সংগ্রাম চক্রবর্তী
আবু এবং মারোয়ান। দশ আর বারো বছরের দুই বালক।উত্তর ইয়েমেনে তাদের বাড়ি ছিল।১৬ই নভেম্বর আরো পনেরোজন আত্মীয়সহ তাদের বাবা মাও নিহত হয় সৌদির বিমান হানায়।বাবা মা আত্মীয় হারিয়ে, মারাত্মক আহত অবস্থায় এই দুই বালক পড়ে থাকে।তিন দিন পরে তাদের যখন হাসপাতালে আনা হয়, সারা শরীরে পোড়া ঘা দগদগ করছে।কিন্তু ইয়েমেনের হাসপাতালগুলো ও রাষ্ট্রসংঘ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও গ্রেট ব্রিটেনের যৌথ অবরোধের শিকার। তাই পর্যাপ্ত চিকিৎসা সরঞ্জাম,ওষুধ কিছুই নেই।এমন কি বোমায় উত্তর ইয়েমেনের হাসপাতালগুলোও বিধ্বস্ত।তাই মাত্র দুদিন পরেই সৌদির নেতৃত্বাধীন যৌথ আক্রমণ ও মার্কিন নেতৃত্বাধীন যৌথ অবরোধকে ধন্যবাদ জানিয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নেয় আবু ও মারোয়ান।কিন্তু তাদের শরীরের পোড়া ক্ষত প্রশ্ন রেখে যায় নিষিদ্ধ ঘোষিত রাসায়নিক অস্ত্রের,যেমন হোয়াইট ফসফরাস,ইয়েলো অরেঞ্জ।ভিয়েতনামের দিনগুলো ফিরে ফিরে আসে স্মৃতিতে।
কিন্তু আমেরিকা, গ্রেট ব্রিটেন, ফ্রান্স সহ উন্নত বিশ্বের আর্থিক সম্পদ, প্রাকৃতিক সম্পদ, মানব মেধা এমন কী শ্রমিকের ঘামের এক বড়ো অংশ ব্যায়িত হয় মারণাস্ত্র নির্মাণ আর গবেষনায়। শুধু গিনিপিগ গুলো পাল্টে যায়,কখনো আফঘানিস্তান,ইরাক, সিরিয়া,আবার এখন ইয়েমেন।
এই গবেষনার অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিদর্শন হল ক্লাস্টার বোমা বা গুচ্ছ বোমা।এটা আসলে একটা কোন বোমা নয়। একটা কেসের মধ্যে থাকে অসংখ্য ছোট ছোট বোমা।আর তারপর আকাশ থেকে বৃষ্টিধারার মতো নেমে আসে এক বিশাল অঞ্চল জুড়ে (৩০একর পর্যন্ত একটা কেস)। যুদ্ধ শেষ হওয়ার বহু বছর পর্যন্ত এই না ফাটা বোমাগুলো কার্যকরী থাকে।তাই ২০০৮ সালে ডাবলিন কনফারেন্স এই বোমার নির্মাণ, মজুত ও ব্যবহারের ওপর সম্পূর্ন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।
কিন্তু গণতান্ত্রিক অস্ত্রাগারের তা মানতে বয়ে গেছে।তাই ২০১৬ পর্যন্ত সৌদি আরব টেস্কট্রন ডিসেন্স সিস্টেমের কাছ থেকে ১৩০০ ইউনিট সি.বি-১০৫ ক্লাস্টার বোমা কিনেছে।ঐ একই কোম্পানীর কাছ থেকে অজানা অসংখ্য বোমা কিনেছে আরব আমিরশাহি।ল্যান্ড মাইনের থেকেও মারাত্মক এই ক্লাস্টার বোমার মূল প্রয়োগ কেন্দ্রগুলো হল উত্তর ইয়েমেনে আনসারুল্লার শক্ত ঘাটিগুলোর জনবসতি,যেমন সাদা, হেজাজ ইত্যাদি বসতি এলাকাগুলো।সৌদির বিমান হানায় এই শহরগুলো সম্পূর্ন বিধ্বস্ত।
বেসামরিক লক্ষ্যবস্তুর ওপর আঘাত আন্তর্জাতিক আইনে অপরাধ।গুচ্ছ বোমাও নিষিদ্ধ।(শুধু ২০০১৫ সালেই ৫৬ বার এই বোমার ব্যবহার করেছে সৌদি)।তাই সন্ত্রাসবাদী শুধু নয় তাকে বোমা যুগিয়ে আমেরিকা একই অপরাধে অপরাধী।
গ্রেট ব্রিটেনে পার্লামেন্টের সদস্য ও মানবাধিকার কর্মীদের নিয়ে অস্ত্র রপ্তানি সংক্রান্ত ব্যাপারে একটি কমিটি আছে।আন্তর্জাতিক চাপের মুখে লড়াই শুরুর একবছর বাদে ২০১৬, ২৩ মার্চ এই কমিটি আলোচনায় বসে।এই কমিটি তার রিপোর্টে তৎকালীন ব্রিটিশ বিদেশমন্ত্রী ফিলিপ হ্যামন্ডকে মিথ্যেবাদী বলে অভিযুক্ত করে জানায়,গ্রেট ব্রিটেন তার নিজের তৈরী আইনকেই বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে সৌদিকে ৬বিলিয়ন পাউন্ড মূল্যের অস্ত্র বিক্রি করেছে,যেখানে দ্ব্যর্থহীন ভাবে আইনে বলা আছে এমন কোন সন্দেহজনক কর্তৃপক্ষের কাছে অস্ত্র বেচা যাবে না যারা তা সাধারন নাগরিকদের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করতে পারে।ব্রিটিশ মানবাধিকার সংগঠনের প্রধান ডেভিড মেফান জি.পি.এস তথ্য সম্বলিত সৌদি আক্রমনের বিস্তারিত তথ্য ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীকে তুলে দেওয়া সত্ত্বেও প্রয়োগের অভিযোগে অভিযুক্ত ব্রিটেন সৌদিকে”যন্ত্রাংশ” সরবরাহের অছিলায় ব্যাপারটাকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করে। তাই ২০১৫ সালে পৌঁছোয় ২.৫বিলিয়ন পাউন্ডের যন্ত্রাংশ, ২০১৬ সালে পৌঁছোয় ৭বিলিয়ন পাউন্ডের যন্ত্রাংশ,২০১৭ সালে পৌঁছোয় ৯.৫ বিলিয়ন পাউন্ডের যন্ত্রাংশ।এই যন্ত্রাংশ হল ৭২ টা ইউরো ফাইটার বিমান, নৌবাহিনীর রাডার, আর্মাড কার, সহ যুদ্ধ পরিচালনার যন্ত্রাংশ। কিন্তু ২০১৫ সালে ২৩ সেপ্টেম্বর সানায় এক কারখানা ধংসের উদ্দেশ্যে নিক্ষিপ্ত মিসাইল বিস্ফোরিত হয় না,যেটা ছিল ব্রিটেনে নির্মিত পি.জি.এম ৫০০হাকিম ক্রুজ মিসাইল।তাই আবু আর মারোয়ান মারা গেলেও পোড়া দাগ থেকে যায়, ভিয়েতনাম হয়ে আফগানিস্তান ইরাক পেরিয়ে ইয়েমেনের তপ্ত বালুকায়।
WhatsApp এ নিউজ পেতে জয়েন করুন আমাদের WhatsApp গ্রুপে
আপনার মতামত বা নিউজ পাঠান এই নম্বরে : +91 94745 60584