চাকা শিল্পের বিপন্ন অস্তিত্ব:
নিজামুদ্দিন সেখ
ছেলে বেলার সেই ছড়াটা মনে কার না পড়ে,”কুমোর পাড়ার গরুর গাড়ি/ বোঝায় করা কলসী হাড়ি”। আজ বয়স হয়েছে সময়ের ,বদলেছে সভ্যতা-সমাজ , পাঠক্রম এর তালিকা থেকেও লুপ্ত হয়েছে পংক্তি গুলি। একদিন পঙক্তি গুলি গ্রামীন জীবনে আকাশে বাতাসে ভাসত ,বাস্তবের মাটি ছূয়ে।গরুর গাড়িকে ঘিরে স্বপ্ন দেখত গাড়িয়াল বন্ধুর সেই অপেক্ষারত প্রেমিকা। যা গ্রামীণ পরিবহণ মাধ্যমের সবটাই দখল করে ছিল কাঠের চাকা বিশিষ্ট গরুর গাড়ি । আজই সবই শুকনো পাতার অতীত কথা। কিন্তু শত প্রতিকূলতার মধ্যেও সলতে নেভা ধোঁয়ার গন্ধ বুকে নিয়ে ,আজও দাঁড়িয়ে আছে রেজিনগরের শতাব্দী প্রাচীন চাকা শিল্প।
মুর্শিদাবাদের দাদপুর যা সাক্ষী নানা ভাঙা গড়া ইতিহাসের ।একদিন নবাবী আমলে যার উপর ঘোড়ার পদধূলিতে গম্ভির করে দিত সেখান কার আকাশকে।পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে ইতিহাসের জীবন্ত সাক্ষী ভাগীরথীর স্রোত ধারা,বয়ে চলেছে সুদুরের পানে, লিখে রেখেছে বুকে তার কিছু অমর ইতিহাস।
স্থানটা অনেকের পরিচিত থাকতে পারে,৩৪নং জাতীয় সড়ক দাদপুর আমবাগান মোড় থেকে পশ্চিম দিকে ৫০০মিটার দাদপুর মিস্ত্রীপাড়া।কান পাতলে শোনা যেত কাঠ ঘসার খস-খস আর হাতুড়ির ঠক-ঠক আওয়াজ জানান দিত ছুতুর পাড়া এসে গেছে,কিন্তু আজ সেই শব্দ বিলিয়মান ।১০০বছেররও প্রাচীন এখানকার চাকা শিল্প।
স্মৄতি রোমন্থন করতে গিয়ে শক্তিপদ খান (৬০) জানালেন ,তাদের বংশ পরম্পারা এতিহ্যমণ্ডীত এই শিল্পের কথা- “চারপুরুষ ধরে তারা চাকা তৈরি করে চলেছেন, পূর্বপুরুষরা হলেন- রামদাস মিস্ত্রি তার পুত্র শ্যাম দাস মিস্ত্রি ,তার পুত্র দশরথ মিস্ত্রি , উনি তার পুত্র শক্তিপদ মিস্ত্রী”।তার অশ্রু সিক্ত চোখে ভেসে উঠল আশংকার ঘন মেঘ,হারিয়ে যেতে বসেছে তাদের শতাব্দিরও অধিক প্রাচীন চাকা শিল্প।
একটা সময় শুধু মুর্শিদাবাদ নয় পার্শ্ববতী জেলা নদিয়া,বীরভুম,বর্ধমান থেকে লোক আসত চাকা নেওয়ার জন্য, ৩১টি কাঠ বিশিষ্ট পেরেক বিহীন চাকা, এর মধ্যে লাহা ১টি,স্পক৬টি চুল৬টি পুটি৬টি পজরা ১২টি ,লোহার আঁট বাধুনি এখানকার বিশেষ বৈশিষ্ট্য। এছাড়াও চাকা হাল্কা ফলে গাড়ীর গতি তুলনামূলক ভাবে বেশী ,চাকার মাথায় লাগান থাকত বিশেষ লোহার রিং যা হাল নামে পরিচিত, যা মাঠের গভির কাদা ভেদ করার ক্ষমতা রাখে।শাল,শিশু আর বাবলা কাঠের সমন্বয়ে গঠিত চাকা, আকর্ষণ করত চাষির মন। চল্লিশ ঘর মিস্ত্রির মাত্র ২ জন অবশিষ্ট সেন্টু মিস্ত্রি আর শক্তিপদ মিস্ত্রি।এরা বছরে এক-আধটা বরাত পান। কেউ আবার এখন স্মৃতির পাতায় ।অন্যরা বাধ্য হয়ে অন্য পেশায় ,অনেকে আবার পেশা গ্রহণ করতে পারেনি এখনো। তাদের ঠাই অবসরের পাড়ার মাচা।কেঊ আবার মনের দুঃখে চাকা বানানোর উপকরন ফেলে দিয়েছেন জলে।
কথায় বলে পাশাপাশী বাস, দেখাদেখি চাষ ।ঠিক তেমনি মিস্ত্রীদের সান্নিধ্যে হালদার গোষ্ঠী গ্রহণ করেছিল চাকা শিল্প।হারিয়েছে তাদেরও জীবিকা,তাদের গলায় আক্ষেপের সুর।আগের প্রজন্ম না হয় ছেড়ে দেওয়া যেতে পারে এই প্রজন্মের ছেলে সুদিপ মিস্ত্রী বাবা, দাদুর হাতের শিল্প বাঁচিয়ে রাখার মরিয়া প্রয়াস চলাচ্ছে,কিন্তু ভবিষ্যতের কথা মনে পড়লে কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে তারও।
১৯৮০ সাল নাগাদ কুটির শিল্পী হিসাবে, কেউ কেউ সরকারি রেজিস্ট্রেশন পেয়েছিলেন,সাম্যন্য অনুদানও পেয়েছিলেন। এখন কিছুই মেলেনা,ফলে দৈণ্যভাব প্রকট হয়েছে তাদের।ঘরে শুধু অভাবের হাতছানি, জানা নেই ভবিষ্যতের কথা।
সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে সভ্যতা এগিয়েছে উন্নতির চরম শিখরে। যন্ত্র শিল্পের মহিমায় বাজারে এসে গেছে ট্রাক্টার ।ফলে জমি চাষ থেকে ঘরের লক্ষী ঘরে আনা ।সবেতেই মাঠের বুক চিরে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে যন্ত্রদানব।আর ডাক পান না গাড়ীয়াল ভাই আর বংশিবদনরা।চাষির খামারে গরুর গাড়ির চাঁদ বদনের দেখা পাওয়া ভার।সুুতরাং গাড়ি নেই চাকার আর কি দরকার ।ফলে কালের নিয়মে চাষির পবিত্র চরন থেকে বঞ্চিত হচ্ছে ছুতুর পাড়ার মাটি।
WhatsApp এ নিউজ পেতে জয়েন করুন আমাদের WhatsApp গ্রুপে
আপনার মতামত বা নিউজ পাঠান এই নম্বরে : +91 94745 60584