সুমনা দত্ত
আবিশ্ব মানব সভ্যতায় সর্বাপেক্ষা সম্মানীয় ও মহান শব্দবন্ধটি হল মাতৃত্ব – যা চিরন্তন, ধ্রুব ও অক্ষয়। মালিন্যহীন, বড় পবিত্র, শুদ্ধ, অকলঙ্ক।
এ যাবৎকাল যত সাহিত্য, গান, গাথা, কবিতা, নাটক, গল্প রচিত হয়েছে, ছবি অঙ্কিত হয়েছে, ভাস্কর্য খোদিত হয়েছে, তার সিংহভাগ জুড়ে আছে এই মাতৃত্বের বন্দনা। এই মাতৃত্বকে মানব সমাজ সর্বদাই বড় বেশী করে মহিমান্বিত করেছে।
তৈরী করেছে “মাদার কাল্ট”। মাতৃত্বের ভাবনাটি এত শক্তিশালী হয়ে উঠতে থাকে যার সামনে মাথা নামায় তাবৎ মনুষ্যজাতি। এত উচ্চ পরিমানে মহানতা, পবিত্রতা, সম্মান, কর্তব্যদায় আর কোন সম্পর্কের ওপর মানবসভ্যতা আরোপন করেনি।
আর এই মাতৃত্বই পরিবর্তিত হয়ে দেবীত্বে উত্তীর্ণ হয়। এই মাতৃরূপটি মানব মানসে এত অমোঘ, এত তীব্র, এত সম্মোহনময় যে তার নাগপাশ হতে কারোর মুক্তি ঘটে না। মাতৃরূপ কল্পনাতো এই মাতৃ বন্দনারাই একটি শক্তিশালী অংশ।
মাতৃবন্দনার পথ ধরেই তার আবির্ভাব ঘটে। এই কারণে মানব সংস্কৃতিতে মাতৃরূপ কল্পনার ইতিহাস যেমন বৈচিত্রময় তেমনই সুপ্রাচীন। সেই প্রাক-ঐতিহাসিক কালেই সারা পৃথিবী জুড়ে নির্মিত হয়েছিল মাতৃরূপা পুতুলগুলি। এই আদিমাতা পুত্তলিকাগুলিকে ঐতিহাসিকরা ভিনাস নামে চিহ্নিত করেছে।
আরও পড়ুনঃ কন্যা রুপে পূজিতা হন পিংবনীর মল্লিক বাড়ির দুর্গা
হোমো-স্যাপিয়ান্স মানবগোষ্ঠী তাদের আদিভূমি আফ্রিকা হতে ইউরোপে প্রবেশ করে ও নিয়াডারথাল মানুষের কৃষ্টিকে অপসারিত করে এক নতুন কৃষ্টির সূচনা করে। আনুমানিক ৪০,০০০ বছর পূর্ব হতেই এই নতুন প্রত্নপোলীয় মানবকৃষ্টিতে আদিমাতা পুত্তলিকাগুলির আবির্ভাব ঘটে।
দক্ষিণ-পশ্চিম জার্মানির সয়াবিয়ান (Swabian Jura) অঞ্চলে ২০০৮ খৃষ্টাব্দে একটি খননকার্যের ফলে বহু প্রত্নবস্তু পাওয়া যায় যা অরগনেশিয় যুগের সংস্কৃতি ও কৃষ্টির বৈচিত্রময় সম্ভারকে আধুনিক মানুষের কাছে উন্মুক্ত করে দেয়।
প্রত্নতত্ত্ববিদ নিকোলাস যেখানে যে কনার্ডের নেতৃত্বে হোহল ফেলস গুহায় খননকার্য্য চালানোর সময় প্রত্নতত্ত্ববিদদের হাতে ম্যামথের দাঁতে নির্মিত একটি ক্ষুদ্রকায় নারী ভাস্কর্যের কিছু ভগ্ন টুকরো।
ভগ্ন অংশগুলি স্বযত্নে জোড়া লাগানোর পর হোহল ফেলস ভিনাসের বর্তমান রূপটি ফিরে পাওয়া সম্ভব হয়। এ যাবৎকাল প্রাপ্ত আদিমাতৃকা মূর্তিগুলির মধ্যে এটি প্রাচীনতমা।
আমাদের এই প্রমাতামহীর বয়স ৩৮,০০০ থেকে ৩৩,০০০ খৃঃ পূঃ।
গঠনগতভাবে বিচার করলে এই আদি মাতৃমূর্তিগুলির মধ্যে কিছু সাধারণ চরিত্র বিদ্যমান। এগুলির প্রত্যেকটি ক্ষুদ্র আকার বিশিষ্ট – ১.৫ ইঞ্চি থেকে ৪.৮ ইঞ্চির মধ্যে সীমিত। এরা নগ্না, এদের মুখাবয়ব, হস্ত ও পদযুগল অনুপুঙ্খ বর্জিত প্রায় বিমূর্ত, অসম্পূর্ণ বা গুরুত্বহীন।
সন্তানদানের সহায়ক কেবল মাত্র মাতৃ অঙ্গগুলি বড় বেশী স্ফীত ও প্রকটভাবে প্রকাশ করার জন্য মনে হয় এই আদিমাতারা সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র মাত্র।
প্রত্নপ্রস্তর যুগে সারা পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে এতো নগ্নিকা মাতৃকা মূর্তির উপস্থিতি দেখে অনুমান করা যায় সম্ভবত এই মাতৃ নগ্নতা ছিল সেই সময়কালের প্রেক্ষিতে অত্যন্ত স্বাভাবিক। আদিম শিল্পীরা নারীদের নিছক যৌনতা প্রকাশকারী নগ্নতা নয় বরং একটি শুদ্ধ জননী আর্কিটাইপ নির্মাণের প্রয়াসে কেবল সন্তান দানে সাহায্যকারী নারী অঙ্গগুলিকে প্রাধান্য দিয়ে এই জননীরূপটি তৈরী করেছে।
আরও পড়ুনঃ গান্ধী ভাবনার বিবর্তন
প্রাগৈতিহাসিক সমাজে যে নারীরা বহু সন্তানের জন্ম দিতে পারবে তারাই আদিমাতারূপে আদরণীয়া ও সম্মানিতা হয়েছে। তাই প্রাগৈতিহাসিক যুগে যে আদি মাতারা আবির্ভূতা হয়েছিল তারা অধিকাংশই পরিণত, মধ্যবয়স্কা, মেদ বহুল, গর্ভভারযুক্ত, বহু সন্তানের জন্মদানের কারণে শিথিল স্তনা ও গুরুনিতম্বিনী।
এখনও পর্যন্ত প্রত্নতত্ত্ববিদরা সারা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের বিস্তৃত অঞ্চল থেকে ২৫০টিরও বেশী এই ধরণের প্রাগৈতিহাসিক আদিমাতৃকা মূর্তি খুঁজে পেয়েছেন।
সময়সারণীতে এই মাতৃমূর্তিগুলিকে স্থাপন করলে বিস্মিত হতে হয় যে কতখানি বিস্তৃত সময়কালের ব্যাপ্তি জুড়ে এই আদিমাতা মূর্তিগুলিকে নির্মাণ করা হয়েছিল। হাজার লক্ষ মাইল অঞ্চলভেদে এতখানি সময়কালের সীমা জুড়ে, একই আর্কিটাইপ অনুসরণ করে একই ধরণের মাতৃকা মূর্তি তৈরী হওয়া সংস্কৃতির ইতিহাসে বিরল।
নব্যপ্রস্তর যুগে পশুকে পোষ মানানো ও কৃষির উদ্ভাবন মানব সংস্কৃতিতে এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা যা মানুষ এবং পৃথিবীর পূর্বতন সম্পর্কটিকে সম্পূর্ণরূপে পরিবর্তিত করে দেয়। পুরাপ্রস্তর যুগে মানুষের বিশ্বাস ছিল বাস্তব আবর্তিত। অলৌকিকতার ধারণা তাদের ছিল না।
যে জাদু ধারণায় তারা বিশ্বাস করতো তা বাস্তবেরই সম্প্রসারণ। কিন্তু নব্যপ্রস্তর যুগের মানুষরা লৌকিক বাস্তব জগতের সমান্তরালে এক অলৌকিক অতিপ্রাকৃত জগতের কল্পনা করেছিল। তাদের চেতনা ছিল দ্বিস্তরীয় – বাস্তবভৌত জগৎ ও পরাবাস্তব অতিপ্রাকৃত জগৎ। মানুষের চেতনার এই দ্বিতীয় স্তরেই জন্ম নেয় ধর্মবিশ্বাস।
কল্পনা করা হতে থাকে নানা দেবদেবী, ভুতপ্রেত, শুভ অশুভ আত্মা, স্বর্গ ও নরক। দেবদেবীদের ওপর সংযোজিত নানা অলৌকিক গুণাবলী তাদেরকে সাধারণ মানুষ থেকে পৃথক করে তোলে এবং মহানতা দান করে।
সভ্যতার সম্প্রসারণের সঙ্গে সঙ্গে মাতৃকাশক্তির রূপকল্পনা আরো শক্তিশালী হয়ে ওঠে। আবির্ভূতা হন নানা মাতৃকামূর্তি বিবিধ দৈব ও অলৌকিক ক্ষমতা সহ। এই মাতৃকাদেবীরা পূজিত হতে থাকেন সারা পৃথিবী জুড়ে। ভারতবর্ষও তার ব্যাতিক্রম নয়।
তেত্রিশ কোটি দেবদেবীর মধ্যে প্রথম সারিতেই এই মাতৃকাশক্তিরা অবস্থান করছেন। আজকে সকল পূজ্য দেবীদের প্রপিতামহী হলেন সেই আদি মাতারা যারা সুদূর আদিম ধর্মপূর্বযুগে মানব সংস্কৃতিতে অভিনন্দিতা হয়েছিলেন নতুন মানবপ্রাণ সৃষ্টির কারণে।
WhatsApp এ নিউজ পেতে জয়েন করুন আমাদের WhatsApp গ্রুপে
আপনার মতামত বা নিউজ পাঠান এই নম্বরে : +91 94745 60584