অমিতাভ চক্রবর্তী
রাঙা নদীর তীরে, স্বপ্ন রথে, কী কথা রেখে গেছো আমার জন্য?
উপেক্ষা…অপমান…নাকি রক্তের চলাচল…!
এই নদীর জল আমার কৈশোরের সহচরী।
ও নদী… আর কত সুখ তুমি দিতে পার আমায়! এর চেয়ে বেশী সুখী হয় কি মানুষ…
অদ্বৈত মল্লবর্মণের ‘ তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসের চলচ্চিত্রায়ণ করলেন ঋত্বিক ঘটক ১৯৭৩ সালে।এই ছবির নির্মান প্রসঙ্গে ঋত্বিক বলেন – ” তিতাস পূর্ব বাংলার একটি খন্ড জীবন। এটি একটি সৎ লেখা। ইদানিং সচরাচর বাংলাদেশে ( দুই বাংলা মিলিত ভাবে) এ রকম লেখার দেখা পাওয়া যায়না। এর মধ্যে আছে প্রচুর নাটকীয় উপাদান। আছে দর্শনধারী ঘটনাবলী, আছে শ্রোতব্য বহু প্রাচীন সঙ্গীতের টুকরো, – সব মিলিয়ে এক অনাবিল আনন্দ ও অভিজ্ঞতার সৃষ্টি করা যায়। ব্যাপারটা জন্ম থেকেই কাঁদছিল।অদ্বৈতবাবু অনেক অতিকথন করেন। কিন্তু লেখাটা একেবারে প্রাণ থেকে। ভেতর থেকে লেখা। আমি নিজেও ওর চোখ দিয়ে না দেখে ওইভাবে ভেতর থেকে দেখার চেষ্টা করেছি। অদ্বৈতবাবু যে সময়ে তিতাস দেখেছেন তখন তিতাস ও তার তীরবর্তী গ্রামীন সভ্যতা মরতে বসেছে। তিনি এরপরের পূনর্জন্ম টা দেখতে যান নি। আমি দেখাতে চাই যে মৃত্যুর পরেও এই পূনর্জন্ম টা হচ্ছে। তিতাস এখন আবার যৌবনবতী। আমার ছবিতে গ্রাম নায়ক আর তিতাস নায়িকা।”
১৯৭২ এর মার্চ মাসে শ্যুটিং শুরু করেন ঋত্বিক। আর ছবির শ্যুটিং শেষ হয় ১৯৭৩ এর জুন মাসে। ছবিটি প্রথমে বাংলাদেশেই মুক্তি পায় যেহেতু বাংলা দেশের প্রযোজনা এটি। এর পর ১৯৯১ সালের ১১ মে কলকাতায় মুক্তি পায় ছবিটি।
সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয় ১৯৭৩ সালে। আওয়ামী লিগের জয় জয়াকার চারিদিকে। যুদ্ধ পরবর্তী অস্থিতিশীলতা তখনো সম্পূর্ণ মেটেনি। বাংলাদেশ প্রথম রাষ্ট্রপতি পেয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমনকে। এদিকে আমেরিকার প্রথম স্পেশ স্টেশন স্কাইল্যাব তখন সদ্য মাথার ওপরে। মানুষ রাত হলে আকাশের দিকে তাকায় যদি একবার দেখা যায় এই আশায়। গ্র্যামিতে জর্জ হ্যারিসন, বব ডিলান, রবি শঙ্করের ” কনসার্ট ফর বাংলাদেশ” সেরা অ্যালবাম নির্বাচিত হয়েছে। ১৯৭২ এ মুক্তি প্রাপ্ত ” দ্য গডফাদার ” এর রেশ তখনো কাটেনি মানুষের। এদিকে নেটিভ অ্যামেরিকানদের ওপর ইউ.এস গভর্ণমেন্টের ব্যবহারে বিরক্ত হয়ে মার্লন ব্র্যান্ডো অস্কারের সেরা অভিনেতার পুরস্কার নিতে অস্বীকার করলেন। ১৯৭৩ এ মুক্তি পেল – ” The Sting” , ” Papillon, ” American Graffiti”, ” The Exorcist”এবং মুক্তি পেলো ঋত্বিক ঘটকের ” তিতাস একটি নদীর নাম”।
“তিতাস একটি নদীর নাম। তার কূলজোড়া জল, বুকভরা ঢেউ, প্রাণভরা উচ্ছ্বাস। স্বপ্নের ছন্দে সে বহিয়া যায়। ভোরের হাওয়ায় তার তন্দ্রা ভাঙে। দিনের সূর্য তাকে তাতায়; রাতে চাঁদ ও তারারা তাকে নিয়ে ঘুম পাড়াইতে বসে কিন্তু পারেনা…”
সেই সময় ঋত্বিক ঘটক চাইছিলেন ” পদ্মা নদীর মাঝি ” নিয়ে ছবি করতে বাংলাদেশে এসে। চিত্রনাট্যও তৈরী ছিলো। সেই সময় তরুন মুক্তি যোদ্ধা হাবিবুর রহমন খান, যিনি ঋত্বিকের এক অনুগত অনুরাগীও, চাইছিলেন তার প্রযোজনায় ঋত্বিক বাংলাদেশে এসে একটা ছবি করুন। অবশ্য তার একটা শর্ত ছিলো, ছবির সকল শিল্পী, কলাকুশলী হবে বাংলাদেশের।
ঋত্বিক সেই শর্ত মেনে ঢাকায় এলেন পদ্মা নদীর মাঝি নির্মানের পরিকল্পনা নিয়ে।
বাংলাদেশে এসে ঘটনা চক্রে তার হাতে চলে আসে অদ্বৈত মল্লবর্মনের ” তিতাস একটি নদীর নাম” উপন্যাসটি। তিনি পড়ে এতটাই অভিভূত হলেন যে তৎক্ষণাৎ পদ্মা নদীর মাঝি র পরিবর্তে তিতাস নিয়ে ছবি করবেন বলে মনোস্থির করে ফেলেন।
ঋত্বিকের কথায় ” আমি পদ্মা ছেড়ে তিতাসে চলে গেলাম।” বোনের বাড়ীতে থেকে পুরো উপন্যাস্টা পড়ে ফেলা আর তারপর কাগজের অভাবে বোনের সাদা শাড়ীতে তিতাসের খশড়া চিত্রনাট্য লিখে ফেলা…
ঋত্বিক আসলে অদ্বৈতের তিতাসে মিশে গিয়েছিলেন। তাই উপন্যাসের প্রতি সততা ও বিশ্বস্ততা তিনি কোনমতেই ভাঙতে চাননি। অদ্বৈত মল্লবর্মনের তিতাস কে সেলুলয়েডে আঁকতে পারবেন কিনা, সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের উত্তরে ঋত্বিক ঘটক বলেছিলেন, – ” কাজটা খুব কঠিন। তিতাসের পাড়ে পাড়ে গড়ে ওঠা জেলেদের সমাজ সংস্কৃতি, ওদের হাসি কান্না, সুখ দুঃখকে অদ্বৈত মল্লবর্মন যত আপনার করে বুঝতে পেরেছিলেন আর কারো পক্ষে তা সম্ভব নয়। তবু তার সমগ্র উপন্যাসটা পড়ে আমার মনে হয় মল্লবর্মনের মূল বক্তব্যকে আমি বুঝতে পেরেছি। আমি তার ই ছবি তুলবো। সে বিশ্বাস আমার আছে।”
এই চলচ্চিত্র যে উপন্যাসের মুল বক্তব্যকে পরিপূর্ণ করেছে তাতে বিতর্কের কোন অবকাশ নেই। বরং এক ধাপ এগিয়ে ঋত্বিক এই ছবিতে পরিষ্কার বুঝিয়ে দিয়েছেন যে সভ্যতার মৃত্যু নেই। দেখাতে চেয়েছেন শুকিয়ে যাওয়া নদীর পাড়ের ধান ক্ষেত ঘিরেই গড়ে উঠতে পারে আরো একটি সভ্যতা। অথবা জলের ক্ষীন ধারা থেকে তৈরী হতে পারে আর একটি নদীর।
ঋত্বিক এই ছবি নির্মানের পক্ষে তার বিশ্বাস প্রসঙ্গে বলেছেন, – ” সভ্যতা পরিবর্তিত হয় কিন্তু সভ্যতা চিরদিনের। সভ্যতার মৃত্যু নেই। মানুষ অমর কিন্তু ইন্ডিভিজুয়াল মানুষ মরণশীল। সে একটা ধাপ থেকে আরেকটা ধাপে গিয়ে পৌঁছোয়। সেই কথাটাই বলার চেষ্টা করেছি।”
মাঘ মাসে মালোপাড়ার কুমারী মেয়েরা তাদের বিয়ের উদ্দেশ্যে যে ব্রত উৎসব পালন করে তার নাম ‘ মাঘ মন্ডলের ব্রত’। এই ব্রত পুজোয় কুমারীরা আনকোরা শাড়ী অঙ্গে তুলে, মাথার চুল তেলে জবজবে করে ভিজিয়ে, পরিপাটি করে আঁচড়ে নদীতে আসে। তাদের মাথার ওপর দুলতে থাকে চিত্র বিচিত্র চৌয়ারি। মেয়েরা নদীর পাড়ে এসে একে একে নিজেদের নির্দিষ্ট চিহ্নিত চৌয়ারি গুলো জলে ভাসিয়ে দেয়।
তখন মালো পাড়ার ছেলের দল ভাসমান চৌয়ারিগুলো ধরবার জন্য জলে ঝাঁপ দেয়। তারপর সেগুলো কেড়ে নিজের হাতে রাখার জন্য শুরু হয় প্রতিযোগিতা। মেয়েরাও চায় তাদের চৌয়ারিগুলো পাওয়ার জন্য ছেলেরা কাড়াকাড়ি করুক। তাদের মতে ছেলেরাই যদি ধরতে না পড়লো তবে চৌয়ারি ভাসাবার সার্থকতা কোথায়?
প্রত্যেক পরিচালকেরই তার ছবির গল্প বা বিষয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে নিজস্ব মতামত থাকে। পদ্মা নদীর মাঝির পরিবর্তে তিতাস বানানোর পিছনেও ঋত্বিক ঘটকের জোড়ালো যুক্তি ছিলো। তিনি বলেছিলেন – ” তিতাস আমার স্বপ্ন। আমাকে ছাড়া তিতাস তৈরী হতোনা। আমার মত মমতা দিয়ে এ কাহিনী কে কেউ তুলে ধরতে আগ্রহী হতোনা ” এই রকম দম্ভ নিয়ে কথা একমাত্র তিনিই বলতে পারেন। এর পরে তিনি আত্মসমীক্ষাও করেন তিতাসকে নিয়ে -“আমি বোধ হয় এই ছবিখান অনেক আগেই বানিয়ে ফেললাম। আমার ছবি সময়োপযোগী হয়নি।”
তিতাস যে কতখানি ঋত্বিকের আত্মার সঙ্গে জড়িয়ে ছিলো আর একটি ঘটনা না বললে বাকী থেকে যায়। এই ছবির সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন ওস্তাদ বাহাদূর খান। উনি টাইটেলের জন্য যে কম্পোজিশান তৈরী করেন সেটা ঋত্বিকের একেবারেই পছন্দ হয়নি। তিতাসে অন্যতম সঙ্গীত পরিচালক ওয়াহিদূল হক বলেন – ” বাহাদুর হোসেন খান টাইটেলের জন্য যে সঙ্গীত কম্পোজ করেন তা পাশ্চাত্য প্রভাবিত এবং ছবির থীম ও আবহের সঙ্গে সঙ্গতিহীন।
আরও পড়ুনঃ কালি পুজো উপলক্ষে কসকো ক্লাবের খুঁটি পুজো
ঋত্বিক ঘটকের একেবারেই পছন্দ হয়নি। এর পর ঋত্বিক নিজের দায়িত্বে আচিরাঘাটের এক ৯৫ বছরের বৃদ্ধ কে দিয়ে দুটো গান রেকর্ড করান। সঙ্গে দোতারা বাজান ওই বৃদ্ধের ই ভাইয়ের ছেলে। বৃদ্ধের প্রথম গাওয়া গান টি তিতাসের বিশাল ফ্রেমে টাইটেল মিউজিক হিসেবেই শুধু ব্যবহৃত হয়নি, ছবির সঙ্গীত কাঠামোকেও নিয়ন্ত্রন করেছিল।”
WhatsApp এ নিউজ পেতে জয়েন করুন আমাদের WhatsApp গ্রুপে
আপনার মতামত বা নিউজ পাঠান এই নম্বরে : +91 94745 60584