কালে কালোত্তরে শক্তিময়ী রোকেয়া ও আজকের ভাবনা-গৌতম রায়
?ভারতীয় মুসলিম যুব সমাজের আর্থ সামাজিক উন্নতির লক্ষে প্রথম দরকার মুসলমান সমাজের সামাজিক,সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার সম্পর্কে তাঁদের স্পষ্ট ধারণা দেওয়া যাতে না তাঁদের ভিতরে কোনোদিন কোনো রকম হীনমন্যতার জন্ম হতে পারে।রবীন্দ্রনাথের উত্তরাধিকারী ভারতীয় মুসলিম যুবকরা যে জালালুদ্দিন রুমী, সেলিম চিস্তি, মীর তকী মীরের ও উত্তরাধিকারী-এটা সম্যক ভাবে তাঁদের জানানো দরকার। তাঁরা যেমন রবীন্দ্রনাথ পড়বে তেমনই তাঁদের পড়ানো দরকার আমির খসরু, ইকবাল, স্যার সৈয়দ আহমদ, কাজী আবদুল ওদুদ, রোকেয়া, সুফিয়া কামাল ইত্যাদিকে। প্রবাহমানতাকে বজায় রেখে আধুনিকতার পথে তাঁদের উত্তরীত করতে প্রয়াস নিতে হবে। তাঁদের জীবনের শুরু থেকে শেষ, অর্থাৎ; আকিকা(নামকরণ) থেকে জানাজা(মৃত্যুর পরের প্রার্থনা) র সঙ্গে ধর্মীয় রীতি নীতি আছে। তাই মাদ্রাসা শিক্ষার্থে “থিয়োজফি” নামক একটি বিষয় আছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার নয়ের দশকে থিয়োজফিকে অক্ষুন্ন রেখে মাদ্রাসা শিক্ষাকে আধুনিকীকরণ করেছিলেন। বিজ্ঞান সম্মত আধুনিক শিক্ষাক্রম মাদ্রাসা তে তখন চালু হয়েছিল। গোটা ভারতে একে মডেল করে প্রয়োগ করলে আগামীদিনের মুসলমান যুবক জীবনের মূল স্রোতের দিকে প্রথম থেকেই থাকবে। মুসলমান যুবকদের জন্যে প্রথাগত শিক্ষার পাশে কর্মমুখী শিক্ষাকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। যাতে তাঁরা অর্থনৈতিক ভাবে স্বাবলম্বী হতে পারে।বিজ্ঞানসম্মত স্বাস্থ্য বিধি তাঁদের জন্যে জরুরি। পবিত্র কোরাণ ,হাদিস নির্দেশিত বিবাহবিচ্ছেদ প্রথাই মুসলমান মেয়েদের জীবনের সামাজিক সঙ্কট দূর করতে পারে। মুসলমান সমাজের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত মুক্তমনা মানুষজনেরাই হোক তাঁদের সমাজের পরিচালক। আজ মুসলমান সমাজ যে ভাবনা ভাবছেন, বিশ শতকের গোড়াতে তেমনটা ভেবেছিলেন বেগম রোকেয়া।
প্রথাগত শিক্ষার সুযোগ পাননি অভিজাত মুসলমান পরিবারে জন্মানো রোকেয়া। অবরোধের কী অন্ধকারে তানর শৈশব কেটেছিল সেসবের টুকরো টুকরো বিবরণ তিনিই রেখে গিয়েছেন তাঁর “অবরোধবাসিনী ” তে। বাইরের পুরুষদের সামনে বের হওয়া তো দূরের কথা, অপরিচিত মহিলাদের সামনেও প্রকাশ্যে আসবার উপায় ছিল না রোকেয়ার শৈশবে।সেই অবরোধের অচলায়তনের ভিতরে বসেই তিনি বড়ভাইদের পড়াশুনা দেখে নিজে খুব তাগিদ অনুভব করতেন পড়াশুনা শেখবার। অথচ পরিবারের রক্ষণশীলতায় সে উপায় ছিল না। হিন্দু সমাজে সেই সময়ে যেরকম মেয়েরা পড়াশুনা শিখলে তাদের জীবনে অকাল বৈধর্ব্য নেমে আসবে বলে প্রচলিত বিশ্বাস ছিল, তেমনই বহু নেতিবাচক ধারণা মুসলমান সমাজেও ছিল স্ত্রী শিক্ষা নিয়ে। নিষেধের সেই বেড়াজাল অতিক্রম করে রোকেয়া নিজের চেষ্টাতে পড়াশুনা শিখেছিলেন ধীরে ধীরে। দিনের প্রকাশ্য আলোতে পড়াশুনা শেখা সম্ভব ছিল না। তাই রাতের বেলা বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে পড়লে মোমবাতি জ্বেলে পড়তে বসতেন রোকেয়া। বড়দাদারা কোনো কোনো সময়ে সাহায্য করতেন। আর পেতেন দিদি করিমুন্নেসার সাহায্য। রোকেয়ার জীবনে এই দিদি করিমুন্নেসার যথেষ্ট ভূমিকা ছিল। দিদির বিয়ে হয়েছিল বিখ্যাত দেলদোয়ারের জমিদার বাড়িতে। সেখানে বেশ কিছু দিন কর্মসূত্রে নিয়োজিত ছিলেন মীর মোশাররফ হোসেন। করিমুন্নেসার পুত্ররা ইতিহাসে গজনভী ভাই বলে খ্যাত। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে তাঁরা ব্রিটিশ বিরোধী উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের রীতি অনুযায়ী বেশ ছোট বয়সেই বিয়ে হয় রোকেয়ার। তাঁর স্বামী সৈয়দ শাখাওয়াত হোসেনের প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর পর রোকেয়ার সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। তাঁর প্রথম স্বামীর ছেলেমেয়েও ছিল। পরবর্তীকালে তারা শাখাওয়াত হোসেনের মৃত্যুর পর রোকেয়ার সঙ্গে বেশ খারাপ ব্যবহার করেছিল, যার জন্যে রোকেয়া বাধ্য হয়েছিলেন স্বামীর গৃহ ভাগলপুর ছাড়তে। জন্মস্থান দিনাজপুরের পায়রাবন্দের পারিবারিক পরিমন্ডলে কঠোর লড়াই করে বিদ্যাচর্চা করতে হলেও বিয়ের পর স্বামীর কাছ থেকে বিদ্যাচর্চার জন্যে যথেষ্ট উৎসাহ প্রথম থেকেই রোকেয়া পেয়েছিলেন। রোকেয়ার স্বামী নিজের ছাত্র জীবনে উনিশ শতকের নবজাগরণের অন্যতম প্রতিভূ ভূদেব মুখোপাধ্যায়ের পরিবারের যথেষ্ট সাহচার্য পেয়েছিলেন। ভূদেব পুত্র মুকুন্দরাম ছিলেন শাখাওয়াত হোসেনের সহপাঠী। শাখাওয়াথ হোসেনের জীবনবাবসানের পর রোকেয়ার শিক্ষাব্রতে মুকুন্দরাম নানা রকমের সহযোগিতা করেছিলেন। সে যুগের রীতি অনুযায়ীই রোকেয়ার সঙ্গে তাঁর স্বামী শাখাওয়াত হোসেনের বয়সের ফারাকটা অনেকটাই ছিল। শাখাওয়াত হোসেন বিবাহের কিছুটা পর থেকেই বেশ অসুস্থ ছিলেন। বহুমূত্র রোগে ভুগতেন।বিদূষী রোকেয়া কিন্তু নবিজের হাতে আসুস্থ স্বামীর যাবতীয় সেবা শূশ্রুষাই কেবল নয়, তাঁর মলমূত্র পর্যন্ত পরিস্কার করতেন। নারীর স্বাধিকার যে নারী পুরুষের ভিতর পারস্পরিক সংঘাতের পরিবেশে আসবে না-রোকেয়া তাঁর চিরন্তন ভারতীয় নারীর ভূমিকা পালনের ভিতর দিয়ে তা দেখিয়ে গিয়েছেন। সংঘাতের পরিবেশ রচনার ভিতর দিয়ে সমানাধিকার নয়, বেশি অধিকারের বুঝি বা একটা ভ্রান্ত পথে হাঁটতে কেউ কেউ প্রয়াসী হন।তাঁদের সেই প্রয়াসের অন্তঃসার শূন্যতাও পরিস্কার হয়ে যায় রোকেয়া চিরকল্যাণময়ী জীবন যাপনের ভিতর দিয়ে। বিশ শতকের গোড়ার দিকে হিন্দু-মুসলিম উভয় ভারতীয় সমাজের ভিতরেই ঘরের বউ সাহিত্যচর্চা করছে তা বুঝি বা ঠাকুরবাড়ির মতো একান্ত ভাবেই হাতে গোনা দুটো একটা পরিবারে দেখতে পাওয়া যেত। হিন্দু সমাজে ঠাকুরবাড়ির উদাহরণ থাকলেও মুসলমান সমাজে তেমন একটা ছিল না। কুমিল্লার নবাব ফয়জুন্নেসা নিজে বিদ্যানুরাগী ছিলেন। তা বলে তাঁর স্বামী আদৌ পত্নীর বিদ্যানুরাগ বিষয়ে উৎসাহী ছিলেন না যে কয়েকদিন তাঁরা একসাথে দিন কাটিয়েছিলাম সেই কটা দিনে। নবাব ফয়জুন্নেসার বিদ্যানুরাগ বা আলিগড়ে স্যার সৈয়দের উদ্যোগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার ও দুই বছর আগে বাংলার কুমিল্লাতে মেয়েদের জন্যে ইস্কুল প্রতিষ্ঠা(অধ্যাপক অম্লান দত্ত বর্তমান নিবন্ধকারকে বলেছিলেন, তাঁর ছোটবোন কুমিল্লাতে ফয়জুন্নেসার ইস্কুলের ছাত্রী ছিলেন)–এসবই ছিল কার্যত ফয়জুন্নেসার একক উদ্যোগের ফসল। রোকেয়াও তাঁর আলোকবর্তিকা থেকে আলো বিতরণের কাজটি একাই করেছিলেন। তবে প্রথম জীবনে বিদ্যানুরাগের ক্ষেত্রে, সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রে তিনি তাঁর স্বামীর কাছ থেকে পূর্ণ সহযোগিতাও পেয়েছিলেন। নারী -পুরুষের এই পারস্পরিক সহযোগিতার বিষয়টি রোকেয়ার জীবনচর্চাতে যেমন বিদ্যমান ছিল,তেমনই রোকেয়ার সাহিত্যে,তাঁর শিক্ষা বিস্তার থেকে সমাজসেবার কাজে সম্যকভাবে ছাপ ফেলেছিল।সমসাময়িক বিশিষ্ট মানুষদের সঙ্গে কোনোরকম অহেতুক সংঘর্ষে রোকেয়া কখনো যাননি। তা বলে সমাজ যদি লিঙ্গ বৈষম্যের দোহাই দিয়ে কোনো কিছু জোর করে রোকেয়ার উপরে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতো–তাহলে সেটা মেনে নেওয়ার মতো মানুষ ও রোকেয়া ছিলেন না।
প্রখর যুক্তিবোধ সম্পন্ন মানুষ ছিলেন তিনি। তবে তাঁর যুক্তিবোধ কখনোই বাস্তবতার জমিকে অস্বীকার করে ছিল না। স্বামীর জীবদ্দশাতে “মতিচূড়ে”-র একটি খন্ড প্রকাশিত হৎেছিল। স্বামীর উদ্যোগেই শিখেছিলেন ইংরেজি ভাষা। সেই বিদেশি ভাষা আত্মস্থ করেই তিনি লেখেন “সুলতানাজ ড্রিম”। এই বইটিকে বাংলায় এবং বাঙালির লেখা প্রথম কল্প বিজ্ঞানের বই বলা যেতে পারে।
WhatsApp এ নিউজ পেতে জয়েন করুন আমাদের WhatsApp গ্রুপে
আপনার মতামত বা নিউজ পাঠান এই নম্বরে : +91 94745 60584