রবিবারের গল্পঃ মিথ্যা বিগ্রহ

0
56

নীলাক্ষ চৌধুরী

‘জ-অ-অ-অ-অ-য় শি-ই-ই-ই-ব বা-আ-আ বা-আ-আ’। এতো রাতে আজ হঠাৎ এই উদ্ভট আর বিকট বাজখাই গলায় জয়ধ্বনি আর সাথে এলার্মের মত এক নাগাড়ে ঢং ঢং ঢং করে ঘন্টা নাড়ার আওয়াজে চমকে উঠলাম। আজ সোমবার নয়, অমাবস্যা নয়, কার কি জানি শিব ভর করলেন ভেবে পর্দা তুলে তাকিয়ে দেখি ঘন্টাই ওমন আজব কান্ড করছে।

Temple | newsfront.co
প্রতীকী চিত্র

মুখ দেখা যাচ্ছে না যদিও, তবুও কেমন এক অদ্ভুত মতো দেখাচ্ছে পাস থেকে। মুখটা শক্ত, মনে হচ্ছে গলার শিরাটা যেন ফুলে রয়েছে। মন্দিরের গর্ভগৃহের দরজা ভেদ করে যেমন সে তাকিয়ে আছে মহাকাল ভৈরবের চোখের দিকে। অনুমান করছিলাম, চোখ তার নিশ্চয় রক্তবর্ণ হয়ে রয়েছে।

এই ঘন্টাকে মাস কয়েক হচ্ছে এই পাড়ায় দেখা যাচ্ছে। একদিন সকালে মন্দির খুলতে এসে সুধীর পুরোইত দেখেন মন্দিরের গায়ে যে বিরাট ঝুড়িওয়ালা পুরোনো বট গাছটা রয়েছে তার বাঁধানো ধারটায় বসে আছে সে। কোত্থেকে উদয় হয়েছে কে জানে। তার আবির্ভাবের সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই এরকম নাকি একদিন করেছিল ঘন্টা। তাও সেটা ছিল দিনের বেলা।

Nilakkha Choudhury | newsfront.co
নীলাক্ষ চৌধুরী

পাড়ার লোকজন ধরে বেঁধে থিতু করিয়েছিল। কি হয়েছে জিগ্যেস করে কোনো উত্তর পাওয়া যায় নি। শুধু শরীর তার আগুনে পুড়ে যাচ্ছিল তখন আর লাল চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসছে যেনো। সুধীর পুরোইতই বামন ডাক্তারের থেকে হোমিওপ্যাথি পুরিয়া এনে খাইয়ে দাইয়ে এক রকম সুস্থ করে।

আমার শোবার ঘর আর আর মন্দিরের বড় চাতালের মধ্যে যে পুরোনো পাঁচিলটা রয়েছে তার উচ্চতা এমনই যে, যারাই গর্ভগৃহের দিকে মুখ করে দাঁড়ায়, তাদের আড়াআড়ি দেখা যায়। কোনো আঁকা ছবি, পাস থেকে দেখলে যেমন লাগে। হাফ কপাল-একটা চোখ, এই রকম। আমি যেদিকে মাথা দিয়ে শুই, সম্ভবত পূর্ব দিক, সেদিকেই ভৈরব সহ আরও কয়েকজন দেব দেবী পেছন করে দিন রাত চব্বিশ ঘন্টা তিনশো পঁয়ষট্টি দিন ঠায় দাঁড়িয়ে থাকেন। তারপরেই পুরোহিত কোয়ার্টার।

যেহেতু পাড়াতেই বাড়ি, তাই সুধীর পুরোইত ওখানে থাকেন না। তিনি রাত ৮.৩০-৯টা নাগাদ, মন্ত্র কল্পে মন্দির নিবাসী বিগ্রহাদিকে নিদ্রায় পাঠিয়ে বাড়ি ফিরে যান। আবার পরদিন সকাল ৭টা থেকে ভগবানরা জেগে উঠেন দুপুরের ৩ঘন্টার ভাতঘুমের বিরাম পর্যন্ত।

এ পাড়ায় আসার পর যে এমন একবার হয়েছিল ঘন্টার, সেটা জানলাম সকালে চা খেতে খেতে বড় কাকুর মুখ থেকে। বড় কাকু সহ মন্দির কমিটির কোন সদস্যেরই এই ভবঘুরের দিনরাত মন্দিরে পড়ে থাকাটাতে সায় ছিল না। তাড়িয়ে দিতে চেয়েছিল কমিটি। কার যে কি মতলব, বোঝা তো দায়। চুরি ফুরি করে যদি পালায়।

শুধু সুধীর পুরোহিতের প্রশ্রয়ই ঘন্টা এই পাড়ায় থেকে যায়। সকাল সন্ধ্যে শুধু ঘন্টার আওয়াজ হলেই নাকি এই পাগলের শরীরে সার আসে। বাপি খেয়াল করেছিল ব্যাপারটা প্রথমে। ওকে কিছু বলতে হলে ঘন্টা বাজাতে হয়, কিছু করাতে হলে ঘন্টা বাজাতে হয়। সেই থেকেই পাড়ায় সবাই ওকে ডাকে ঘন্টা। এমনিতে ঘন্টা কিছুই করে না যদিও, সারাক্ষণ একটুকরো কাঠ ঠক ঠক করে, থেকে থেকেই শুধু ‘জয়: বলে উঠে। শুনলে মনে হবে কোনো একটা তাল মেপে এই জয়ধ্বনি তার। মনে মনে কি বলে, বা আদৌ কিছু বলে কিনা ঈশ্বর জানেন। শুধু যখন পুরোটা বলে তখন আর রক্ষে নেই। পাড়া মাথায় উঠার জোগাড়।

সুধীর পুরোইতও এক সাগরেদ পেয়েছেন এত দিনে। নিঃসন্তান বিপত্নীক সুধীর ভট্টাচার্য এতদিন দু মুঠো ফুটিয়ে নিতেন ভোগের জন্য মন্দির লাগোয়া এই ছোট্ট পুরোহিত কোর্য়াটারে। সেটাই ভোগের পর প্রসাদ হয়ে যেত তাঁর। ঘন্টার স্থায়ী বাস নির্ধারিত হয়ে যাওয়ায় দু মুঠোকে চার মুঠো করেছেন। ভোগ হয়ে গেলে নিজেই ঘন্টার খাবার ওই বট গাছটার কাছে রেখে আসেন। একা লোকটির ভালো লাগে। ঘন্টার যদিও তাতে খুব হেলদোল কিছু নেই। মহাকালের কৃপায় তার স্থান ও অন্ন সংস্থান, দুটোই হয়েছে।

(২)

দিনকে দিন ঘন্টার এই ‘জ-অ-অ-অ-অ-য় শি-ই-ই-ই-ব বা-আ-আ বা-আ-আ’র প্রকোপ বেড়েই চলেছে। পড়ার সকলেই শঙ্কিত কখন বাজখাঁই আঘাত হানবে ঘন্টা, তা নিয়ে। ইদানিং আমার মনে হয় তার চেহারায় কেমন এক ভয়াল অথচ স্নিগ্ধ ভাব জেগে উঠেছে। কঠোর অথচ করুনা তার মুখে। আমিও কেমন যেন আকর্ষিত হচ্ছি দিনকে দিন ঘন্টার প্রতি। ‘জয় শিব বাবা’য় যেন কেমন নেশা ধরিয়ে দেয়। তার জয় শিব বাবা শুনলে কেমন যেন বুঁদ হয়ে যাই। প্রচন্ড হেঁড়ে গলা ধীরে ধীরে আমায় যেন সম্মোহন করে নেয়।

‘জয়’এর সুর যেন কোন উচ্চস্বরে যুদ্ধ শুরুর আহ্বান। অনেক্ষন ধরে তা যেন জাগিয়ে তুলছে সহযোদ্ধাদের। আর ‘শিব’ হয়ে ‘বাবা’ পর্যন্ত পৌঁছনোর সুরটা এমন একটা সুর যা নিজের ভেতরে অনুরণিত হতে থাকে বার বার। মগজের ভেতরে ধাক্কা খেতে থাকে অনবরত, হারিয়ে যায় না। মাথার ভেতর বাজতেই থাকে। পাড়ার লোকজন ওর পেছনে লাগতে ‘জয় শিব বাবা’ বলে খেপায় ঘন্টাকে। কোনো উত্তর দেয় না। আমিও কখনো সখনো বলি। বললে প্রত্যুত্তরে ‘জয়’ বলে।

কাল বিকেলে যখন বাড়ি ঢুকছি, দুর্বার গতিতে ঘন্টা নেড়ে চলেছে ঘন্টা আর সাথে ‘জয় শিব বাবা’ ধ্বনি। আমি বাড়ি না ঢুকে, ঢুকে পড়ি মন্দিরে। তখনও সন্ধ্যা হয়নি। অফিস ফেরত বা স্কুল – কলেজ ফেরত কেউ কেউ দাঁড়িয়ে পড়ছে ঘন্টার কীর্তি দেখে। জটলা করছে। কেউ বা পাস কাটিয়ে চলে যাচ্ছে। হঠাৎ কি মনে হলো, আমিও পাশের ঝুলন্ত ঘন্টাটা তার সমান গতিতে বাজাতে লাগলাম আর সাথে আউড়াতে থাকলাম ‘জ-অ-অ-অ-অ-য় শি-ই-ই-ই-ব বা-আ-আ বা-আ-আ’, ‘জ-অ-অ-অ-অ-য় শি-ই-ই-ই-ব বা-আ-আ বা-আ-আ’। তার মতো করেই। অথচ তার বিন্দু মাত্র আগ্রহ নেই আমার অংশগ্রহণে।আমারই কেমন যেন ঘোর লাগতে শুরু করেছে। মাথার ভিতর কেমন বনবন করছে আমার।

আরও পড়ুনঃ বাঙালীর গর্বের সেতু

হঠাৎ ঘন্টা আমার দিকে তাকাতেই আমি যেমন ছিটকে পড়ে গেলাম। এতো ঘন্টার মুখ নয়। এ কার মুখ? কার মুখ দেখলাম আমি। এই মুখ দেখে আমি ঘেমে নেয়ে অস্থির হয়ে যাচ্ছি। আমি পড়েই যাচ্ছি। তলিয়ে যাচ্ছি। কোথায় পড়ছি বুঝতে পারছি না। শনশন করে হাওয়া আমায় নিচের দিকে ঠেলে উপর দিকে উঠে যাচ্ছে। মন্দির দেখতে পাচ্ছি না, জটলা নেই, রাস্তা নেই। এই চাতালে দাঁড়ালে আমার বাড়ি দেখা যায়, আমার শোবার ঘর দেখা যায়। নেই, কিচ্ছুটি নেই।

শুধু আকাশ আছে আর আছে পাশে ঘন্টা। নাগাড়ে বাজিয়ে চলেছে মন্দিরের সেই ঝুলন্ত ঘন্টা আর মুখে ‘জ-অ-অ-অ-অ-য় শি-ই-ই-ই-ব বা-আ-আ বা-আ-আ’। আর আমি তার পাসেরটা। কিন্তু কিছু করতে পারছি না। হাত আমার ঘন্টা থেকে নামছেই না। এমন গতিতে বাজচ্ছে যে হাত দেখা যাচ্ছে না। কে একজন তবলচির মতো লাগছে যেন। জাকির হুসেন লাগছে কি ঘন্টা কে দেখতে, হাত দেখা যাচ্ছে না যে। নাকি শিবামনি। কালো মোটা করে দেখতে। দারুন ড্রাম, অক্টোপ্যাড বাজায়। না, তাও না। চেনা লাগছে অথচ চিনতে পারছিনা। মনে হচ্ছে ঘন্টা কিন্তু ঘন্টা নয়।

ঘন্টা আরেকবার তাকালো। আমি আরও ঘামছি। মন্দিরের স্থাপিত মহাকাল ভৈরব হয়ে গেছে ঘন্টা। এবার ঘন্টা কিছু বলছে না, শুধু চেয়ে চেয়ে হাসছে। কিন্তু কে একজন ‘জ-অ-অ-অ-অ-য় শি-ই-ই-ই-ব বা-আ-আ বা-আ-আ’ বলেই চলেছে আবহে। আমিই হয়তো। কিন্তু আমি শুনতে পাচ্ছি ঘন্টা বলছে ‘আমি মহাকাল। আমিই মহাকাল। আমি মহাকালেরও মহাকাল। আমি কালের থেকেও প্রকান্ড, প্রচন্ড। আমাতেই তুই, তোর মধ্যেই আমি রে। তোর মধ্যের আমাকে পাথর বানিয়ে রাখিস নি। আমাকে গুড়িয়ে, তোকে তুই নিয়ে চল। তুই না থাকলে আমি নেই। তুই সত্য, তুই জীবন্ত। আমি শুধু বিগ্রহ মাত্র।’

আমি কিছু বুঝতে পারছি না। আর ভাবতেও পারলাম না। মাথা গুলিয়ে যাচ্ছে। ঠান্ডা মতো অনুভব হচ্ছে। মহাশূন্যে পড়তে পড়তে ঝপ করে আমি পড়ে গেলাম এবার। ব্যাথা পেলাম না। দেখি বটগাছের বাঁধানো পারে বসে থাকা ঘন্টার কোলে এসে পড়েছি। আর সে ঠক ঠক করে কিছু একটা বলে চলেছে। ধীরে ধীরে কানে আসছে কথা গুলি। ‘বাবা উঠে পড়, অনেক বেলা হল যে। কি হল উঠে পড়। কখন থেকে ডেকে চলেছি। দরজা খোল। দিদি ঘর ঝাড় দেবে, মুছবে।’

নিউজফ্রন্ট এর ফেসবুক পেজে লাইক দিতে এখানে ক্লিক করুন
WhatsApp এ নিউজ পেতে জয়েন করুন আমাদের WhatsApp গ্রুপে
আপনার মতামত বা নিউজ পাঠান এই নম্বরে : +91 94745 60584

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here