই কাজ দুটি বডি আলাদা আলাদা করে করেছিল।

শেষ পর্যন্ত, তারা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিল যে উভয় ডাটাবেসই বিভিন্ন উদ্দেশ্য নিয়ে উপস্থিত থাকবে এবং প্রত্যেকে অন্যের বায়োমেট্রিক ডেটা ব্যবহার করবে।

আরও পড়ুনঃ ঝাড়খন্ডে এক্সিট পোলের অনুমানে বিজেপিকে টক্কর দেবে জেএমএম-কংগ্রেস জোট

ইতিমধ্যে জানানো হয়েছিল যে আধার এর জন্য নিবন্ধিতদের এনপিআর চলাকালীন তাদের বায়োমেট্রিক বিশদ দেওয়ার দরকার নেই। একই সময়ে, এনপিআর এর জন্য নেওয়া ডেটা ইউআইডিএআই তে ‘ডি-ডুপ্লিকেশন’ এর জন্য প্রেরণ করা হবে। আধার এবং এনপিআর ডেটাগুলির মধ্যে অমিল থাকার জন্য, সার্বিক ভাবে ভবিষ্যতে এনপিআর কার্যকরী হবে। আসলে বর্তমান সরকার, ২০১১ সালের আদমশুমারির পরে তৈরি এনপিআর, এখন আপডেট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

এনপিআর সংকলনের পরে কী হবে?

ভারতের সাধারণ বাসিন্দাদের একটি তালিকা সরকার তৈরি করবে। স্থানীয়, উপ-জেলা, জেলা ও রাজ্য স্তরে বাসিন্দাদের নাগরিকত্বের অবস্থা যাচাই করার পরে এনআর(আই)সি প্রস্তুত করা হবে।

নাগরিকত্ব (নাগরিক নিবন্ধকরণ এবং জাতীয় পরিচয়পত্রের ইস্যু) বিধিমালা, ২০০৩ সালে সকল নাগরিকের নিবন্ধ এবং তাদের জাতীয় পরিচয়পত্র প্রদানের ধারণাকে বাস্তবায়নের বিধিবিধানকে বর্ণিত করে। তবে, এখনও পর্যন্ত জাতীয় পরিচয়পত্র প্রবর্তনের বিষয়ে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি।

আরও পড়ুনঃ সিএএ-র সমর্থনে দিলীপ ঘোষের নেতৃত্বে বাঁকুড়ায় মিছিল

বিধি অনুসারে জনসংখ্যা নিবন্ধে প্রাপ্ত প্রতিটি পরিবার এবং স্বতন্ত্র ব্যক্তির বিবরণ স্থানীয় নিবন্ধকের দ্বারা যাচাই-বাছাই করা হবে। প্রক্রিয়াটিতে, ‘যাদের নাগরিকত্ব সন্দেহজনক’ তাদের বিশদটি যাচাই করা হবে। পরিবার বা স্বতন্ত্র ব্যক্তিদের এ সম্পর্কে অবহিত করা হবে এবং তাদের এনআর(আই)সি থেকে বাদ দেওয়ার বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে উপ-জেলা বা নাগরিক নিবন্ধের তালুক রেজিস্ট্রার শুনানির সুযোগ পাবেন। ৯০ দিনের মধ্যে এই সকল বিষয় সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

এই পদক্ষেপের পরেই কি এনআর(আই)সি প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হবে?

না। অন্তর্ভুক্তি বা সংশোধনের জন্য আপত্তি বা দাবির আমন্ত্রণ জানাতে স্থানীয় নাগরিকদের, স্থানীয় নিবন্ধের একটি খসড়া প্রকাশ করতে হবে।

অন্তর্ভুক্তির জন্য যে কোনও আপত্তি বা অনুরোধ, খসড়া প্রকাশের ৩০ দিনের মধ্যে করতে হবে। উপ-জেলা বা তালুক রেজিস্ট্রার সংক্ষিপ্তভাবে ৯০ দিনের মধ্যে আপত্তিগুলি নিষ্পত্তি করবেন। এরপরে স্থানীয় রেজিস্ট্রারে প্রবেশকারীদের জাতীয় নিবন্ধকের নিকট স্থানান্তর করা হবে।

আরও পড়ুনঃ তৃণমূল কর্মীর উপর বিজেপি-র আক্রমণের প্রতিবাদে মিছিল

বহির্ভূত আদেশে আক্রান্ত যে কোনও ব্যক্তি ৩০ দিনের মধ্যে জেলা রেজিস্ট্রারের কাছে আবেদন করতে পারেন, এবং আবেদনটি ৯০ দিনের মধ্যে নিষ্পত্তি করতে হবে। যদি আপিল সফল হয় তবে সংশ্লিষ্টদের নাম এনআর(আই)সি-তে যুক্ত করা হবে।

নাগরিকত্ব প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করবে এমন নথিগুলি কী কী?

সরকার এখনও এনআর(আই)সি তৈরির জন্য কোনও তারিখ উল্লেখ করেনি। নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্যগুলির এখনও কোনও বিধিবিধান নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়নি। সরকার বলছে যে কোনও দলিল যা জন্ম তারিখ বা জন্মের স্থান বা উভয়ই পেশ করে এমন তথ্য এক্ষেত্রে যথেষ্ট হবে। পাশাপাশি এই ধরনের দলিলগুলি প্রস্তুত করতে অক্ষম ব্যক্তিরা সম্প্রদায়ের সদস্যদের দ্বারা সমর্থিত সাক্ষী বা অন্য কোনও প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারে।

অনেক রাজ্য সরকার বলছে যে তাদের রাজ্যে এনপিআর কার্যকর হবে না। এটা কি সম্ভব?

এখন পর্যন্ত এটি একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। কেরল এবং পশ্চিমবঙ্গ এখনও পর্যন্ত এনপিআর সংক্রান্ত কাজ স্থগিত রেখেছে। বেশিরভাগ রাজ্য সরকার, এনপিআর আপডেট করার কাজ শুরু করার বিষয়টি কেন্দ্রীয় সরকারের বিজ্ঞপ্তি পাওয়ার পরেই শুরু করবে।

যেহেতু ঘরে ঘরে আদমশুমারি পরিচালনার কাজটি পরিচালনা করতে রাজ্য সরকারের অধীনে কর্মী মোতায়েনের প্রয়োজন, তাই রাজ্য সরকারের প্রস্তুতি ব্যতীত এনপিআর প্রক্রিয়াটি এগিয়ে যেতে পারে না। এদিকে আইনি কার্যক্রম হিসাবে, কেন্দ্রের আদমশুমারির দায়িত্বে থাকাকালীন, রাজ্য সরকারগুলি প্রয়োজন অনুসারে কর্মচারী সরবরাহ করবে বলে আশা করা হচ্ছে।

আরও পড়ুনঃ সুপ্রিম কোর্টের দাবি ১৪৪-র অধীনে স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ খুব লঘু হওয়া অসমীচীন

১৯৯৪ সালের আদমশুমারির আইনের ধারা ৪ এ বলা হয়েছে, কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক লিখিত আদেশ বা এই কাজে সরকার কর্তৃক নিযুক্ত কোনও কর্তৃপক্ষের নির্দেশে রাজ্য সরকারের কর্মীদের আদমশুমারি গণনার কাজে অগ্রসর হতে হবে।

পাশাপাশি, নাগরিকত্বের ৫ নং বিধি (নাগরিকদের নিবন্ধন এবং জাতীয় পরিচয়পত্রের ইস্যু) ২০০৩ এর বিধান অনুযায়ী, “কেন্দ্রীয় সরকার, রাজ্য সরকার, স্থানীয় সংস্থা বা তাদের উদ্যোগের প্রতিটি কর্মকর্তা নাগরিক নিবন্ধের রেজিস্ট্রার জেনারেলকে সহায়তা করবেন বা তাঁর পক্ষে অনুমোদিত যে কোনও ব্যক্তি, প্রতিটি পরিবার এবং প্রত্যেক ব্যক্তির সাথে সম্পর্কিত ডেটাবেস প্রস্তুত করতে এই বিধি বাস্তবায়নে সহায়তা করবেন।”

আরও পড়ুনঃ উত্তরপ্রদেশে সিএএ বিরোধী বিক্ষোভে নিহত ৭

ব্যবহারিক দিক দিয়ে বলা বাহুল্য, স্থানীয় পর্যায়ে রাজ্য সরকারের সহযোগিতা ব্যতীত এই প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণ সম্ভব নয়।

এনপিআর এবং নাগরিকত্ব সংশোধন আইনের মধ্যে কী সম্পর্ক?

এদের মধ্যে সরাসরি কোনও সম্পর্ক নেই। তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মন্তব্য যে সিএএ-র পরে এনআরসি অনুসরণ করা হবে। এখন বিষয় হল, সিএএ একটি মুসলিম বিরোধী আইন। তাই সিএএ লাগু হলে অনেক মুসলিমকেই ঘর ছাড়া হতে হবে এবং তারা জাতীয় নাগরিক নিবন্ধের তালিকা থেকে বাদ পড়বে।

নিউজফ্রন্ট এর ফেসবুক পেজে লাইক দিতে এখানে ক্লিক করুন
WhatsApp এ নিউজ পেতে জয়েন করুন আমাদের WhatsApp গ্রুপে
আপনার মতামত বা নিউজ পাঠান এই নম্বরে : +91 94745 60584

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here