ব্যক্তি সর্বস্ব এযুগে বরুণের বিশ্বাস সমাজের শিক্ষা

    0
    947

    মীর রাকেশ রৌশান

    জন্মক্ষণে সাথে করে এনেছিল মৃত্যুহীন প্রাণ।অক্লেশে সেই প্রাণ সে দান করে গেল।কিন্তু প্রতিদিনের প্রাত্যহিক জীবনে আমরা কি পারছি সেই যাপনের বিশ্বাস।তাঁর জীবন যদি আমাদের সাতে পাঁচে নেই জীবনে আলোড়নের স্রোত তুলতে না পারে তবে আরশির সামনে দাঁড়িয়ে বলতে পারবো তো ‘আমি মানুষ’? তাঁকে নিয়ে সিনেমা হয় সিরিয়াল হয় কিন্তু জীবন বোধে মননে বরুণের বিশ্বাস যদি অম্লান রাখতে না পারি তবে সমাজের নোংরা আর্বজনার দুর্গন্ধে ক্লেদাক্ত হবে মনুষ্যত্ব।

    বরুণ বিশ্বাসের লেখা কবিতা

    ১৯৭২ সালে ১২ই সেপ্টেম্বর উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলায় জন্ম নিয়েছিল সেই প্রতিবাদী শিক্ষক বরুন বিশ্বাস।স্কুল,কলেজ,বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশুনো শেষ করে ওয়েস্টবেঙ্গল সিভিল সার্ভিস পরিক্ষায় উত্তীর্ণ হন।কিন্তু পেশাগত ভাবে বরুণ বেছে নেয় শিক্ষকতার জীবন।১৯৯৮ সালে কলকাতার মিত্র ইনস্টিটিউশনে শিক্ষকতার কাজে যোগদান করেন।

    বরুণ বিশ্বাসের লেখা প্রতিবাদ পত্র

    ছাত্র জীবন থেকেই বরুণ প্রতিবাদী হিসেবে এলাকায় পরিচিত।অন্যায় মেনে নেওয়ার এই যুগে বরুণ স্রোতের বিপরীতে হাঁটতেন।শুধু প্রতিবাদ নয় অজুহাত দিয়ে যখন এ সমাজ পাশ কাটায় মানবিক দায়িত্ব থেকে তখন বরুণ নিজের কাঁধে তুলে নেয় সব দায়ভার। গাইঘাটা অঞ্চলে প্রতিবছরই বন্যা দেখা দিত।এই নিয়ে ২০০০ সালে ইচ্ছামতী ও যমনার নদীর বন্যার হাত থেকে মুক্তি পেতে এলাকার মানুষকে একত্রিত করে খাল তৈরি করার জন্য আন্দোলন শুরু করেন।প্রথম দিকে এলাকার নেতারা বিরোধিতা করলেও পরে সেই খাল তৈরি করার জন্য বাধ্য হয়।এই আন্দোলন থেকেই বরুণের পথচলা শুরু।

    সামাজিক সাংস্কৃতিক আন্দোলনে বরুণ বিশ্বাস

    তৎকালীন গাইঘাটার সুটিয়া অঞ্চলকে বলা হত ‘ধর্ষন গ্রাম’।বরুণ বিশ্বাসের লেখা প্রতিবাদী মঞ্চের সেই লিফলেটেই বলা আছে বাস্তব অবস্থার চিত্র, ” কুখ্যাত সুশান্ত চৌধুরী ও বীরেশ্বর ঢালীর নেতৃত্বে কুড়ি পঁচিশজনের একটি সমাজবিরোধী দল কয়েক বছর ধরে খুন জখম,তোলা আদায় জুলুম,নারী নির্যাতন এবং ধর্ষণের মাধ্যমে সমগ্র সুটিয়ে অঞ্চলকে একটি নরকে পরিণত করে।

    বরুণ বিশ্বাসের আঁকা ছবি

    বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের প্রশ্রয় ও মদতে তাদের অত্যাচারের নারকীয় রূপ মধ্যযুগীয় বর্বরতা এবং বৃটিশ অত্যাচারকেও ছাপিয়ে যায়।”
    ২০০০-২০০২ সালের মধ্যে সুটিয়া এলাকায় প্রায় ৩৩টি ধর্ষণ ও ১২টি খুন হয়।এই অপরাধের বিরুদ্ধে বরুণ বিশ্বাস এলাকার প্রতিবাদী মানুষদের একত্রিত করে গণ আন্দোলন শুরু করেন।সমস্ত অপরাধীদের গ্রেপ্তার ও শাস্তির দাবিতে মিছিল করেন।সুটিয়া অঞ্চলে এই আন্দোলন ক্রমে একটি মঞ্চের আকার নেয়,যা ‘সুটিয়া গণধর্ষন প্রতিবাদী মঞ্চ’নামে পরিচিত ছিলো।২৭ জুলাই, ২০০২ সালে এই মঞ্চে প্রথম বরুণ সমাজবিরোধীদের চোখে চোখ রেখে অন্যায়ের বিরুদ্ধে তোলেন প্রতিবাদের কন্ঠ।বলেন “আমরা যদি আমাদের মা,বোন,স্ত্রী ও মেয়েদের নিরাপত্তা দিতে না পারি,তবে আমরা সভ্য সমাজে বাস করার যোগ্য নই।আমাদের যদি ধর্ষণকারীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সাহস না থাকে,তাহলে আমাদের শাস্তি পাওয়া উচিত….আসুন আমাদের সঙ্গে যোগ দিয়ে আমাদের মহিলাদের সম্মান রক্ষা করুন..”।সেই থেকে শুরু হয় মঞ্চের কাজ,এলাকার ধর্ষিতাদের পাশে থাকে তাদের মানসিক শক্তি জুগিয়ে প্রতিবাদের সেনানী করে তোলেন। পুলিশকে বাধ্য করেছেন তার দায়িত্ব পালনে।তার ফলে অপরাধীদের পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়ায় বরুণ বিশ্বাস।৫ ই জুলাই ২০১২ সালে মিত্র ইনস্টিটিউশনের বাংলার শিক্ষক বরুণ বিশ্বাসকে কোলকাতা থেকে বাড়ি ফেরার পথে গোবরডাঙ্গা স্টেশনের কাছে পশ্চাৎ থেকে গুলি করে হত্যা করে দুষ্কৃতিরা।রক্তে যদি জীবনের ফুল ফোটে,ত্যাগের মধ্যে যদি থাকে পরম পাওয়া,তাহলে বরুণ মরে নি।বরুণের জীবন যেন আকাশবাণী করে গেছে,’এ কোন মৃত্যু জীবনের চেয়েও সত্যি।’সন্তান হারানোর বেদনা ডুকরে ওঠে নি মা গীতাঞ্জলি বিশ্বাস বরং যে অম্লান আগুন বুকের মধ্যে জ্বেলে বরুণ দুষ্কৃতিদের বুঝিয়ে দিয়েছিলেন অন্যায় নয় ন্যায়ের পথ পথই সত্য সেই সুরকে যেন আরো গভীর করে তুললেন।

    শেষ যাত্রায় বরুণ বিশ্বাস

    সন্তান হারানোর যন্ত্রনা বুকে চেপে বললেন,”আমি তো মা।ছেলের জন্য আমি যদি আছাড়ি পিছাড়ি করে কাঁদি,তাহলে অন্য মা ভয় পাবে।কেউ তার ছেলেকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করে বরুণ হতে বলবে না।আর একটা বরুণ যে তৈরি হবে না বাবা।” বরুণ বিশ্বাসের হত্যাকান্ডের পর এক অভিভাবিকা দীপা মজুমদার বলেছিলেন,”আমার সন্তানকেও সামাজিক সাংস্কৃতিক কাজে যুক্ত করার বিষয়ে বরুণ ছিল উদ্যোগী।শুধু আমার সন্তানকেই উনি সাহায্য করেন নি।গ্রামের কয়েকশো দরিদ্র ছাত্র আজীবন তাঁর অবদানের কথা মনে রাখবে।আমাদের অনাথ করে দিয়ে খুনীরা এমন একজন দেবদূতকে হত্যার লক্ষ্য করল কেন?আমার ইচ্ছে আমিও যেন তার মৃত্যুস্থলেই দেহ রাখতে পারি।” এ উচ্চারণ জানিয়ে দেয় মৃত্যু মানেই শেষ নয় প্রকৃত জীবন মৃত্যুর চেয়েও বড়। শিক্ষক বরুণ জীবন দিয়ে শিখিয়ে দিয়ে গেছে আততায়ীর কালোহাত পিছন থেকে গুলি ছুঁড়ে ফুসফুসকে এফোঁড় ওফোঁড় করে দিতে পারে।স্তব্ধ করে দিতে পারে হার্টবিট কিন্তু প্রাণের যে সুধারস বরুণ দিয়ে গেছে তা কি বিলীন করা যায়?উত্তর দেবে ভবিষ্যৎ।

    নিউজফ্রন্ট এর ফেসবুক পেজে লাইক দিতে এখানে ক্লিক করুন
    WhatsApp এ নিউজ পেতে জয়েন করুন আমাদের WhatsApp গ্রুপে
    আপনার মতামত বা নিউজ পাঠান এই নম্বরে : +91 94745 60584

    LEAVE A REPLY

    Please enter your comment!
    Please enter your name here