কুশমুড়ির দেব পরিবারে জৌলুস কমলেও মাতৃ আরাধনায় অটুট ঐতিহ্য

0
102

নিজস্ব সংবাদদাতা, পশ্চিম মেদিনীপুরঃ

নেই কামানের শব্দ।নেই হাতিশালায় হাতি আর ঘোড়াশালায় ঘোড়া । উৎসব অনুষ্ঠানে কাছারিবাড়ির প্রাঙ্গণে আর বাজেনা নহবৎ। তবু দুর্গাপুজো এলে অতীতের সেই ঐতিহ্য ফিরে আসে ঢাক,কাঁসর,ঘণ্টা এবং শঙ্খধ্বনিতে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার বেলদা থানার কুশমুড়ির দেব পরিবারে।

temple | newsfront.co
ঐতিহ্যশালী মন্দির ৷ নিজস্ব চিত্র

শতবর্ষ প্রাচীন দেব পরিবারের দুর্গাপুজোয় এখন আর দেবী দশভূজার মূর্তি গড়া হয়না। ঘট বসিয়েই দেবী দুর্গার আরাধনা করা হয়। জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের সাথে সাথে কাছারিবাড়ির জৌলুস কমলেও ঐতিহ্য রক্ষায় দেব পরিবারের বর্তমান উত্তরসূরীরা আপ্রাণ প্রয়াসী।এই কাছারিবাড়ি এখন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে । আগাছায় ছেয়ে গিয়েছে বাড়ির সমগ্র অংশ । কিছু আগাছায় নাম না জানা কিছু ফুল ফুটে উঠেছে , তা যেন সেই ঐতিহ্যের স্মারক ক্ষয়িষ্ণু বাড়িটিকে দৃষ্টিনন্দন করে তুলেছে ।

damage house | newsfront.co
ভগ্নপ্রায় বাড়ি ৷ নিজস্ব চিত্র

দেব পরিবারে বাড়িতে ঢোকার মুখেই এখনও রয়েছে প্রায় ভঙ্গুর, তৎকালীন সেই প্রাচীন ঐতিহ্যশালী একটি তোরণ।যার সামনে একসময় ঘোড়ায় ও হাতির পিঠে চড়ে তৎকালীন রাজারা ও ইংরেজরা আসতেন রাজবাড়ীতে ।প্রায় দেড়শ বছর আগে বিহারের এক রাজপুত গুরুপ্রসাদ দেব কুশমুড়ি এলাকায় সুদের ব্যবসা করতে আসেন। তখন উদায়স্ত ঋণ ব্যবস্থা ছিল। সূর্যাস্তের পর ঋণ শোধ করতে না পারলেই ঋণ গ্রহীতার জমি দখল করে নিতেন ঋণ দাতা। এভাবেই অধুনা বেলদা ১ নম্বর গ্রামপঞ্চায়েতের কুশমুড়িতে দেব পরিবারের প্রতিষ্ঠা হয় । এই পরিবারের দুই সন্তান রাধামোহন দেব এবং গোলকমোহন দেব। এঁরাই তদানীন্তন রাজার কাছ থেকে চৌধুরী উপাধি লাভ করেন।

historic arch | newsfront.co
ঐতিহাসিক তোরণ ৷ নিজস্ব চিত্র

চৌধুরী রাধামোহন দেব এবং চৌধুরী গোলকমোহন দেব , পরিবারের কুলদেবতা ব্রজরাজ দেব মহাপ্রভুর মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। কথিত আছে দেবপরিবারের কুলদেবতার এই মন্দির তৈরি করতে প্রায় ১২ বছর সময় লেগেছিল। এখন বর্তমান উত্তরসূরীরা দুর্গাপূজার আয়োজন করেন। আর এই কুল দেবতার মন্দিরের কাছেই রয়েছে দুর্গা মন্দির ।তবে তার অবস্থা এখন জরাজীর্ণ ।বর্তমান যে সকল উত্তরসূরীরা রয়েছেন তারা সবাই মিলে অর্থ দিয়ে এবছর মন্দিরটিকে পুনরায় ঠিক করার পরিকল্পনা নিয়েছেন ।সামনে আর কটা দিন পরে পুজো তাই যার কাজও চলছে এখন বেশ জোরকদমে ।

elephant | newsfront.co
পুরাতন ঐতিহ্য ৷ নিজস্ব চিত্র

পরিমল দেব, অমল দেব, ত্রিপুরারি দেব, দীপক দেব, প্রবীর দেব, ঊষারানী দেব, কিরণ দেব, অরুণ দেব, দিব্যেন্দু দেব এবং সদারানী দেব এই দুর্গা পুজো পরিচালনা করেন। আগে ডাকের সাজের দেবী দশভূজা তৈরির জন্য খরচ হত লক্ষাধিক টাকা। কিন্তু একদিকে জমিদারির পতন, আর অন্যদিকে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, পুজার খরচকে সঙ্কুচিত করেছে। তাই ১৯৭২ সাল থেকে কুশমুড়ির প্রাচীন কাছারিবাড়ির অঙ্গনে অনুষ্ঠিত হচ্ছে ঘটপুজো । অথচ একসময় কুশমুড়ির দেবপরিবারের দূর্গাপুজা ছিল জেলার সেরা পুজা। এখানকার জমিদারই কেশিয়াড়ির সর্ব্বমঙ্গলা মন্দিরের জন্য প্রায় ৫০ বিঘা জমি দান করেছিলেন।

আরও পড়ুনঃ শিক্ষক-শিল্পীর হাতের জাদুতে গ্রাফাইড লিডে দুর্গার মাইক্রো মূর্তির আত্মপ্রকাশ

দেব পরিবারের দুর্গাপুজোর শুরুর আগে সর্ব্বমঙ্গলা মন্দিরে পুজো দেওয়া হত। এই প্রথা এখনও আছে। দেব পরিবারের পুজোর আগে সর্ব্বমঙ্গলা মায়ের কাছে পুজো দেওয়ার পর শুরু হয় দুর্গােপুজো । পূর্বে দেব পরিবারের দুর্গাপুজোর শুরুর আগে কামান দাগা হত। দেব পরিবারের দুর্গাপুজোর সূচনার শব্দ শোনার পর অন্যান্য জায়গার পুজা শুরু হতো । এখনো কুলদেবতার মন্দিরে নিত্যপুজো হয়। সেই পুজোর খরচ ও সব শরিকরা মিলে দেন। অতীতে দুর্গা পুজোর প্রায় একমাস আগে থাকে সাধুসন্তরা এখানে আসতেন। দেবীর মূর্তি গড়তেন মেদিনীপুর ও ঘাটালের শিল্পীরা। জমিদার পরিবারের লোকজন পালকি ছাড়া বের হতেন না। এখন আর সেসব নেই। আবার এবছর নতুনভাবে সংযোজিত হয়েছে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ।

আরও পড়ুনঃ করোনা আবহে শতাব্দী প্রাচীন ব্যবত্তা বাড়ির পুজোও এবার আড়ম্বরহীন

যার ফলে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে প্রয়োজনীয় সুরক্ষা বিধি মেনে, মাস্ক এবং স্যানিটাইজার সব ব্যবহার করে পুজো করা হবে বলে জানিয়েছেন দেব পরিবারের উত্তরসূরীরা। পুজোর আচার মেনে এখানে ঘটপুজো শুরু হয় সপ্তমী থেকে। অতিথিদের আপ্যায়ণ করা হয়। পুজোর দিনগুলিতে নিষ্ঠার সঙ্গে আচার মানা হয়। দূরদূরান্ত থেকে অসংখ্য মানুষ আসতেন দেবপরিবারের দুর্গাপুজো দেখতে । আগে দুর্গাপুজোর দিন গুলিতে যাত্রা পালা হত। এখন আর এসব হয়না। তবুও ঘট পুজোর মাধ্যমে ঐতিহ্যকে ধরে রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে।

আরও পড়ুনঃ মেদিনীপুরে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের স্মরণে সম্প্রীতি দিবস উদযাপন

একদিকে পুজো , হোম, যজ্ঞ হত আর অন্যদিকে দানধ্যান করাহত। সাধুসন্তদের শুধু থাকা খাওয়া নয় তাঁদের বিভিন্ন সামগ্রী দান করা হত। যদিও এখন আর তা করা হয়না ৷এখনও অনেকে আসেন দেব পরিবারের ঘট পুজো দেখতে। সপ্তমীতে পেটভরে খাওয়ানো ও হয় অতিথিদের। পরিবারের অন্যান্য জায়গায় যারা রয়েছেন আত্মীয়স্বজনরাও হাজির হন ওই দিন ।একসঙ্গে দুর্গাপুজোর এই কটা দিন বেশ আনন্দের সঙ্গে কাটান বলে জানিয়েছেন পরিবারের সদস্যরা ।

নিউজফ্রন্ট এর ফেসবুক পেজে লাইক দিতে এখানে ক্লিক করুন
WhatsApp এ নিউজ পেতে জয়েন করুন আমাদের WhatsApp গ্রুপে
আপনার মতামত বা নিউজ পাঠান এই নম্বরে : +91 94745 60584

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here