মোহনা বিশ্বাস
করোনা ভাইরাসের জেরে বিশ্বের এখন টালমাটাল পরিস্থিতি। কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে সকলে। সংক্রমণ থেকে বাঁচতে ঘরবন্দি হয়েছেন প্রায় প্রত্যেকটি মানুষ। অস্বস্তির কারণে মুখ ভার বিশ্ববাসীর। এমন সময়ে যদি কালো টুপি পড়া, হাতে সরু একটা লাঠি নিয়ে মাছি গোঁফওয়ালা ছিপছিপে চেহারার কোনও ব্যক্তি আপনার সামনে এসে দাঁড়ায়। কেমন হবে বলুন তো? হ্যাঁ একদম ঠিক আন্দাজ করেছেন। আমি চলচ্চিত্র নির্মাতা চার্লি চ্যাপলিনের কথাই বলছি।
নির্বাক চলচ্চিত্রের যুগে স্যার চার্লস স্পেনসার চ্যাপলিন জুনিয়র এক স্বর্ণ অধ্যায়। ৪৩ বছর আগেই পৃথিবী থেকে অনেক দূরে চলে গিয়েছেন তিনি। আজ বেঁচে থাকলে ১৩১ তম বর্ষে পা দিতেন চলচ্চিত্র ইতিহাসের অন্যতম সেরা কৌতুকাভিনেতা ও পরিচালক চার্লি চ্যাপলিন। ১৯১৩ সালে ফ্রেড কার্নো-র প্যান্ট্রোমাইম ট্রুপের সঙ্গে ২৪ বছর বয়সে চ্যাপলিন প্রথম আমেরিকায় পা রাখেন।
ছোটবেলায় তাঁর বাবা, মা দুজনেই লন্ডনের ভৌডভিল থিয়েটারের শিল্পী ছিলেন। বাবা, মায়ের বিবাহ বিচ্ছেদ এবং মায়ের মানসিক অসুস্থতার কারণে মাত্র দশ বছর বয়সে চ্যাপলিনের স্থান হয়েছিল অনাথ আশ্রমে। নেহাৎ বাঁচার তাগিদেই কৈশোরে পা দেওয়ার সাথে সাথেই বাবা, মায়ের জীবিকাকেই অর্থ উপার্জনের মাধ্যম হিসাবে বেছে নেন চ্যাপলিন।
১৯১৩ সালে ম্যাক সেনেটের অনুরোধ চ্যাপলিন ‘কী স্টোন’ কোম্পানিতে যোগ দেন। এক বছরের কিছু বেশি সময়ে ‘কি স্টোন’ কোম্পানিতে চ্যাপলিন বিভিন্ন দৈর্ঘ্যের মোট ৩৫টি ছবি করেন। ছবিগুলির দৈর্ঘ্যও ছিল ১ থেকে ৬ রিলের মধ্যে। ‘কী স্টোন’ কোম্পানিতে চ্যাপলিন অভিনীত প্রথম ছবিটি হল ‘মেকিং এ লিভিং’। সিনেমার পরিচালক ছিলেন ফ্রান্সের অরি লোর্মা।
আরও পড়ুনঃ ইচ্ছে থাকলে উপায় হয়
এক রিলের এই সিনেমাটি প্রদর্শনের মেয়াদ ছিল মাত্র দশ মিনিট। চ্যাপলিন যখন চলচ্চিত্র শিল্পে যোগ দেন তখন ছবি তৈরির প্রণালী সম্পর্কে তাঁর কোনও ধারণা ছিল না। বিশেষত সম্পাদনা বা এডিটিং সম্পর্কে তাঁর ধারণা এতটাই কম ছিল যে অসংলগ্ন কতগুলি দৃশ্য থেকে কিভাবে একটি সম্পূর্ণ ছবি তৈরি হবে তা তিনি বুঝতে পারতেন না।
এই সময়ে এডিসন থেকে শুরু করে গ্রিফিথ পর্যন্ত সবার কাছে শিক্ষানবিশ কাজ করেছেন চ্যাপলিন। আর সেইজন্যই ‘কী স্টোন’ কোম্পানিতে যোগ দেওয়ার এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে চ্যাপলিন পরিচালনার কাজ শুরু করেন। ‘কী স্টোন’ স্টুডিওতেই চ্যাপলিনের চলচ্চিত্র পরিচালনার কাজ শুরু হয়। চার্লি চ্যাপলিন পরিচালিত প্রথম ছবি হল ‘Caught in The Rain’। এই ‘কী স্টোন’ স্টুডিওতেই চ্যাপলিনের বিখ্যাত ‘ট্রাম্প’ চরিত্রটির সূত্রপাত হয়।
‘কিড অটো রেসেস্ অ্যাট ভেনিস্’ ছবিতে চ্যাপলিনকে প্রথম ট্রাম্পের পোশাকে দেখা যায়। এরপর ১৯১৫ সালে এসএমএ স্টুডিওতে যোগ দেন চ্যাপলিন। এসএমএ স্টুডিওতে ১৯১৫ থেকে ১৯১৬ সালের মধ্যে একবছরে চ্যাপলিন ১৪টি স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবি তৈরি করেছিলেন। এসএমএ স্টুডিওতে তৈরি ‘দ্য ট্রাম্প’ ছবিতে চ্যাপলিন অভিনীত ট্রাম্প চরিত্রটি অন্য মাত্রা পায়।
আরও পড়ুনঃ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাবনায় নির্মিত স্বল্প দৈর্ঘ্যের ছবি ‘ঝড় থেমে যাবে একদিন’
১৯২৮ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত হাস্যরসাত্মক ছবি দ্য সার্কাস-এ ফের একবার ট্রাম্প চরিত্রকে সামনে আনেন। এই ছবিতে চ্যাপলিন ছাড়াও অভিনয় করেছিলেন হ্যারি ক্রোকার, অ্যাল আর্নেস্ট গার্সিয়া, মার্না কেনেডি ও হেনরি বার্গম্যান। কমেডিয়ান অমিত ট্যান্ডন বলেন, ‘দ্য সার্কাস’ ছবিটিতে সিংহের খাঁচার ২ মিনিটের দৃশ্যটি ঠিকভাবে করতে চ্যাপলিন ২০০-র মত শট দিয়েছিলেন বলে শোনা যায়।
১৯৩০ সালে সিনেমায় শব্দ সংযোজন শুরু হয়। বিশ্বজুড়ে যখন সবাক চলচ্চিত্রের প্রবল চাহিদা তখন চ্যাপলিন তৈরি করেন তাঁর নির্বাক চলচ্চিত্র ‘সিটি লাইটস্’(১৯৩১)। পরিচালক হিসাবে সবাক চলচ্চিত্রকে শুরুর দিকে মেনে নিতে পারেননি চ্যাপলিন। চ্যাপলিন পরিচালিত যে ছবিটির কথা না বললে চ্যাপলিন অসম্পূর্ণ থেকে যাবে সেটি হল ‘গোল্ড রাস’(১৯২৫)।
এই ছবিতে চার্লি ধনতান্ত্রিক সভ্যতার সর্বগ্রাসী ক্ষুধাকে বিষয়বস্তু হিসাবে ব্যবহার করেছেন। একটি সিকোয়েন্সে চার্লি এবং ম্যাক সোয়েনের খাবারের অভাবে জুতো সেদ্ধ করে খাওয়ার মধ্যে দিয়ে। এই ছবিতে চার্লি চ্যাপলিন আধুনিক সভ্যতার সম্পদ স্পৃহাকে ব্যঙ্গ করেছেন।
১৯৫২ সালে চ্যাপলিন তৈরি করেন ‘লাইম লাইট’। এই ছবিতে নির্বাক যুগের এক সফল কমিডিয়ানের সবাক যুগের ব্যর্থতা ও অসফলতার কাহিনী বর্ণিত করেছেন চ্যাপলিন। ‘লাইম লাইট’ ছবিতে বৃদ্ধ কমেডিয়ান ক্যালভেরোর ভূমিকায় অভিনয় করেছেন চার্লি চ্যাপলিন।
‘লাইম লাইট’ অস্কার পুরস্কার লাভ করলেও চ্যাপলিন তাঁর জীবদ্দশায় কখনোই আর আমেরিকার মাটিতে পা রাখেননি। ১৯৫৭ সালে তৈরি ‘দ্য কিং ইন নিউইয়র্ক’ সেই অর্থে চ্যাপলিনের সফল ছবি নয়, তবুও ১৯৭৭ সালে তাঁর মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তাঁর তৈরি একধিক ছবি পূর্ণমুক্তি লাভ করে এবং চ্যাপলিন আমৃত্যু জনপ্রিয় থাকেন। কিন্তু ততদিনে নিজেকে নির্বাসিত করেছিলেন চ্যাপলিন।
এরপর ১৯৭৭ সালে সুইজারল্যাণ্ডে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন সকলের প্রিয় চার্লি চ্যাপলিন। চলচ্চিত্র জগতে তাঁর অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থেকে গেছে। তাঁর শূণ্যতা পূরণ হবে না কোনওদিন। তবুও তাঁর সৃষ্টি আমাদের মুখে হাসি ফোটাবে সবসময়।
WhatsApp এ নিউজ পেতে জয়েন করুন আমাদের WhatsApp গ্রুপে
আপনার মতামত বা নিউজ পাঠান এই নম্বরে : +91 94745 60584