বাংলা সাহিত্যাকাশের ধ্রুবতারা সুনীল

    0
    736

    *বাংলা সাহিত্যাকাশের ধ্রুবতারা সুনীল*

    -সংহিতা দেব

    ★★★★★★★★★★★★★★★★★★★★★

    বাঙালী জনমানসে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এক মুক্তোচিন্তার নাম।২৩সে অক্টোবর আমাদের সেই দিন যেদিন আমরা হারিয়ে ফেলেছি আমাদের সাহিত্য জগতের এক কর্ণধারকে, আমরা আমাদের রত্ন ভাণ্ডারে সেই অভাব পূরণ করতে পারিনা অন্য কারোর বিনিময়ে। আজ তাঁর প্রয়াণ দিবসে তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করে আমরা এইটুকু বলতেই পারি,ক্ষণস্থায়ী শরীরে হয়তো বা হারিয়েছি তাঁকে,কিন্তু তিনি চিরস্থায়ী আমাদের চেতনে অবচেতনে। রবি ঠাকুরের ভাষায় তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে বলতেই পারি আমরা, “জীবনমরণের সীমানা ছাড়ায়ে,বন্ধু হে আমার রয়েছ দাঁড়ায়ে।” তাঁর অপরিসীম অবদান তাঁকে নিয়ত জীবত রেখেছে জনমানসে।বাংলা সাহিত্য জগতে প্রথিত যশা সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় অন্যতম ব্যক্তিত্ব হিসাবে বিশ্বের দরবারে বাংলা ভাষা-ভাষীর জনগোষ্ঠীর কাছে বিশেষ ভাবে পরিচিত ছিলেন।তিনি কবি, ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, সম্পাদক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট হিসাবে অজস্র রচনা উপহার দিয়েছেন। আধুনিক বাংলা কবিতার জীবনানন্দ-পরবর্তী পর্যায়ের অন্যতম প্রধান কবি তাঁকেই মনে করা হয়।

    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ১৯৩৪ সালের ৭ই সেপ্টেম্বর জন্ম গ্রহণ করেন বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলার মাদারিপুর সাবডিভিশনের মাইকপাড়া গ্রামে।সুনীলের জন্মদিন ১৯৩৪ সালের ৭ই সেপ্টেম্বর ।চার বছর বয়সেই তিনি কলকাতায় চলে আসেন।বাংলা নিয়ে পড়াশুনা করেছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। বাবা ছিলেন স্কুল শিক্ষক। ছেলে শিক্ষকতা করুক মা বাবা তা চান নি।বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষে টিউশনি দিয়ে কর্মজীবন শুরু। তারপর থেকে সাংবাদিকতায়। নানা অভিজ্ঞতার পর আনন্দবাজারে যোগ দেন।ছোটবেলায় বাবা তাঁকে টেনিসনের কাব্যগ্রন্থ থেকে রোজ একটি করে কবিতা অনুবাদ করতে দিয়েছিলেন।এই তাঁর হাতে খড়ি।তারপর এই অনুবাদ একঘেঁয়ে হয়ে উঠলে তিনি সরচিত কাব্যের প্রতি অনুরাগ প্রকাশ করেন।প্রেমিকাকে লিখিত পত্র দেশ পত্রিকা প্রথম প্রকাশিত করে।তারপর কয়েকজনের সাথে মিলিত ভাবে “কৃত্তিবাস” নামে এক কবিতার পত্রিকায় সম্পাদনা শুরু। ১৯৫৮ তে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ “একা এবং কয়েকজন”।পরবর্তীকালে “আমার স্বপ্ন”,”বন্দী জেগে আছো”,”এসেছি দৈব পিকনিকে”, “সেই মুহূর্তে নীরা”,”হঠাৎ নীরার জন্য”,”নীরা হারিয়ে যেও না ” বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ।
    তাঁর প্রথম উপন্যাস “আত্মপ্রকাশ” ১৯৬৬ সালে শারদীয়া দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। বিশাল রচনা সম্ভারের মধ্যে আমিই সে,অর্জুন,পূর্বপশ্চিম,প্রথম আলো,জীবন যে রকম ইত্যাদি প্রসিদ্ধ। কিশোর সাহিত্যের মধ্যে প্রথম উপন্যাস “ভয়ংকর সুন্দর”।শিশু সাহিত্যে তিনি “কাকাবাবু-সন্তু” নামক জনপ্রিয় গোয়েন্দা সিরিজের রচনাও করেন।এছাড়াও সবুজ দ্বীপের রাজা,সত্যি রাজপুত্র বিখ্যাত।নাটকও রয়েছে কিছু খ্যাত ; রাজারাণী ও রাজসভায় মাধবী, মালঞ্চমালা,প্রাণের প্রহরী, স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতাজী ইত্যাদি।আত্মপরিচয় মূলক বই “অর্ধেক জীবন”। তাঁর “অরণ্যার দিনরাত্রি ” ও “প্রতিদ্বন্দ্বী ” উপন্যাস দুটি চলচিত্রকার সত্যজিৎ রায় সিনেমায় রূপ দান করেন। সাহিত্য একাদেমি ও পশ্চিমবঙ্গ শিশুকিশোর একাদেমির সভাপতিত্ব করেন। আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের প্রধান মি.পলেন এর সাথে সুনীলের সঙ্গে ঘনিষ্টতা হয়। সেই সূত্রে মার্কিন মুলুকে পাড়ি দেন ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসাবে । ডিগ্রি লাভের পর ঐখানেই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপগ্রন্থাগারিক হিসাবে কিছুদিন কাজ করেন তিনি।

    নীললোহিত,সনাতন পাঠক,নীল উপাধ্যায় ছদ্মনামে পরিচিত ছিলেন।
    নীললোহিতের মাধ্যমে সুনীল নিজের একটি পৃথক সত্বা তৈরি করেছিলেন। নীললোহিতের সব কাহিনিতেই নীললোহিতই কেন্দ্রীয় চরিত্র। আত্মকথার ভঙ্গিতে সেই কাহিনীকার । সব কাহিনিতেই তার বয়স সাতাশ। সাতাশের বেশি তাঁর বয়স বাড়ে না। বিভিন্ন কাহিনিতে দেখা যায় নীললোহিত বেকার। নীললোহিতের বহু কাহিনিতেই দিকশূন্যপুর বলে একটি জায়গার কথা শোনা যায়। যেখানে বহু শিক্ষিত সফল মানুষ কিন্তু জীবন সম্পর্কে নিষ্পৃহ একাকী।

    “সেই সময়”তাঁর এক অন্যতম জনপ্রিয় উপন্যাস।এই উপন্যাসে তিনি তুলে ধরেছেন একদিকে শঠতা, ভণ্ডামি ও লাম্পট্য, আর একদিকে সমাজবোধের নতুন চেতনা। একদিকে সাহেবিয়ানার অনুকরণ আর একদিকে প্রাচীন বোধ পুনরুদ্ধারের চেষ্টা। একদিকে বিধবাবিবাহ ও নারীশিক্ষার আন্দোলন, অন্যদিকে গণিকা-ভোগ বা পায়রা ওড়ানোর জন্য লক্ষাধিক ব্যয়।কলকাতার বাবুসমাজ সুরা, নারী,বুলবুলি বিলাসে মগ্ন আর যুবকেরা বিদেশি অনুকরণে মত্ত, ধর্মসংস্কার,মধ্যবৃত্ত শ্রেণীর নবউন্মেষ। মুখ্যচরিত্র ‘সময়’। তিনি নিজে লিখেছেন, “সময়কে রক্ত মাংসে জীবিত করতে হলে অন্তত একটি প্রতীক চরিত্র গ্রহণ করতে হয়। নবীনকুমার সেই সময়ের প্রতীক।তার জন্মকাহিণী থেকে তার জীবনের নানা বৈপরীত্য, শেষদিকে এক অচেনা যুবতির মধ্যে মাতৃরূপ দর্শন এবং অদ্ভুত ধরণের মৃত্যু,সবই সেই প্রতীকের ধারাবাহিকতা।আশা করি বিশদ ভাবে বলার প্রয়োজন নাই।প্রয়োজনীয় কথা এই যে,নবীনকুমারের চরিত্র এক অকাল মৃত অসাধারণ ঐতিহাসিক যুবকের একটা আদল আছে। অন্য কোন প্রসিদ্ধ পুরুষের নাম আমি বদল করিনি….।” একথা ঠিকই।মাইকেল, বিদ্যাসাগর,ডিরোজিও,হেয়ার সাহেব,দেবেন ঠাকুর… সমস্ত ঊনবিংশ শতাব্দীই যেন চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে উঠেছে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় প্রাণটা যেন প্রতিষ্ঠা করেছেন।বঙ্কিম ও একাদেমী পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছে এই গ্রন্থ।
    পূর্বপশ্চিম সুনীল আর এএক ব্যতিক্রমী উপন্যাস।বিশাল ক্যানভাসে অঙ্কিত এই উপন্যাস এপার ও ওপার বাংলার বহুঘটনাকে ছুঁয়ে রয়েছে।দেশ বিভাগ নিয়ে লেখা স্মরণীয় এই উপন্যাস। দুই বাংলার সমান্তরাল বাঙালী জীবন নিয়ে আগে বা পরে এই রকম কোন উপন্যাস রচিত হয়নি।একদিকে নেহেরুর মৃত্যু,ভারত পাকিস্থান যুদ্ধ,লালবাহাদুরের অকাল প্রয়াণ,ইন্দিরার অভ্যুত্থান,তরুন সমাজের জেগে ওঠা বিপ্লব,উগ্রপন্থী রাজনীতি,বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ,অপরদিকে ভাষা আন্দোলনের পরবর্তী সময়,,মুক্তি আন্দোলন, স্বাধীনতা পরবর্তী যুবসমাজের হতাশা,মুজিব হত্যা এই সমস্ত কিছুকে ছুঁয়ে এই উপন্যাসের ধারাবাহিকতা।পূর্বপশ্চিম বলতে কেবল দুই বাংলাই নয় পূর্ব গোলার্ধ ও পশ্চিম গোলার্ধের বৃহত্তম পটভূমিও এর মধ্যে আলোচিত হয়েছে।

    ২০০২ সালে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কলকাতা শহরের শেরিফ নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৭২ ও ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে আনন্দ পুরস্কার এবং ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কারে সম্মানিত হন । । যদিও তিনি ও তাঁর স্ত্রী ‘গণদর্পণ’কে মরণোত্তর দেহ দান করে যান তবু সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের একমাত্র পুত্রসন্তান সৌভিক গঙ্গোপাধ্যায়ের ইচ্ছেতে তাঁর দেহ দাহ করা হয়।২৩ অক্টোবর ২০১২ তারিখে হৃদযন্ত্রজনিত অসুস্থতার কারণে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

    তিনি বাংলা সাহিত্যের অন্যতম ব্যক্তিত্ব হিসাবে বিশ্বের দরবারে বাংলা ভাষা-ভাষীর জনগোষ্ঠীর কাছে বিশেষ ভাবে পরিচিত ছিলেন।তিনি কবি, ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, সম্পাদক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট হিসাবে অজস্র রচনা উপহার দিয়েছেন। তিনি আধুনিক বাংলা কবিতার জীবনানন্দফ -পরবর্তী পর্যায়ের অন্যতম প্রধান কবি তাঁকেই মনে করা হয়।বাংলা সাহিত্যজগতের তারামন্ডল অজস্র নক্ষত্রপূর্ণ হলেও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ধ্রুবতারা হয়ে ছিলেন।

    নিউজফ্রন্ট এর ফেসবুক পেজে লাইক দিতে এখানে ক্লিক করুন
    WhatsApp এ নিউজ পেতে জয়েন করুন আমাদের WhatsApp গ্রুপে
    আপনার মতামত বা নিউজ পাঠান এই নম্বরে : +91 94745 60584

    LEAVE A REPLY

    Please enter your comment!
    Please enter your name here