নিজস্ব সংবাদদাতা,পশ্চিম মেদিনীপুরঃ
একসময় জমিদারি ছিল।ছিল অঢেল সম্পদও। এখন জমিও নেই,জমিদারিও নেই।থেকে গিয়েছে অতীতের ঐতিহ্য আর ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা।পশ্চিম মেদিনীপুরের খড়্গপুর মহকুমার কেশিয়াড়ি সংলগ্ন আমতলা বাসষ্টপে নেমে পূর্বদিকে ৪০০মিটার পথ অতিক্রম করলেই দত্তদের বাড়ি।কয়েকবছর আগেও ছিল চুন-সুড়কি আর ঝামা ইটের প্রাচীরে ঘেরা বাড়ি।
এখন পাকাঘর হয়ে গিয়েছে।প্রায় ৫০ বছর ধরে দত্ত পরিবারে পটের দূর্গাপুজা হয়ে আসছে। আজও মাটির প্রতিমা নয়,পুজিতা হন পটের প্রতিমা।
তবে অতীতের রীতি মেনে এখনো সপ্তমীতে জমিদারির ঐতিহ্যের প্রতীক তলোয়ার নিয়ে ঘটোত্তলনে যান দত্তপরিবারের বর্তমান উত্তরসূরিরা।
ঘট বিসর্জনেও একই আচার অনুষ্ঠিত হয়।এখনো আতসকাচের আগুন নিয়ে এখানকার হোম অনুষ্ঠিত হয় বলে জানালেন বর্তমান উত্তরসূরিদদের অন্যতম প্রতিনিধি প্রসাদ দত্ত। প্রসাদবাবু বলেন, ‘ বর্তমান আর্থিক সঙ্কটের কারনে জৌলুসে সামান্য ঘাটতি থাকলেও প্রায় ২০০ বছরের প্রাচীন ঐতিহ্যকে অক্ষুন্ন রাখার ক্ষেত্রে কোন ঘাটতি রাখা হয়না।”
পুরনো আমলের চুন-সুড়কি,পোড়া ইট, আর ঝামাপাথরে তৈরি সেই রাজবাড়ী এখন বিদ্যমান ।বর্তমানে যে নতুন পাকার বাড়িতে ওই রাজবাড়ির উত্তরসূরীরা বসবাস করেন তার ঠিক পেছনেই রয়েছে পুরনো ঐতিহ্যের ওই বাড়ি।
বাড়িটির দক্ষিণ দিকে রয়েছে একটি পুষ্করিণী। যেখানে তখনকার দিনের শুধু রাজবাড়ীর মেয়েরা ওখানে স্নান করতেন।পুরুষদের যাতাযাত ছিল কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।এখনো সেখানে রয়েছে মজে যাওয়া পুকুর ঘাট।আর ঐতিহ্যের স্মারক বাড়িটিতে রয়েছে অসংখ্য ক্ষয়িষ্ণু সারিবদ্ধ দালান।
আর ঠিক দুটি দালানের মাঝ বরাবর রয়েছে একটি করে কুটির যেগুলিতে রাজ বাড়ির সদস্যরা এবং অতিথিরা থাকতেন । এইরকম পুরো বাড়িটিতে অসংখ্য কুটির রয়েছে ।কুটিরের ভেতরেই রয়েছে সবুজ শ্যাওলা ও ছত্রাকে জড়িয়ে থাকা পেঁচানো সিড়ি।
পুরো বাড়িটা এখন ভগ্নপ্রায়,জরাজীর্ণ পোড়া বাড়িতে পরিণত হয়েছে।আগাছায় ভরে গিয়েছে বাড়ির সমগ্র দেওয়াল।ওই বাড়ি গুলিতে এখন আর কেউ বাস করেন না।তবে ঐতিহ্যের শরিক হিসাবে তা এখনও বিদ্যমান।যেমনটা রয়েছে সেই আদ্যিকালের প্রায় ২০০ বছরের পুরনো ঐতিহ্যের তরোয়াল।যা দিয়ে এখনো পর্যন্ত পুজোর ঘটোত্তলন ও ঘট বিসর্জন হয়।
পুজোর এই কটা দিন এই তরোয়াল খানি বের করানো হয় সর্বসমক্ষে।আর বছরের বাকি দিনগুলিতে বাড়ির এক পুরনো রাজ আমলে তৈরি কাঠের বাক্সে তালা চাবি দিয়ে বন্ধ করা থাকে।
আরও পড়ুনঃ পতিরাম জমিদার বাড়ির পুজোর তোড়জোড় তুঙ্গে
বর্ধমানের হরনারায়ণ দত্ত ছিলেন পেশায় উকিল। তিনিই একসময় এক রাজার কাছ থেকে উপহার স্বরূপ কেশিয়াড়ীর ৩৬ মৌজা এবং গগনেশ্বরের একাংশের জমি লাভ করেন।দত্ত পরিবারের জমিদারি ছিল বিশাল আয়তনের।দত্ত পরিবারের কুলদেবতা রাধাকৃষ্ণের নিত্য পুজা হয়।
এই পুজার পাশাপাশি হরিনারায়ণ দত্তই ২০০ বছর আগে পটের দূর্গা পূজার আয়োজন করেন। এখানে প্রথম থেকেই ছিল পটের পুজা। সেইসময় দূর্গাপুজা উপলক্ষ্যে চণ্ডীমঙ্গল,শিতলামঙ্গল যাত্রাপালা গানের আসর বসত মাসাধিক কাল।
অসংখ্য মানুষ আসতেন।এখন আচার মেনে শুধু পুজা হয় পটের দেবী দশভূজার।যেহেতু কেশিয়াড়ীতে দেবী সর্বমঙ্গলার মন্দির রয়েছে তাই মূর্তি পুজা হয়না।প্রসঙ্গত কথিত রয়েছে কেশিয়াড়ীতে দেবী সর্বমঙ্গলার মূর্তি পূজা হয় এ অঞ্চলে তখনকার দিনে আর কোন প্রত্যায়িত মূর্তি রূপ পূজা করা যাবে না।
আরও পড়ুনঃ মা দূর্গার আগমন মানেই এখানে প্রিয়জনের বিদায়
সেই থেকে কেশিয়াড়ী অবস্থিত সমগ্র রাজবাড়ি গুলিতে মূর্তি পূজা হয় না।হয় পট নয় ঘটের পুজোর হয়ে থাকে ।এখন অবশ্য বেশ কয়েকটি সার্বজনীন দুর্গা পূজো হয় কেশিয়াড়ি জুড়ে।তবে সে গুলিতে মূর্তি পুজাে হয়ে থাকে।
দত্তবাড়ী এই দুর্গা পুজোতে বংশ পরম্পরায় একানকার শোলার পট তৈরি করেন কেশিয়াড়ীর মালাকার পরিবার। বর্তমানে শংকর মালাকার সেই পটের মূর্তি গড়েন। আবার দুর্গাপূজায় যত রকম মাটির জিনিসপত্র লাগে সেগুলি সরবরাহ করেন বেরা পরিবারের সদস্যরা। এঁদের এই পরিষেবা দেওয়ার জন্য ওই জমিদার বংশ থেকে পরিবারগুলিকে জমি ও দেওয়া আছে।
এখন দত্ত পরিবারের মোট তিনটি শরিক। দুর্গাপূজার সময় এই পরিবারের সমস্ত বন্ধুবান্ধব এবং পরিবারের সদস্যরা একত্রে মিলিত হন। দুর্গাপুজার দিনগুলিতে একসঙ্গে সবাই রান্নাকরা, খাবার খাওয়া, আনন্দ উৎসব করে থাকেন।
প্রত্যেকবারে শরিকদের মধ্যে পুজার দায়িত্ব বন্টন হয়।প্রসাদবাবু জানান,এবার পুজার দায়িত্ব তিনি নিজে নিয়েছেন তবে পরিবারের অন্যান্য সদস্যরাও সমানভাবে দায়িত্ব নিয়ে কাজ করেন ।
এখান দুর্গাপুজোর ঘট দশমীতে বিসর্জন হলেও পটের প্রতিমা নিরঞ্জন হয় লক্ষ্মী পূজার পর। বর্তমান উত্তরসূরিদের বক্তব্য একদিকে সীমাহীন দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি আর জমিদারির কোন সম্পত্তি না থাকায় পূজা পরিচালনা কঠিন হয়ে পড়ে।তবু তারই মধ্যে ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে।
WhatsApp এ নিউজ পেতে জয়েন করুন আমাদের WhatsApp গ্রুপে
আপনার মতামত বা নিউজ পাঠান এই নম্বরে : +91 94745 60584