নিজস্ব সংবাদদাতা,উত্তর ২৪ পরগনাঃ
মালাবদল হল না। সিঁদুরদানও নেই। কিন্তু এই লকডাউনে বিয়ে সেরে ফেললেন মধ্যমগ্রামের বিশ্বজিত রায় আর বনগাঁর শ্রাবন্তী মজুমদার। কি ভাবে এটা সম্ভব হল? আসলে, পুরো বিয়েটাই হল জুমে। কর্মসূত্রে বিশ্বজিত এখন গুরুগ্রামে এক বহুজাতিক কম্পানির সঙ্গে যুক্ত। লকডাউনে বাড়ি আসতে পারেননি বিশ্বজিত। তাতে কি?
বিশ্বজিতের বাবা পুরোহিত নিয়ে মধ্যমগ্রামের বাড়িতেই সারা দিন না খেয়ে রাত ৮.১৫ -র শুভ লগ্নে ছেলের বিয়ে দিতে বসেছিলেন গত ২৫শে বৈশাখ। অন্য দিকে হবু বরের পছন্দের লাল-হলদেটে ঢাকাই শাড়ি পরে বনগাঁ থেকে মা আর দাদাকে পাশে নিয়ে বসেছিলেন শ্রাবন্তী। আর গুরুগ্রামে একা নেহাতই একটা স্যান্ডো গেঞ্জি চড়িয়ে টোপর ছাড়াই বিয়ে করতে বসেছিলেন বিশ্বজিত। বৈদিক মন্ত্র উচ্চারিত হল। বর আর বউ বুকে হাত দিয়ে মন্ত্র উচ্চারণ করলেন, ‘‘যদিদং হৃদয়ং তব তদিদং হৃদয়ং মম…”
না, এ ভাবে যে বিয়ে করতে হবে তা বিশ্বজিত বা শ্রাবন্তী কেউই ভাবেননি। “আমরা দু’জনেই আনন্দবাজারের কাছে কৃতজ্ঞ। পাত্র-পাত্রী বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে আমাদের যোগাযোগ। তবে আমাদের যে দিন প্রথম দেখা হয়, আমার বিশ্বজিতকে দেখে তেমন কিছু মনে হয়নি। কিন্তু যে মুহূর্তে ও শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ‘পার্থিব’ উপন্যাসের প্রসঙ্গ আর রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে কথা বলতে শুরু করল আমার ভেতরটা কেমন গুলিয়ে গেল!”
এই গান আর কাব্যচর্চা দিয়েই ডিসেম্বরের শীতে বসন্ত নামিয়ে আনেন শ্রাবন্তী আর বিশ্বজিত! ‘আপনি’ থেকে ‘তুমি’।
আরও পড়ুনঃ ইফতারের খাবার দিয়ে মানুষের পাশে পঞ্চায়েত সদস্য
দু’জনেই ঠিক করেন বিয়ে করলে পঁচিশে বৈশাখই করবেন, নয়তো নয়। “আমাদের দু’জনের কথা মানেই রবীন্দ্রনাথের গান। আমি রবীন্দ্রভারতীতে বাংলা নিয়ে পিএইচডি করছি। আমিও এর মধ্যেই ডুবে থাকি! আমাদের সব কিছুতে রবীন্দ্রনাথ। পঁচিশে বৈশাখ ছাড়া আমাদের বিয়ে অন্য দিন হতে পারত না!” জোর গলায় বললেন শ্রাবন্তী।
ছাপা হয়ে গেল বিয়ের কার্ড। সেই কার্ডেও রবীন্দ্রনাথের লাইন। এক দিনের জন্য কলকাতায় এসে দুম করে আংটি পরিয়ে দিলেন বিশ্বজিত। কেনা হয়ে গেল বিশ্বজিতের বাড়ির তরফের বেনারসি শাড়ি। বিশ্বজিতের বাড়ি থেকে মধ্যমগ্রামে বিয়েবাড়িও বুক করে ফেলা হয়। অন্য দিকে শ্রাবন্তীর বাড়িতেই বিয়ের তোড়জোড়, গয়না, খাবারের মেনু ঠিক হতে থাকল। এর মাঝেই লকডাউন!
আরও পড়ুনঃ বিশেষ ট্রেনের খবর নেই, তবু প্রস্তুতি চরমে প্রশাসনের
“আমি তো ভেবেছিলাম যা হয় হোক, গাড়ি নিয়ে কলকাতা যাব! এত দিনের প্ল্যান! আমাদের বিয়ে হবে না? খুব আপসেট হয়ে গিয়েছিলাম। এখনও তো বাড়ি বুকিংয়ের টাকা ফেরত পাইনি। শেষে ভাবলাম সব কাজ এখন টেকনোলজির মাধ্যমে হচ্ছে, বিয়ে কেন হবে না?” সাফ কথা বিশ্বজিতের। যেমন কথা তেমনই কাজ। শ্রাবন্তীর বাড়ি থেকেও সকলে রাজি! অফিসের কাজ নয়। এ বার জুমেই বিয়ে হল পঁচিশে বৈশাখ।
অন্য দিকে শ্রাবন্তীকে আগেই জুমের লিঙ্ক পাঠিয়ে রেখেছিলেন তাঁর হবু স্বামী। “প্রথমে ভেবেছিলাম জীবনের এমন একটা কাজ শেষে জুমে করতে হবে? পরে মন বদলাই বিশ্বজিতের ইচ্ছেতেই। জুমে বিয়ে করতে রাজি হই। ওর খুব ইচ্ছে ছিল লাল আর হলদে পাড়ের শাড়ি পরে ওর সামনে আসি। বাড়িতে ওই রকম একটা নতুন শাড়িই ছিল, সেটা পরেই বসলাম”, উত্তেজিত শ্রাবন্তী।
সকালে শ্রাবন্তীর বনগাঁর বাড়িতে নারায়ণ পুজো হয়েছিল। “আর আমি উপোস করেই ছিলাম। বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর নিরামিষ খাই”, যোগ করলেন শ্রাবন্তী। আশি মিনিটের জুমের ভিডিয়ো রেকর্ডিং এখন তাঁদের বিয়ের একমাত্র সম্বল!
গুরুগ্রাম থেকে আনন্দবাজার ডিজিটালকে বিশ্বজিত বললেন, “আমি টেকনোলজির লোক। আমার কাছে ডেডলাইন সবচেয়ে আগে। জীবনের এই ডেডলাইন করোনার জন্য কোনও ভাবেই মিস করতে চাইনি আমরা। যুগ এগিয়ে যাচ্ছে, বর দেরিতে পৌঁছল বলে মেয়ে লগ্নভ্রষ্ট হল সে সব দিন চলে গিয়েছে। আমাদের বিয়ের খবর পড়ে নিশ্চয় আরও মানুষ এ ভাবে বিয়ে করবেন বলে আমার বিশ্বাস!”
অগ্নিসাক্ষী বা বাসি বিয়ের কাজ যদিও বাকি রেখেছেন শ্রাবন্তী-বিশ্বজিৎ। “সামনে না এলে সিঁদুর পরা সম্ভব নয়। ওটা এখন থাক। তবে আমরা বিয়ের পরের দিন কালরাত্রি মেনে এক বারও কেউ কাউকে হোয়াটসঅ্যাপ কল করিনি”, বললেন শ্রাবন্তী।
WhatsApp এ নিউজ পেতে জয়েন করুন আমাদের WhatsApp গ্রুপে
আপনার মতামত বা নিউজ পাঠান এই নম্বরে : +91 94745 60584