ঐতিহ্যের পাশাপাশি রক্তদানের মধ্যে দিয়ে গোয়ালতোড়ের কোলে বাড়িতে অনুষ্ঠিত দুর্গাপুজো

0
129

নিজস্ব সংবাদদাতা, পশ্চিম মেদিনীপুরঃ

Traditional Durga puja of kole family | newsfront.co
নিজস্ব চিত্র

শিশির জল, ঝর্ণার জল, দুই কুলের মাটি দিয়েই দুর্গাপূজার তিন দিন নিয়ম করে কোলে বাড়ির দুর্গাকে স্নান করানো হয়। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার গোয়ালতোড়ের মঙ্গলপাড়াতে কোলে বাড়ির দুর্গা পুজো এই বছর ২৫১ বৎসরে পড়ল।

Traditional Durga puja of kole family | newsfront.co
দুর্গা প্রতিমা।নিজস্ব চিত্র

আজ থেকে প্রায় তিনশ বছর আগের কথা। মঙ্গলপাড়ার বিখ্যাত চাষী ছিলেন গয়ারাম কোলে। যিনি প্রচুর জমির মালিক ছিলেন। গয়ারামের কনিষ্ঠ পুত্র নবীনও বাবার সঙ্গে চাষের কাজে সহযোগিতা করতেন। চাষের ধান সমস্ত ঝাড়ায় মাড়ায় করে হামারে ভর্তি করে রেখে দিতেন। আর সময়ে সময়ে হামার থেকে ধান বের করে ব্যবহার করতেন। এমনই এক বছর। দুর্গা পুজোর কয়েকদিন মাত্র বাকি৷ একদিন নবীন কোলে হামার থেকে ধান পাড়তে গিয়ে দেখেন হামার যেন সোনার দ্যুতিতে জ্বলজ্বল করছে। ভয় মিশ্রিত পায়ে পায়ে হামারের দরজা খুলতেই যেন চোখ ঝলসে যায় নবীনের। হারিয়ে ফেলেন জ্ঞান। সেই অজ্ঞান অবস্থায় মা দুর্গা স্বয়ং তাকে স্বপ্নে দেখা দিয়ে তার আরাধনার কথা জানান।

Traditional Durga puja of kole family | newsfront.co
কোলে পরিবারের বর্তমান সদস্য। নিজস্ব চিত্র

তারপর জ্ঞান ফিরে পেয়েই তিনি তোড়জোড় করেন পুজোর। কিন্তু পুজোর আর সময় নেই। তাড়াহুড়ো করেই ছুতার ডেকে ঠাকুর তৈরির কাজ শুরু করান।

তারপর নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে বৈষ্ণবী মতে পুজো করেন নবীন কোলে। নবীন কোলের আরম্ভ করা পুজো এখনো কোলে পরিবারে সাড়ম্বরে পালিত হয়ে আসছে। মাঝে খুব জাঁকজমক ভাবেই পুজো হতো। তারপর কালের নিয়মে প্রচুর জমির মালিক থেকে জমিদার হয়ে উঠা কোলে পরিবারও ধীরে ধীরে ক্ষয়িষ্ণু হতে আরম্ভ করে। ফলে কমেছে পুজোর আড়ম্বরতা। কিন্তু নিষ্ঠা এবং ভক্তি এখনো অটুট৷

দীর্ঘ ৪০ বৎসর ধরে মায়ের ব্রতী থাকা পাঁচুগোপাল কোলে জানান, “একই ফ্রেমে দুর্গার সঙ্গে কার্তিক, গণেশ, লক্ষ্মী সরস্বতী বিরাজমান। দুর্গার দুই দাসী দুদিকে থাকেন৷ পাঁজিপুঁথি মিলিয়ে নিয়ম মাফিক পুর্বপুরুষের নিয়মানুযায়ী এখনো পুজোর আয়োজন করা হয়। দুর্গাকে পুজোর তিন দিন নদীর উভয় কুলের মাটি, শিশিরের জল, ঝর্ণার জল, আকাশের জল মিশিয়ে তাতে স্নান করানো হয়। স্নানের পর বেল পাতার মালা, দুর্বা ঘাসের মালা, আর ফুলের মালা পরিয়ে পুজো শুরু হয়”। আর পুজোর ফুলের সঙ্গে আমলা আর ঘলঘসি চাই চাই৷

কোলে বাড়ির দুর্গা পুজো আদতে কোলে পরিবারের মিলন মেলা। বর্তমানে মঙ্গলপাড়াতে ১৮-২০ টি পরিবার থাকলেও বিভিন্ন এলাকায় এমন কি রাজ্যের বাইরেও অনেকেই স্থায়ীভাবে বসবাস করেন৷ কিন্তু পুজোর কটা দিন যে যেখানেই থাকুন না কেন একত্রে মিলিত হন৷ চলে একসঙ্গে খাওয়াদাওয়া। বাতের রোগে কাবু ৮০ বৎসরের বৃদ্ধা গীতা কোলে সহ শক্তিরাণী কোলে, নির্মলা কোলে, সন্ধ্যা কোলেরা বয়সের ভারে কাবু হয়ে পড়লেও পুজোর একমাস আগের থেকেই তাদের তৎপরতা শুরু হয়ে যায়। কাজ করার সামর্থ না থাকলেই বাড়ির অন্যান্য মিহিলাদের বলিয়ে কয়িয়ে সুনিপুণ ভাবে কাজ করিয়ে নেন৷ গীতা রানী বলেন, এক সময় আমারা হাজার হাজার তিলের, নারকেলের, মুড়কির নাড়ু বানাতাম। কিন্তু এখিন আর পারি না, এই নাড়ু তৈরির কাজ বৌমারা সককে মিলে করে৷ তবে পুজোর সময় সকলের সাথে সমান তালে সার্মথ্য অনুযায়ী কাজে লেগে পড়েন তারা।

সেই কবে নবীন কোলের তৈরি করা দুর্গা মন্ডপে আজও পুজিতা হন মা। কালের নিয়মে সেই মাটির দেওয়াল আর খড়ের চালের মন্ডপে কিছু পরিবর্তন এসেছে৷ খড়ের বদলে চেপেছে টিন। মন্দিরটি একটু উঁচু করে সংস্কার করা হয়েছে৷ বসেছে লোহার দরজা৷ তবে মন্দিরটি পুনরায় সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে বলে জানালেন কোলে পরিবারের সদস্যরা৷

প্রতিমা কারিগর, বাজনদার, পুজক সকলেই বংশানুক্রমিক ভাবে এখানে মায়ের পুজোর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে। কথিত আছে মৃৎশিল্পী ক্ষুদিরাম জানার মৃত্যুর পর তার ছেলে রঞ্জিত জানা প্রতিমা তৈরি করতে এসে টাকা কড়ি নিয়ে বচসার জেরে মায়ের মুর্তি না করেই চলে যায়৷ রাত্রে মায়ের কোপে তার একটি হাত অবশ হয়ে যায়৷ পরদিনেই ফের তিনি মায়ের কাছে ছুটে এসে ক্ষমা চেয়ে ওই ভাবেই প্রতিমা নির্মার করেন

এই বছর পুজোকে কেন্দ্র করে কোলে পরিবারের সদস্যরা পঞ্চমীর দিন রক্তদান শিবিরের আয়োজন করার পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছেন বলে জানান কোলে পরিবারের এক সদস্য অমিত কোলে।

আরও পড়ুনঃ শতবর্ষ প্রাচীন দেব পরিবারের দুর্গাপুজোর ঐতিহ্য ধরে রাখার চেষ্টা

তিনি জানান, এই বছর প্রায় দেড় লক্ষ টাকা সবে মিলিয়ে খরচ হবে পুজোতে। আর এই পুজো নামেই কোলে পরিবারের আদপে এই গ্রাম ছাড়াও পাশাপাশি গ্রামের মানুষেরা আমাদের এই পুজোর সঙ্গে ওতোপ্রোতো ভাবে জড়িয়ে রয়েছে।

নিউজফ্রন্ট এর ফেসবুক পেজে লাইক দিতে এখানে ক্লিক করুন
WhatsApp এ নিউজ পেতে জয়েন করুন আমাদের WhatsApp গ্রুপে
আপনার মতামত বা নিউজ পাঠান এই নম্বরে : +91 94745 60584

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here