অবশেষে বঙ্কিমচন্দ্র… অশোক মজুমদার

0
137

 

লেখক- বিশিষ্ট সাংবাদিক

বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠ ছিল আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের অনুপ্রেরণা। এই উপন্যাসের বন্দে মাতরম্ কবিতাটি প্রথম দুই ছত্র আমাদের জাতীয় সঙ্গীত। আগামীকাল ২৭শে জুন সেই বঙ্কিমচন্দ্রের জন্মদিনে কলকাতায় তাঁকে নিয়ে প্রথম জাতীয় স্মারক বক্তৃতা দিতে আসছেন ধর্মের ভিত্তিতে দেশের মানুষকে ভাগ করা; দেশের পশ্চাদপদ সম্প্রদায়কে অধিকার দিতে না চাওয়া; নীরব মোদীর মত প্রতারকদের বাইরে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেওয়া মোদী – অমিত জুটির অমিত শাহ। বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহ সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রকে নিয়ে কলকাতায় লেকচার দিচ্ছেন, আমাদের শহর কি তা কোনদিন কল্পনা করতে পেরেছিল? স্বাধীনতার পর বিডন স্কোয়ারের কংগ্রেস অধিবেশনে বন্দে মাতরম্ গেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ, বন্দে মাতরম্ বলে পুলিশের গুলিতে প্রাণ দিয়েছিলেন মাতঙ্গিনী হাজরা – সেই গানের স্রষ্টার সঙ্গে অমিত- মোদীর মত মানুষদের কি করে মেলাবেন পশ্চিমবঙ্গবাসী?

তারা শুধু বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়দের মত নাম ব্যবহার করে বাংলার রাজনীতিতে তাদের একটা ব্র্যান্ড তৈরি করার চেষ্টা করছেন। প্রশ্ন হচ্ছে এতদিন পরে হঠাৎ পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি নেতারা বঙ্কিমচন্দ্র, শ্যামাপ্রসাদকে নিয়ে পড়লেন কেন? তার কারণ এরা ভালভাবেই জানেন পশ্চিমবঙ্গের মানুষদের কাছে দিলীপ, রাহুল, মুকুল, শমীক, লকেট, রূপাদের কোন গুরুত্ব নেই। তাই বাধ্য হয়েই তাদের অমিত শাহর মত একটা বড় ধরণের নেতাকে ধরতে হয়েছে। জাতীয় স্মারক বক্তৃতার আসরে অন্যান্য যারা আছেন তাদের মধ্যে অধ্যাপক অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য পণ্ডিত মানুষ ও পরিচিত নাম। রয়েছেন অন্যান্য বুদ্ধিজীবীরা।

বিজেপির অবস্থা দেখে আমার বড় কষ্ট হয়। ২০১৯শে লোকসভা ভোটে কি হবে তার চিন্তা সত্যি তাদের পাগল করে দিয়েছে। কিছুদিন আগেই পশ্চিমবঙ্গের গ্রামের গরীবদের বাড়িতে গিয়ে অমিত শাহর পাত পেতে খাওয়ার ছবি আমরা টিভি, খবরের কাগজে আর সোশ্যাল মিডিয়ায় ভেসে উঠতে দেখেছিলাম। জানছিলাম কে কি কি খাবেন, কি কি রান্না হয়েছিল তার বর্ণনা। তার বাড়িতে এসে যেন ধন্য করে দিয়েছেন এমন ছবি। গরীব মানুষদের নিয়ে এই নির্মম ঠাট্টা অমিত শাহরাই করতে পারেন। খাওয়াদাওয়া সেরে এবার তারা হাত বাড়িয়েছেন বাংলার সংস্কৃতির দিকে। এবার শুরু হয়েছে বিজেপির সংস্কৃতি সফর।

অমিত শাহ ও তার ম্যানেজারেরা ভুলে যাচ্ছেন ওপর থেকে বোঝা না গেলেও বাংলার মানুষ নিজেদের সাহিত্য ও সংস্কৃতির ব্যাপারে খুবই স্পর্শকাতর। অমিতের বঙ্কিম বন্দনায় এখানে চিড়ে ভিজবে না। ভারতের সব রাজ্যে গেরুয়া পতাকা উড়লেও সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা পশ্চিমবঙ্গ কিন্তু সবুজই থেকে যাবে। সিপিএম, কংগ্রেস আপনাদের যত সহায়তাই করুক না কেন এখানে খাপ খুলতে পারবেন না আপনারা।

বিজেপির একটা মুশকিল আছে। টাকা ছড়িয়ে বিজেপি অনেক কিছু কিনতে পারলেও কিন্তু এ রাজ্যের বুদ্ধিজীবীদের কিনতে পারছে না। তাই অনাহূত অতিথিদের মত চলে যাচ্ছেন তাদের বাড়িতে। বাঙালির ভদ্রতার সুযোগ নিচ্ছেন তারা। কিন্তু এখনও পর্যন্ত যা দেখছি রাহুল, শমীকদের মত নেতাদের খুব একটা পাত্তা দিচ্ছেন না বিদ্বজনেরা। কিন্তু তাতে কী হবে? সামাজিক ও রাজনৈতিক গুরুত্বহীন এসব নেতারা রাজ্যের বুদ্ধিজীবী মহলে তাদের প্রভাব প্রমাণের জন্য সকালের চা পর্ব শেষ করেই কোন দিন চলে যাচ্ছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের বাড়ি তো কোন দিন মনোজ মিত্র-র বাড়ি। কোন দিন রুদ্রপ্রসাদ তো কোন দিন অশোক গাঙ্গুলির বাড়ি। তাদের এই জনসংযোগ যাত্রায় কোন ফল হোক বা না হোক খবরের কাগজ, টিভি আর সোশ্যাল মিডিয়ায় ছবির কোন কামাই নেই। আগন্তুকদের বাড়িতে ভদ্রতার খাতিরেই বসতে বলা, তাদের সঙ্গে দু চারটে কথা বলাকে বিরাট একটা সাফল্য বলে ধরে নিচ্ছেন ন্যুনতম এক্সপোজারবিহীন এসব বিজেপি নেতারা। যাদের কাছে তারা গেছেন তাদের ব্যক্তিত্ব ও কাজের মত মাপসই নেতা রাজ্য বিজেপির ভাঁড়ারে যে নেই তা তাদের প্রতিনিধিদের দেখেই বোঝা যাচ্ছে।

কবি, সাহিত্যিক, অভিনেতা, নাট্যকার ও বিদ্বজনেরা এদের নিয়ে কি করবেন তা একান্তই তাদের নিজেদের ব্যাপার। আমার শুধু ছোট্ট একটা কথা বলার আছে। রাজনৈতিক মতপার্থক্য থাকলেই বা মতের অমিল হলেই যে তিনি বন্ধু হবেন না এটা পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি নয়। এই শহরে এখনও কংগ্রেস, বিজেপি, সিপিএম সব সমর্থকই একসঙ্গে গল্প করেন, আড্ডা মারেন। আমারও অনেক সিপিএম, কংগ্রেস, বিজেপি বন্ধু আছেন তারা আমার বাড়িতে আসেন, আড্ডা মারেন, গল্প করেন। কিন্তু আপনাদের বাড়িতে যাওয়া এসব নেতারা কেউই আপনাদের বন্ধু বা পূর্বপরিচিত নয়। একটা বৃহৎ রাজনৈতিক পরিকল্পনার অঙ্গ হিসেবেই তারা আপনাদের বাড়িতে আসছেন, সেটাকে জনসংযোগ যাত্রা বলে প্রচারও করছেন। এদেরকে আপনাদের আশকারা দেওয়াটা আমার একটু অদ্ভুত বলে মনে হচ্ছে। কেন না আপনারা তো বোকাও নন, উন্মাদও নন। আপনাদের পাশে বসে থাকা এসব স্বঘোষিত নেতাদের হাসিমুখই কিন্তু অমিত মোদীর খুনি মুখটিকে আরও মানবিক করে তুলতে সাহায্য করছে। একটু ভেবে দেখবেন।

আমাদের মুখ্যমন্ত্রী সবসময় আপনাদের পাশে থাকেন, আপনাদের পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করেন। লেখক, শিল্পী, সাহিত্যিকসহ সবধরণের লোকশিল্পীদের সাহায্য করে দিদি তাদের শিল্পকর্মকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করেছেন। তবুও আপনাদের এরকম আচরণের ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া সত্যিই খুব কঠিন। কিছু মনে করবেন না, আপনারা সব দরজাই খোলা রাখেন। তাই যে কোন দিকে চলে যাওয়ার স্বাধীনতা ও সুযোগ আপনাদের অনেক বেশি, এমন ঘটেও। আমার সাংবাদিক জীবন শুরু হয়েছিল সিপিএম আমলে। সিপিএম সমর্থক অনেক বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে দিদির খুবই ভাল সম্পর্ক ছিল, এখনও আছে। বামফ্রন্টের কাজে বীতশ্রদ্ধ হয়ে এদের অনেকেই দিদির পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। যোগ্যতা অনুযায়ী সন্মান দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আপনাদের প্রতিভা ও গুণের স্বীকৃতি দিয়েছেন। তার কোন ভুল ত্রুটি থাকলে অবশ্যই সমালোচনা করুন। তবে বিজেপি যেন আপনাদের ভদ্রতার সুযোগ না নেয়। তাহলে সেটা খুব দুঃখের ব্যাপার হবে। এই সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা বাংলায় বিজেপি ঢোকার রাস্তা করে দেওয়া মানে বাংলার মানুষদেরকে চূড়ান্ত দুর্গতির দিকে ঠেলে দেওয়া। বিজেপির সঙ্গে আর যাই হোক জাতীয়তাবাদ ও বঙ্কিমচন্দ্রের কোন যোগাযোগ নেই।

 

নিউজফ্রন্ট এর ফেসবুক পেজে লাইক দিতে এখানে ক্লিক করুন
WhatsApp এ নিউজ পেতে জয়েন করুন আমাদের WhatsApp গ্রুপে
আপনার মতামত বা নিউজ পাঠান এই নম্বরে : +91 94745 60584

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here