নিজস্ব প্রতিবেদন, নিউজ ফ্রন্টঃ
সম্প্ৰতি লকডাউনের প্রভাবে সাধারণ শ্রমজীবি মানুষ রুটি-রুজির প্রশ্নে যখন জর্জরিত ও রাজ্যের বৃহত্তর ছাত্র-যুব সমাজ যখন শিক্ষা-কর্মসংস্থানের প্রশ্নে দিশাহীন, তখন স্বাভাবিকভাবেই সার্বিক হতাশা ও মানসিক যন্ত্রণার কারণে সমাজ ও পরিবারের মধ্যে কলহ-বিবাদ-অপরাধ প্রবণতা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। এমতবস্থায়, রাজ্য সরকারের সুলভ দেশী মদের পাউচ চালু ও অনলাইনে “দুয়ারে মদ” প্রকল্প চালু করার সিদ্ধান্তের কড়া সমালোচনা করল ওয়েলফেয়ার পার্টি অফ ইন্ডিয়া।
এদিন পার্টির রাজ্য দপ্তরে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে পার্টির রাজ্য সাধারণ সম্পাদক সারওয়ার হাসান বলেন, “করোনা অতিমারীর সংকট কালে যখন সারা বিশ্বের সাথে সাথে আমাদের দেশও সার্বিকভাবে লড়াই করছে, তখন আমাদের গর্বের বাংলার সমাজ জীবনকে ধ্বংসের মুখোমুখি এনে দাঁড় করিয়েছে মদ নামক এক নিষিদ্ধ মারণ পানীয়। পরিতাপের হলেও সত্যি যে, রাজ্যের মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে বাংলায় মানবতাকে আচ্ছন্নকারী এই নিষিদ্ধ পানীয়টিকে ক্ৰমে ক্ৰমে আরও সহজলভ্য করে দিয়ে রমরমিয়ে তার বিপণনের সকল আয়োজন করা হচ্ছে। প্রতি বছরই রাজ্যের মদ থেকে রাজস্ব আয় বাড়তে বাড়তে ২০২০-২০২১ অর্থবর্ষে তা ১১,৮৭৩.৭ কোটিতে গিয়ে পৌঁছে গেছে এবং আগামীতে রাজ্য শুধু এই মদের রাজস্ব থেকে ২০,০০০কোটি টাকা আয়ের লক্ষ্যমাত্রা স্থির করেছে । অর্থনৈতিক গবেষণা সংস্থা ICRIER ও আইনী পরামর্শদাতা সংস্থা PLR Chambers এর যৌথ গবেষণায় উঠে আসা সাম্প্রতিক একটি পরিসংখ্যান অনুযায়ী সারা দেশের মধ্যে মদ্যপানের নিরীখে উত্তর প্রদেশের পরেই দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছে পশ্চিমবঙ্গের নাম। বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের প্রায় ১.৪ কোটি জনতা মদ্যপানাসক্ত। এই সকল পরিসংখ্যান পশ্চিমবঙ্গবাসী হিসাবে আমাদের গর্বিত তো করেই না, বরং লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে আসে। আমাদের প্রতিবেশী রাজ্য বিহারে যেখানে কয়েক বছর পূর্বেই আইন করে মদ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে, সেখানে বাংলায় আবগারি নীতির পরিবর্তন এনে দিনের পর দিন এই ধ্বংসাত্মক পানীয়টিকে ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়ার যে উদ্যোগ রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে নেওয়া হচ্ছে তা ন্যাক্কারজনক। আমরা মনে করি, কোনও সভ্য সমাজের জনকল্যাণমূলক অর্থনীতিতে মদ নামক নিষিদ্ধ পানীয়র সয়লাব বৈধতা পেতে পারে না।”
রাজ্যে ওয়েলফেয়ার পার্টি কেন সরকারের “দুয়ারে মদ” প্রকল্পের বিরোধিতা করছে জানতে চাইলে, পার্টির রাজ্য সভাপতি শ্রী মনসা সেন জবাবে বলেন, “ওয়েলফেয়ার পার্টি তার মদ-বিরোধী নৈতিক অবস্থানে অটুট থেকে মদ-মুক্ত বাংলার স্বপ্ন নিয়ে প্রতিবছর লাগাতার মদ-বিরোধী অভিযান পরিচালনা করে থাকে । বিগত বছরের নভেম্বর মাসেই আমরা একগুচ্ছ দাবী সহ রাজ্য আবগারী দপ্তরের মাধ্যমে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে আমাদের বার্তা দিয়েছিলাম । কিন্তু, সেই আবেদনে কর্ণপাত না করে রাজ্য সরকার “ওয়েস্ট বেঙ্গল স্টেট বেভারেজেস কর্পোরেশন” (বেভকো)-র মাধ্যমে মদের ই-রিটেল করতে আগ্রহী চার সংস্থার সাথে এই ফেব্রুয়ারি মাসের শুরুতেই “মউ” (মেমোরেন্ডাম অফ আন্ডারস্ট্যান্ডিং) স্বাক্ষর করতে চলেছে এবং আগামী অর্থবর্ষের গোঁড়ায় এপ্রিল মাস থেকেই রাজ্যে ঐ চার সংস্থার মাধ্যমে বাড়ি বাড়ি মদ পৌঁছে দেওয়ার পরিষেবা শুরু করছে।
জানা গেছে সেই চার বাণিজ্যিক সংস্থা হল: “বাজিমাত ড্রিংকস”, “নেচারস বাস্কেট”, “দুনজো ডিজিটাল” এবং “প্লটিনাস অ্যানালিটিকা”। বর্তমান অর্থনৈতিক সংকট ও রাজ্যের শিক্ষা-কর্মসংস্থানের এমন এক ডামাডোল পরিস্থিতির মধ্যে সরকারের এহেন অমানবিক ও দেউলিয়া সিদ্ধান্তের বিরোধিতায় ওয়েলফেয়ার পার্টি তাই সারা রাজ্যব্যাপী “মদ চাই না, শিক্ষা চাই । সবার হাতে কাজ চাই ।” শীর্ষক বিক্ষোভ কর্মসূচী পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহন করেছে । পুরো ফেব্রুয়ারি মাস ব্যাপী রাজ্যে বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্যদিয়ে এই অভিযান পরিচালনা করা হবে।” রাজ্যব্যাপী এই মদবিরোধী কর্মসূচী পালনের আরও গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসাবে পার্টির রাজ্য সভাপতি শ্রী মনসা সেন বলেন, “বর্তমান রাজ্য সরকার সার্বিকভাবে বিফল। বিগত বিধানসভা নির্বাচনে নিশ্চিৎ পরাজয় এড়িয়ে যেতে রাজ্য সরকার প্রথমতঃ মানুষের সামনে বিজেপি জুজু বড় করে তুলে ধরেছিল, আর দ্বিতীয়ত: ঢালাও জনমোহিনী প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। এখন নির্বাচন পরবর্তীকালে সেইসব বেশকিছু জনমোহিনী অবাস্তব প্রতিশ্রুতি (যেমন, “দুয়ারে রেশন” প্রকল্প যার বাস্তবে কোনও দরকার ছিল না এবং রেশন ডিলারদের বিরোধিতার মুখে পড়ে এখন সরকারকেই তার অতিরিক্ত খরচ বহন করতে হচ্ছে) পূরণ করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে এবং সেই রাজস্ব ঘাটতি পূরণের জন্য আবগারী দপ্তরের মতো লাভজনক সংস্থার মাধ্যমে বেশী বেশী রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যে এই ধরণের দুয়ারে মদ প্রকল্পের সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। আসলে, এই সরকার যেমন দিশাহীন, তেমনই নৈতিকভাবে দেউলিয়া হয়ে পড়েছে। মাথায় রাখতে হবে শুধুমাত্র জনমোহিনী ভোট রাজনীতির কারণেই সরকারের নিত্য নুতন প্রকল্প, মেলা-খেলায় কোটি কোটি টাকা খরচ হয়েছে এবং এই অপরিকল্পিত খাতে বেহিসেবী খরচের জেরে আজ রাজ্যের মোট ঋণ প্রায় ৫.৫ লক্ষ কোটি টাকায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে। সাম্প্রতিক কালের রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার একটি রিপোর্ট অনুযায়ী মোট ঋণের নিরীখে পশ্চিমবঙ্গ এখন দেশের রাজ্যগুলির মধ্যে তৃতীয় স্থানে উঠে এসেছে। অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞদের অনেকের মতে, রাজ্য এখুনি এধরনের খরচের বহর কমিয়ে রাজস্ব প্রদানকারী বড় শিল্পে বা উন্নয়ন প্রকল্পে বিনিয়োগ শুরু না করলে অচিরেই এই রাজ্য বড় ঋণের ফাঁদে পড়বে। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের CMIE ( Centre For Monitoring Indian Economy) -এর রিপোর্ট অনুযায়ী বেকারত্বের অনুপাতে ( যা পশ্চিমবঙ্গে বর্তমানে ৬.৪%) পশ্চিমবঙ্গ দেশের মধ্যে ১৪তম স্থানে বিরাজ করছে, যা খুবই উদ্বেগের । এই কনকনে শীতের মধ্যেও কোলকাতার রাজপথে আজও বিভিন্ন চাকরী প্রার্থীদের ধর্না বিক্ষোভ চলছে । প্রাইমারী থেকে সপ্তম শ্রেণীর ছাত্রছাত্রীদের অভিভাবকমণ্ডলীর একটা বড় অংশ স্কুল বিল্ডিং ফেলে রেখে রাজ্য সরকারের হটকারী “পাড়ায় পাঠশালা” চালুর যুক্তি খুঁজে পাচ্ছেন না! আর, এ সবকিছু উপেক্ষা করে রাজ্য সরকার মানুষকে মাতাল বানাতে উদ্যোগী ! এই অন্যায় মেনে নেওয়া যায় না।”
পার্টির রাজ্য সাধারণ সম্পাদক সারওয়ার হাসান পার্টির মদবিরোধী প্রচার অভিযানের কর্মসূচী সম্পর্কে জানাতে গিয়ে বলেন, “একটি মানবিক রাজ্য সরকারের উচিত রাজ্যের ১০ কোটি মানুষের কল্যাণের কথা ভেবে নীতি নির্ধারণ করা । কিন্তু, রাজ্য সরকারের পরিকল্পনায় আমরা যথেষ্ট হতাশ ! মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী প্রায় ১.৬ কোটি গৃহিণীদের কাছে “লক্ষ্মীর ভান্ডার”- এর আর্থিক সুবিধা পৌঁছালেন, আর “দুয়ারে মদ” প্রকল্পের অধীনে প্রায় ঠিক সম সংখ্যক বাড়ীর কর্তা বা জোয়ান ছেলেদের মাতাল বানানো হবে ! সংসারে কী সুখ বলে কিছু থাকবে ? আবার ঠিক একই ভাবে ঘরের কচিকাঁচাদের স্কুলের সুরক্ষিত গণ্ডির বাইরে “পাড়ায় পাঠশালা”য় পড়ানোর বন্দোবস্ত করবেন আর ঐ পাড়ার দুয়ারে দুয়ারে মদের কারবার চলবে! বঙ্গবাসীকে এ কোন পাঠ পড়াতে চায়ছেন মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী? তাই, আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে, এই প্রচারাভিযানের শুরুতেই পার্টির রাজ্য কমিটির পক্ষ থেকে আমরা মহামান্য রাজ্যপালের কাছে এবিষযয়ে স্মারকলিপি প্রদান করব। পরবর্তী পর্যায়ে গণসচেতনতার জন্য সোশ্যাল মিডিয়ার বিভিন্ন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে ওয়েবিনার, টক শো, ইত্যাদির মধ্য দিয়ে এবিষয়ে আমাদের বক্তব্য তুলে ধরা হবে । জেলা ও ব্লক স্তরে পাড়ায় পাড়ায় মহিলাদের বিক্ষোভ কর্মসূচী, মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর উদ্দেশ্যে বিডিও ও ডিএমদের মাধ্যমে ডেপুটেশন প্রদান, সমাজের বিশিষ্টজনেদের সাথে মতবিনিময়, চলমান অডিও প্রচার, লিফলেট বিতরণ, পোস্টারিং, দেওয়াল লিখন, গণস্বাক্ষর সংগ্রহ সহ সম্ভাব্য সবরকম প্রচারকে হাতিয়ার করে এই জনবিরোধী সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে জনমত গঠনের কাজ করা হবে।”
আরও পড়ুনঃ বিচারবিভাগ, নির্বাচন কমিশন ও পেগাসাস- মোদী সরকারের অস্ত্রঃ সংসদে বিস্ফোরক রাহুল গান্ধী
সংবাদিক বৈঠক থেকে পার্টির পক্ষ থেকে আশা ব্যক্ত করে বলা হয় যে, বাংলার শুভ বুদ্ধিসম্পন্ন সকল মানুষ মদ-মুক্ত বাংলা গড়ার স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে সর্বোতভাবে ওয়েলফেয়ার পার্টির পাশে থাকবেন এবং বাংলার আপামর মানুষের কল্যাণে ও অপরাধমুক্ত সোনার বাংলা গড়ার লক্ষ্যে রাজ্য সরকার সদর্থক পদক্ষেপ নেবে ও অবিলম্বে এই ধ্বংসাত্মক সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করবে। এদিনের সাংবাদিক বৈঠকে আরও উপস্থিত ছিলেন পার্টির রাজ্য সম্পাদক আবু তাহের আনসারী, রাজ্য ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য মাহিনুর জামান প্রমুখ।
WhatsApp এ নিউজ পেতে জয়েন করুন আমাদের WhatsApp গ্রুপে
আপনার মতামত বা নিউজ পাঠান এই নম্বরে : +91 94745 60584