নবনীতা দত্তগুপ্ত
আই টি সেক্টরের মোটা মাইনের চাকরি ছেড়ে গানের দুনিয়ায় পা রেখেছিল বিপ্র। বয়স তখন কতই বা, ২৬-২৭। লেখাপড়ায় সে বরাবরই ভাল। পাশাপাশি সেই ক্লাস টু-থ্রি থেকে গান শুনতে আর গাইতে ভালোবাসত সে৷ পড়তে পড়তে গাইত, লিখতে লিখতে গাইত, স্নান করতে করতে গাইত, হাঁটতে হাঁটতে গাইত, গাড়িতে চেপে বাবা-মায়ের সঙ্গে বেড়াতে যাওয়ার সময়ও গলায় গান লেগে থাকত তার।
কখনও ছড়ার গান, কখনও বা হিন্দি সিনেমার গান আবার কখনও স্কুলে পড়ানো রাইমস যেগুলো আন্টিরা ওদের সুর করে পড়াতেন রোজ সেগুলোও ভাজত সে গলায়। এমনকী খেতে খেতেও গাইত অনেক সময়। ঠাম্মা বলত, ওরে খেতে খেতে গান করিস না, পাগল হয়ে যাবি। কে কার কথা শোনে! গেয়েই চলত সে।
বিপ্রর এই অভ্যাসে আপত্তি ছিল তার বাবা অতনুর। মায়ের নয়। বাবার সেই এক কথা- লেখাপড়া কর। গান গেয়ে কিস্যু হবে না। ছেলেরা গান গায় না। মেয়েরা গান গায়। আর এই কথাতে বিপ্রর মা টিনার সঙ্গে প্রায়ই একচোট ঝগড়া হয়ে যেত তার। পরে আবার সব ঠাণ্ডা হয়ে জেত বটে। কিন্তু ভাবনা আর ভালোলাগায় যে দুজনের মধ্যে এই বিস্তর ফারাক আছে তা বিয়ের আগে প্রেমে মশগুল হয়ে বুঝতে পারেনি দুজনের কেউই। আজ যখন ওদের ভরা সংসার তখন দাঁত খিচনো সত্যি গুলো সামনে আসছে একে একে৷
এখন ওদের দুজনের বয়স যখন প্রায় ৬০ ছুঁতে চলেছে তখন ঝগড়াঝাটির দাপট কমলেও মতপার্থক্য একই আছে। ছেলে একদিন গান গেয়ে পরিবারের মুখ উজ্জ্বল করবেই- এই বিশ্বাস ছিল টিনার। তাই ছেলের চাকরি ছেড়ে দেওয়ায় সে খুব বেশি বিব্রত হয়নি। আর এতে সায় ছিল বিপ্রর প্রেমিকা এবং তার পরিবারেরও।
বিপ্র যখন অফিস কাছারিতে না গিয়ে দিনরাত গলা সাধে তখন অতনুর চলে চোটপাট। ছেলের সঙ্গে আজকাল ভালোভাবে কথাও বলে না সে। ছেলেও দূরত্ব সামলে রাখে বাবার সঙ্গে। মাঝেমধ্যে অতনুর তীক্ষ্ণ বাক্যবাণ আহত করে বিপ্রকে। টাকাপয়সা সংসারে না দিতে পারার কারণে কথা শোনায় বাপে। টাকাপয়সার যে খুব দরকার তেমনটা নয়। সম্ভ্রান্ত পরিবার। অতনু নিজে একজন সরকারি ব্যাঙ্ককর্মী। সুতরাং পয়সাকড়ির অভাব তার নেই। ছেলেকে একপ্রকার হ্যাটা করার জন্যই সে টাকার কথা বলে বারবার। মেধাবী, বুদ্ধিমান বিপ্রর তা বুঝতে অসুবিধা হয় না।
আরও পড়ুনঃ পঞ্চস্বরে পঞ্চম
কথায় বলে, লক্ষ্মী আর সরস্বতী এক জায়গায় বসবাস করেন না। অতনুদের পরিবারের ক্ষেত্রে এই কথা খাটে না। পরিবার যেমন বিত্তশালী তেমনি সকলেই উচ্চশিক্ষিত। সবথেকে কম লেখাপড়া করনেওয়ালাও এম.এ পাশ। সকলেই ভাল ভাল জায়গায় লোভনীয় পদে চাকুরিরত। ফলে ছেলের এই স্টেজে স্টেজে গান গেয়ে বেড়ানোতে অতনুর ঘোর আপত্তি। তাও আবার মোটা মাইনের চাকরি ছেড়ে? এই বাজারে কেউ এমন কাজ করে? এ কথা সে বুঝিয়ে পারে না টিনা আর তার আদরের ছেলেকে।
একটা রবিবারের সকাল। বিপ্র গলা সাধছে। অতনু একরাশ বিরক্তি মুখে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে খবরের কাগজ দেখছে। হঠাতই বেজে উঠল ল্যান্ড ফোনটা। রেওয়াজের সময় বিপ্র ফোন বন্ধ রাখে। ল্যান্ড ফোনের ওপার থেকে অতনুর ভাগ্নের গলা, “মামা, বিপ্র কোথায়? ওকে ফোনে পাচ্ছি না। ওকে দাও। ও তো ধামাকা করে ছাড়ল একেবারে।” অতনু বলল, কেন কী হাতি ঘোড়া করল সে? জলসা মাতালো নাকি কোথাও?
ভাগ্নে এবার চটেছে। এমনিতেই সে রগচটা। বড় ছোট সে মানে না। স্পষ্টবাদী। বলল- এই জন্য তোমায় আমার পছন্দ না ছোট থেকে। আরে ভাই আমার গান শুনিয়ে এক অসুস্হকে সুস্থ করেছে। এক কঠিন অসুখে সেই সঙ্গীত শিল্পী বাকশক্তি হারিয়েছিলেন। ডাক্তার বলেছিলেন মিউজিক থেরাপি তাঁকে সুস্থ করতে পারে। ভাই রোজ তাঁকে ভিডিও কলে গান শোনায় রাতে। আর গতকাল রাতে সে চিতকার করে বলে উঠেছে – আমি গাইতে চাই।
আরও পড়ুনঃ ওরা কাজ করে দেশ-দেশান্তরে, কিন্তু…
চারদিকে সাড়া পড়ে গেছে। বাজে না বকে নিউজ চ্যানেলটা খোলো মামা। পেপারের লাস্ট এডিশনটা পড়ো ভাল করে। সরকার ওকে সম্মানিত করবে। প্লে ব্যাকে সুজোগও পাবে ছেলেটা। ওর নেম ফেম এ আমরা গর্বিত। রাখছি। ওর রেওয়াজ শেষ হোক। আমি আবার ফোন করব ওকে। সেদিন একের পর এক ফোনে নাজেহাল হয়ে যাচ্ছিল অতনু। ছেলে গান গেয়েই চলেছে। ডাকা যাবে না তাকে। ল্যান্ড ফোনে আত্মীয়দের শুভেচ্ছার পাশাপাশি আসতে থাকে নিউজ চ্যানেলের ফোনও। কে জানে তারা কী ভাবে পেল বাড়ির নম্বর! এই ভাবতে ভাবতেই দরজা খুলে বেরিয়ে এসেছে বিপ্র। বাবা আজ অনেকদিন পর তাকে ছোটবেলার মতো ডেকে উঠল বিপু বাবা।
বিপ্রর চোখে জল। বাবা কী হয়েছে তোমার? কাঁদছ কেন? অতনু জড়িয়ে ধরে তাকে। অহরহ ফোনের শুভেচ্ছা বার্তা আসার মাঝেই ছেলের কীর্তি খবরের কাগজে দেখে ফেলেছে অতনু। বিপ্র তখনও কিছুই জানে না।
কলিং বেল বাজে। বিপ্র দরজা খুলতেই চার-পাঁচটা বুম তাকে ঘিরে ধরে। বিপ্রর কাছে এবার গোটা ব্যাপারটা খানিকটা পরিষ্কার। গত রাতে ঝড় বৃষ্টির কারণে সেই ভিডিও কল কেটে যায় গান চলাকালীনই। তার মানে ফোন কেটে যাওয়ার পরই গায়িকা কথা বলে ফেলেছেন!
বিপ্রর ঠোঁটে মৃদু হাসি। জয়ের আনন্দ সে বুকের ভিতর লুকিয়ে রাখতে জানে।অতনু আজ ভারি খুশি। ছেলের এমন খ্যাতিই তো চেয়েছিল সে। টাকা তার কাছে কখনোই বড় হয়ে দাঁড়ায়নি। কেবল ছেলের সম্মানীয় চাকরি, আর পাঁচজনের কাছে ছেলের কদরের পিপাসু ছিল অতনু। আজ মিটল পিপাসা।
WhatsApp এ নিউজ পেতে জয়েন করুন আমাদের WhatsApp গ্রুপে
আপনার মতামত বা নিউজ পাঠান এই নম্বরে : +91 94745 60584