শিক্ষাব্রতী রোকেয়া-প্রাণতোষ বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়

    0
    491

    শিক্ষাব্রতী রোকেয়া-প্রাণতোষ বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়,অধ্যাপক এবং রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন গবেষক।

    রোকেয়া অর্থ জ্যোতির্ময়ী। বিদ্যাসাগর চেতনার আলোয় ‘সকলের জন্য শিক্ষা’ চিন্তার রূপায়ণে মুসলমান সমাজে তিনি সার্থক আন্দোলনের স্রষ্টা, সর্বজনের সর্বকালের প্রেরণা। “লতা যেমন আপনিই আলোকের দিকে উন্মুখ হইয়া থাকে, যতই বাধা পাক তবুও সেইদিকেই তার গতি- এই নারীর জীবনে তেমনি সত্য ও সুন্দরের প্রতি একটি অনিবার্য্য প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়” তাঁর প্রসঙ্গে লিখেছেন মোহিতলাল মজুমদার। রোকেয়ার জন্ম আনুমানিক ৯ ডিসেম্বর, ১৮৮০ রংপুর জেলার মিঠাপুকুর থানার পায়রাবন্দের শিক্ষিত জমিদার পরিবারে। তাঁর জীবনাবসান ৯ ডিসেম্বর ১৯৩২ স্বপ্রতিষ্ঠিত সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুলের সেকালের ভবন কলকাতায় ১৬২ লোয়ার সার্কুলার রোডে। সেখানে ২০১৭ সালে তাঁর মহিলা সমিতি ‘আঞ্জুমানে খাওয়াতীনে ইসলাম’ শতবর্ষে ‘রোকেয়া মিনার’ নির্মিত হয়েছে।

    ছবি-সংগৃহিত

    শিক্ষাব্রতী রোকেয়ার শিক্ষাচিন্তা ডেভিড হেয়ার, বিদ্যাসাগরের ধারায় যুক্তি ও মুক্তচিন্তার পথিক। ধর্মান্ধদের বাধায় ডেভিড হেয়ারের মতই কোন সার্বজনীন কবরস্থলে তাঁর সমাধি হয়নি।আবদুর রহমানের সোদপুরের বাগানে তাঁর সমাধিস্থলে পরে পাণিহাটি বালিকা বিদ্যালয় ভবন নির্মিত হয়েছে। শেষ বিশ্রামস্থল ”কবরে শুইয়াও যেন আমি আমার মেয়েদের কলকোলাহল শুনিতে পাই” তিনি লিখেছেন। শিক্ষানুরাগী সৈয়দ মনসুর হবিবুল্লাহের আগ্রহে, সোদপুরের আঞ্চলিক ইতিহাসবিদ সুনীল পাল, স্কুল সমিতির সহায়তায় বিদ্যালয় প্রাঙ্গনে ১৯৯৫ সালে রোকেয়া সমাধিফলক স্থাপন করেন। সেই থেকে ৯ ডিসেম্বর তাঁর জন্ম-মৃত্যু স্মরণে ‘রোকেয়া দিবস’ ভারতে বিভিন্ন শিক্ষালয় ও সংগঠনে পালিত হতে শুরু হয়েছে। ভারতে প্রথম রোকেয়া নামাঙ্কিত শিক্ষালয় ‘বেগম রোকেয়া স্মৃতি সরকারী উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়’,সল্টলেক। শিক্ষার্থীদের অন্তরে নিরন্তর প্রেরণা সঞ্চারের লক্ষ্যে,প্রধানশিক্ষিকা সুমিত্রা সেনগুপ্ত বিদ্যালয় ভবনে শিক্ষাব্রতী রোকেয়ার আবক্ষমূর্তি স্থাপন করেছেন। ঐতিহাসিক সুরঞ্জন দাসের উদ্যোগে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে রোকেয়ার ছবি শোভিত এবং আশুতোষ ভবনে একটি কক্ষ নামাঙ্কিত হয়। মুর্শিদাবাদে রায়পাড়া পদ্মাচরে সমাজকর্মী মনোজ রায় উভয় বাংলার কেন্দ্রস্থলে ‘রবীন্দ্রনাথ-রোকেয়া প্রাথমিক স্কুল’ স্থাপন করেছেন।
    স্বশিক্ষিতা রোকেয়ার জীবন, কর্ম ও চিন্তাচেতনার পরিচয় জেনে ‘বড়ো বিস্ময় লাগে’। তাঁর পিতা পায়রাবন্দের শিক্ষিত জমিদার জহিরুদ্দীন আবু আলী সাবের বিলাসিতা অপচয়ে শেষ জীবনে নিঃস্ব হন। তাঁর চার স্ত্রীর প্রথমা রাহাতুন্নেসার দুই ছেলে ও তিন মেয়ে। রোকেয়ার বড় দুই ভাই ইব্রাহিম সাবের ও খলিলুর সাবের কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে বি.এ পাশ করেন। কিন্তু তিন বোন করীমুন্নেসা, রোকেয়া ও হোমায়েরা শিক্ষালাভে বঞ্চিত ছিলেন। সাংসারিক কাজ ও ধর্মকর্মের জন্য প্রাথমিক কিছু তালিম তাঁদের জুটেছে। এদেশে প্রায় সকল সম্ভ্রান্ত পরিবারে তখন মেয়েরা ছিলেন অন্তঃপুরে বন্দী, আধুনিক শিক্ষালাভে বঞ্চিত। সে সময় হিন্দু-মুসলমান অভিজাত বংশের মহিলা “যিনি যত বেশি পর্দা করিয়া গৃহকোণে যত বেশি পেচকের মত লুকাইয়া থাকিতে পারেন, তিনিই তত বেশী শরীফ”। রোকেয়া আরও লিখেছেন,“এখানকার মুসলমানেরা মাতৃহীন-অর্থাৎ তাহাদের মাতৃভাষা নাই। এমন বিকৃত উর্দু বলে যে, তাহা শুনিলে শ্রবণবিবর ক্ষত-বিক্ষত হয়”। অভিভাবকদের অগোচরে আকুল আগ্রহে করীমুন্নেসা ও রোকেয়া শৈশব থেকে সংগোপনে লেখাপড়া করেছেন, বাংলা শিখেছেন। হিন্দু অভিজাত পরিবারে ‘বিধবা হবে’ ভয় দেখিয়ে নারীশিক্ষা বন্ধ এবং ‘সতীদাহ’ হত । রোকেয়া উপলব্দ্ধি করেন, আভিজাত্যবোধ সমাজ প্রগতির অন্তরায়। ‘সম্ভ্রান্ত’ অর্থে তিনি ‘অভিশপ্ত’ আখ্যা দিয়ে নিজের নামে ‘বেগম’ অথবা স্বামীর নামে ‘সৈয়দ’ বিশেষণ বর্জন করেন। আধিপত্য ও সামাজিক বৈষম্য বোধ মুক্ত, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যে সৌন্দর্য্যময়, নাগরিক অধিকারে সক্রিয় গণতান্ত্রিক সমাজ ভাবনার স্বপ্নদ্রষ্টা ছিলেন রোকেয়া। তাঁর স্বপ্ন রূপায়ণে বঞ্চিতদের মধ্যে প্রকৃত শিক্ষাসঞ্চারে ব্রতী ছিলেন। সর্বজনের মানবাধিকার অর্জনের লক্ষ্যে ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে সংগ্রামে জীবনের শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত অকাট্য যুক্তিপূর্ণ রচনা লিখে,নারীসমিতি গড়ে, নারী ও শিশু শিক্ষা প্রসার করে শান্তিপূর্ণ সুস্থ সমাজ গড়ায় মগ্ন ছিলেন রোকেয়া।

    ভাগলপুরের উর্দুভাষী, প্রৌঢ়, বিপত্নীক এবং ডায়াবেটিসে রুগ্ন সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয় ১৮৯৬ সালে। স্বামীর প্রথম পক্ষের বিবাহিত কন্যা ছিল। দরিদ্র বিধবা মায়ের একমাত্র সন্তান সাখাওয়াত ছিলেন উদার ও উচ্চশিক্ষিত। হুগলী মহসীন কলেজে তাঁর সহপাঠী সুহৃদ ছিলেন শিক্ষাবিদ ভূদেব মুখোপাধ্যায় পুত্র মুকুন্দদেব। তিনি সাখাওয়াত ও রোকেয়ার সুসম্পর্কের কথা লিখেছেন। আপন অধ্যাবসায়ে সাখাওয়াত ইংলন্ডের সাইরেণসেষ্টার কলেজ থেকে কৃষিবিদ্যায় M.R.A.C. ডিগ্রী ও পুরস্কার অর্জন করেন। বঙ্গবাসী কলেজ প্রতিষ্ঠাতা গিরিশচন্দ্র বসু এবং দ্বিজেন্দ্রলাল রায় পরে এই ডিগ্রী পান। দ্বিতীয় বিবাহকালে সাখাওয়াত ছিলেন কটকের ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট ও কনিকা রাজ্যের ‘কোর্ট অব ওয়ার্ডস’। অর্থাৎ নাবালক ‘রাজা রাজেন্দ্রচন্দ্র ভঞ্জদেও’র পক্ষে সামগ্রিক প্রশাসন নির্দেশক। কটকে রাজবাড়িতে ছিল তাঁর সরকারী ‘কোয়ার্টার’। তিনি প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ব্রাহ্ম ক্ষীরোদচন্দ্র রায়চৌধুরীকে নাবালক রাজার শিক্ষক নিযুক্ত করেন। কনিকা রাজ্যের অর্থে রেভেনশ কলেজ লাইব্রেরী নির্মিত হয়। তাঁর আমলে কনিকা রাজ্যের ও প্রজাদের সমৃদ্ধি হয়েছিল। নবীন রাজা প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে, অভিভাবক হিসাবে সসম্মানে তাঁকে কনিকায় থাকতে অনুরোধ করেন।
    কিশোরী নববধূ রোকেয়া পরিপাটি করে সংসার, অসুস্থ স্বামীর নিপুণ সেবার অবসরে পড়াশোনা করেছেন। অফিসকাজেও স্বামীকে সহায়তা দিয়েছেন। ১৯০০ সালে সাখাওয়াত নিজ শহর ভাগলপুরে ডিভিশনাল কমিশনার সহকারী পদে বদলী হন। কর্মসূত্রে স্থানান্তরে গেলে রোকেয়া রুগ্ন স্বামীর সঙ্গী হতেন। ভাগলপুরে তাঁদের দুটি কন্যা জন্মের পরে মারা যায়। ক্রমশঃ বহুমূত্ররোগে সাখাওয়াত অন্ধ ও শয্যাশায়ী হতে, রোকেয়ার সাহিত্যকর্ম বন্ধ হয়। কলকাতায় এনে প্রাণপণ চিকিৎসা, সেবা সত্ত্বেও ১৯০৯ সালে ৩ মে সাখাওয়াতের জীবনান্ত ঘটে। ভাগলপুরে কন্যাদের পাশে সাখাওয়াত সমাহিত। কলকাতা থেকে শব ভাগলপুরে নিতে বিপন্ন রোকেয়ার সঙ্গী ছিলেন ছোটবোন অন্তঃসত্ত্বা হোমায়েরা। তাঁর পুত্র আমীর হোসেন (নজরুল গবেষক,’৬৪ ঢাকায় মহান দাঙ্গাশহীদ) এর জন্ম ভাগলপুরে। সদ্যবিধবা রোকেয়ার বালিকা বিদ্যালয় সেখানে শ্বশুরকুলের বাধায় ব্যর্থ হয়। শোকমগ্ন, সন্তানহারা রোকেয়া তাঁর আকাশচুম্বী স্বপ্নপূরণের লক্ষ্যে ১৯১০ সালে ৩ ডিসেম্বর কলকাতায় আসেন। রচিত হয় শিক্ষা সংগ্রামের যুগান্তকারী নব ইতিহাস।
    কটকে রোকেয়ার আগমনকালে সদ্যপ্রয়াত বিদ্যাসাগর চেতনায় শিক্ষা ও সমাজ রূপায়ণের ঢেউ ওঠে। এই যুগকে ওড়িশার স্বর্ণযুগ বলা হয়। ব্রাহ্মসমাজ সভাপতি রেভেনশ স্কুল প্রধানশিক্ষক মধুসূদন রাও, সম্পাদক কটক অ্যাকাডেমী শিক্ষক সাধুচরণ রায়(১৮৬১-১৮৯৮), শিক্ষাবিদ রাধানাথ রায়, সাহিত্যিক ফকিরমোহন সেনাপতি, অধ্যাপক ক্ষীরোদচন্দ্র রায়চৌধুরী প্রমুখ এ আন্দোলনে নেতৃত্বে ছিলেন। ১৮৯১ সালে বিদ্যাসাগরের প্রয়াণের দু’দিন আগে প্রয়াত হন এশিয়াটিক সোসাইটির প্রথম ভারতীয় সভাপতি রাজেন্দ্রলাল মিত্র। এই দুই মনীষীর মনন গঠনে ডেভিড হেয়ার ও প্রেমচন্দ্র তর্কবাগীশের প্রভাব ছিল। সংস্কৃত কলেজের প্রথম যুগের ছাত্র ও বিদ্যাসাগরের ছাত্রজীবনে নবীন শিক্ষক প্রেমচন্দ্র ছিলেন প্রখর যুক্তিবাদী ও মানবিক। তিনি অশোকের শিলালিপি পাঠোদ্ধার করে প্রিন্সেপকে সাহায্য করেন। হারিয়ে যাওয়া বুদ্ধচেতনা জেগে ওঠে।তাঁরই প্রেরণায় ভারতে রাজেন্দ্রলাল মিত্র বৌদ্ধদর্শন চর্চার পথিকৃৎ। জাতপাত বিদ্বেষ, কুসংস্কারে পূর্ণ সমাজে বিদ্যাসাগরের অলৌকিকতা বর্জিত, মাতৃভাষায় সার্বজনীন শিক্ষাদর্শনে বুদ্ধ চেতনা উদ্ভাসিত। বিদ্যাসাগরের প্রয়াসে ধর্ম, বর্ণ, জাতির ঊর্ধে যুক্তিবাদী শিক্ষাধারায নবভারতের সূচনা।
    ওড়িশায় সামাজিক ও শিক্ষা আন্দোলনে নারী জাগরণে মুখ্য ভূমিকায় ছিলেন মধুসূদন রাও ভ্রাতুষ্পুত্রী ও সাধুচরণ রায়ের পত্নী রেবা রায় (১৮৭৬-১৯৫৭)। তিনি ১৮৯২ সালে ওড়িয়া ভাষায় প্রথম নারী মুখপত্র ‘আশা’ প্রকাশ ও সম্পাদনা করেন।তাঁর রচিত‘অঞ্জলি’ ভক্তিমূলক কাব্যগ্রন্থে ঈশ্বর নিরাকার। তাঁর আমন্ত্রণে রোকেয়া, মধুসূদন রাও বাসভবনে আয়োজিত ব্রাহ্ম মহিলা সভায় যোগ দিতেন। শিবনাথ শাস্ত্রীর পিতা হরানন্দ ভট্টাচার্য বলেছেন, মধুসূদন ছিলেন ‘দ্বিতীয় বিদ্যাসাগর’। রেবা রায় মাত্র ২২ বছরে তিনটি শিশু নিয়ে বিধবা হন। দুঃখ শোক উপেক্ষা করে এই তরুণী কটকে প্রথম বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। শৈশবে পিতৃহীন তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র সচ্চিদানন্দ রেভেনশ কলেজ অধ্যক্ষ ও পরে ডি.পি.আই হয়েছেন। তাঁর তিন সন্তানই শিক্ষিত।রেবা রায়ের কর্মযোগে সামিল হয়ে রোকেয়ার শিক্ষা ও সমাজচেতনা সমৃদ্ধ হয়।
    স্বশিক্ষিতা রোকেয়া শিক্ষা, বিশেষতঃ নারী ও শিশুশিক্ষার সাথে সম্পর্কিত যে-কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পর্যবেক্ষণ ও অধ্যয়নের সব সুযোগ গ্রহণ করতেন। ১৯০৪ সালে প্রকাশিত ‘সৌরজগৎ’ প্রবন্ধ থেকে রোকেয়ার শিক্ষাভাবনার পরিচয় মেলে। শিক্ষা অর্থে তাঁর স্পষ্ট ঘোষণা,‘মানুষ যে সম্ভাব্য ক্ষমতা নিয়ে জন্মায় তাঁর বিকাশ সাধন’।…’আমরা কেবল পাশ করা বিদ্যাকে প্রকৃত শিক্ষা বলি না’ “শিক্ষার অর্থ কোন সম্প্রদায় বা জাতি বিশেষের অন্ধ অনুকরণ নহে। শিক্ষা অর্থে আমি প্রকৃত সুশিক্ষার কথাই বলি। আমি চাই সেই শিক্ষা যাহা তাহাদিগকে নাগরিক অধিকার লাভে সক্ষম করিবে।..শিক্ষা মানসিক এবং শারীরিক উভয়বিধ হওয়া চাই”। রূপচর্চায় নয়, নিয়মিত শরীরচর্চা ও স্বাস্থ্যকর পরিমিত খাদ্য গ্রহণে, সৌন্দর্য্য বৃদ্ধি ও সুস্বাস্থ্য অর্জন হয়। নিজ সংস্স্কৃতি বিকাশে ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের প্রতি শ্রদ্ধায়, শিক্ষার যথার্থ প্রয়োগে দেশ আর দশের মঙ্গল। তিনি দুর্বলের অন্তরে আত্মবিশ্বাস সঞ্চার করে বলেছেন, পরনির্ভরশীল না থেকে নিজের চেষ্টাতেই কেবল শিক্ষা অর্জন করা সম্ভব। শিক্ষা প্রচেষ্টারত অসহায়ের সহায় হতে, তিনি সকলের কাছে আকুল আহ্বান জানাতেন।
    সেকালের শ্রেষ্ঠ পত্রপত্রিকায় রোকেয়া রচনা প্রকাশিত হতে থাকে। ১৯০৫ সালে সরোজিনী নাইডু সম্পাদিত India’s Ladies Magazine- এ প্রকাশিত তাঁর ইংরাজী রচনা Sultana’s Dream একটি নারী শাসিত কল্পদেশের বর্ণনা, যেদেশে রান্না ও পরিবহন হয় সৌরশক্তিতে, নাগরিক অধিকারে সবাই সমান। সকলেই শিক্ষিত, নিরলস ও কর্তব্যপরায়ণ এবং পরিবেশ ভাবনা, বিজ্ঞান চেতনা ও বিশ্বশান্তি প্রসারে মগ্ন। এই উন্নত সমাজ চেতনা কেবল সেকালে নয়, একালেও দুর্লভ। সৌরশক্তিতে পরিবহন ভাবনা, সারা বিশ্বে ইতিপূর্বে আর কোন লেখায় খুঁজে পাওয়া যায় না। ইংল্যান্ডের বিশ্বখ্যাত Rose Brufford College of Theatre and Performance শতবর্ষ আগে প্রকাশিত এই কল্পবিজ্ঞানের প্রাসঙ্গিকতা লক্ষ্য করে Rokeya’s Dream নাম দিয়ে বিভিন্ন দেশে মঞ্চস্থ করছে। কলকাতায় রোকেয়া প্রতিষ্ঠিত সাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুলের শতবর্ষে Rose Brufford College এর বৃটিশ ছাত্রীরা, আনোয়ারা বাহার চৌধুরীর কন্যা শাহীন চৌধুরীর নেতৃত্বে এদেশে এসে সাখাওয়াত স্কুল ও রবীন্দ্রভারতী, বিশ্বভারতী,বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে রোকেয়ার লেখার নাট্যরূপের কর্মশালা করেছেন। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের শিক্ষার্থীদের এই সাংস্কৃতিক মিলনে সকলে লক্ষ্য করেছেন-রবীন্দ্রনাথ রোকেয়ার শিক্ষাভাবনার সাদৃশ্য। রবীন্দ্রস্মৃতিধন্য পেনেটির বাংলোবাড়িতে ‘গোবিন্দকুমার হোম’ দেখে বৃটিশ ছাত্রীরা অভিভূত! রোকেয়াসমাধি স্কুলের পাশে,শেরপুর জমিদার স্থাপিত আশ্রমে দুঃস্থা, পরিত্যক্তা ও পতিতাকন্যা আশ্রিত। সেখানে থেকে তারা বিদ্যালয়ে শিক্ষা গ্রহণ করছে। অনুরূপ All Bengal Women’s Union Home বরানগর থেকে বর্তমানে ইলিয়ট রোডে স্থানান্তরিত। রোকেয়া ও তাঁর ব্রাহ্মসাথীদের দ্বারা ১৯২৮ সালে প্রতিষ্ঠিত ও ১৯৩৩ সালে পঞ্জীভুক্ত হোমদুটি, বৃটিশ ছাত্রীদের ও সুজনবৃন্দের মতে ‘বিশ্বের ‘পূণ্যতীর্থ’।
    রোকেয়ার লোকবল, অর্থবল কিছুই ছিলনা। দরদী মনে নিপীড়িত মানুষের প্রতি অপরিসীম ভালবাসা ও শ্রদ্ধাবোধ এবং অভীষ্ট পুরণে অদম্য মনোবল ও বাস্তববোধ সম্বল করে তিনি তাঁর লক্ষ্য অর্জন করেছেন। স্কুলের জন্য স্বামী দশহাজার টাকা দিয়েছিলেন। এছাড়া নিজের সবকিছু দিয়েও, নিত্য সকলের কাছে অর্থ সাহায্য প্রার্থনা করতে হয়েছে। দাতাদের ইচ্ছায় স্কুলটি ‘সম্ভ্রান্ত’ মুসলমান ছাত্রীদের জন্য নির্দিষ্ট হয়, তাঁরাই ‘সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস’স্কুল’ নামকরণ করেন। নিজের তিক্ত অভিজ্ঞতায়, ‘সম্ভ্রান্ত’ মুসলমান কন্যা দের শিক্ষালাভে দুর্দশা সম্যক জানতেন। সাগ্রহে তাদের শিক্ষার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। কিন্তু তাঁর মূল লক্ষ্য ছিল শিক্ষার মাধ্যমে সুস্থ সমাজ গড়ে তোলা। ‘সম্ভ্রান্ত’ ‘অভিজাত’ গোষ্ঠীর বাইরে যে বিপুল অসহায় হত দরিদ্র জনগোষ্ঠী তাঁদের জন্য তাঁর প্রাণ কাঁদত। স্কুলপ্রতিষ্ঠার চার বছরে স্বীকৃতিলাভ হতেই, ১৯১৬ সালে স্কুলভবনে ‘আঞ্জুমানে খাওয়াতীনে ইসলাম’ বা ‘নিখিলবঙ্গ মুসলিম মহিলা সমিতি’ স্থাপন করেন। সমিতির লক্ষ্য ছিল ‘অভিজাত’ পরিবারের মহিলারা সংগঠিত হয়ে দরিদ্র বস্তিবাসীদের শিক্ষাদানের মাধ্যমে তাঁদের আত্মনির্ভরশীল ও নাগরিক অধিকারে সচেতন করবেন; সবার জীবনের মানোন্নয়নে ব্রতী হবেন। নিত্য কল্যাণ কাজে পারস্পরিক যোগাযোগে সুস্থ, শান্তিপূর্ণ সমাজ গঠিত হবে।
    ১৯১৭ সালে কলকাতা কংগ্রেস অধিবেশনের সভাপতি হন অ্যানী বেসান্ত। নবীন উৎসাহে কলেজ স্ট্রীটের থিওসফিক্যাল সোসাইটি হলে মহিলা রাজনৈতিক সমাবেশ হয়। সভানেত্রী মন্ডলীতে অ্যানী বেসান্ত, সরোজিনী নাইডু এবং আলীভাইদের জননী বি-আম্মা। ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় রোকেয়া রক্ষণশীল পরিবারের বাধা জয় করেন। আঞ্জুমানে ইসলাম সদস্যারা এই রাজনৈতিক সভায় স্বেচ্ছাসেবী হন। ঘরবন্দী মহিলারা মুক্তির মহানন্দে পরিচিতাদের সমিতিতে যুক্ত করতে থাকেন। বাংলার নারী আন্দোলন বেগবতী হয়। অচিরেই ‘আঞ্জুমানে খাওয়াতীনে ইসলাম’ বা ‘নিখিলবঙ্গ মুসলিম মহিলা সমিতি’-র ঊজ্জ্বল কীর্ত্তি বস্তীতে বস্তীতে স্কুল স্থাপন। আঞ্জুমানের যে সদস্যারা নিজেদের আশেপাশে জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে দরিদ্র মহিলা ও শিশুদের শিক্ষা দিয়েছেন, তাঁরা রোকেয়ার মতই, আগে কোন স্কুলচৌকাঠে পা রাখেন নি। ১৯১১ সালে রোকেয়ার স্কুল প্রতিষ্ঠার সময় সমগ্র পূর্ব ভারতে একটিও মুসলমান মহিলা স্নাতক ছিলেন না। রোকেয়ার প্রেরণায় এঁরা বস্তী স্কুলে শিক্ষকতা করে ক্রমশঃ বিদূষী, সমাজকর্মী ও সর্বজনবরেণ্য শিক্ষাবিদ হয়েছেন।
    ১৯১৯ সালে বিদ্যাসাগর জন্মশতবর্ষে ৮ রিপন স্ট্রিটে রোকেয়া প্রায় ছয়শো’ মুসলমান মহিলার সম্মেলন করেন। সভায় বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ও নারীভোটাধিকারে সমর্থনের প্রস্তাব গৃহীত হয়। ফলে, মুসলমান পরিবার সচেতন হয়ে আধুনিক স্কুল স্থাপনে ব্রতী হন। সেবছরেই কলকাতা রাজাবাজারে মুসলমান মহিলা শিক্ষয়িত্রী ট্রেণিং স্কুল স্থাপিত হয়। কবি কামিনী রায়ের নেতৃত্বে ১৯১৯ থেকে নারীভোটাধিকারে আন্দোলনে আঞ্জুমানের সদস্যাদের ঊজ্জ্বল ভুমিকায় দেখা যায়। নারীসমিতির সাধারণ সম্পাদিকা কুমুদিনী মিত্র, যুগ্ম সম্পাদিকা ছিলেন লীলা নাগ ও সাকিনা সুলতানা মুয়াজ্জেদা। বৃটেনেও তখন ভোটাধিকার থেকে নারী বঞ্চিত। বঙ্গীয় লেজিসলেটিভ কাউন্সিলে নারী বিরোধীদের বৃটিশের চাটুকার আখ্যা দিয়ে রোকেয়া ব্যঙ্গাত্মক “আপীল” কবিতা প্রকাশ করেন। প্রস্তাবের বিরোধী সুহারাবর্দী মন্তব্য করেন,‘এদেশে মেয়েরা এমন কি করেছে যে তাঁরা ভোটাধিকার দাবী করে?’ প্রথম মুসলমান মহিলা আইনজীবী সাকিনা সুলতানা হাইকোর্ট বার লাইব্রেরীতে বলেন,‘মহিলাদের তোমরা কোন সুযোগ দিয়েছ? তাঁদের জন্য একটি স্কুল করেছ?’ বস্তীতে মহিলাদের স্কুলপ্রতিষ্ঠা সংবাদ শুনে সকলে বিস্মিত! করপোরেশনে মেয়র চিত্তরঞ্জন ও ডেপুটি মেয়র সুহারাবর্দী নির্বাচিত হলে, নেবুতলায় স্থাপিত দুটি ফ্রিস্কুল অধিগ্রহণ করে করপোরেশন স্কুলের যাত্রা শুরু হয়। করপোরেশনে নেতাজী কর্মাধ্যক্ষ হয়ে তাঁর সহপাঠী অধ্যাপক ক্ষিতীশপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়কে দায়িত্ব দিলে, বিদ্যাসাগর দৌহিত্র ক্ষিতীশপ্রসাদ ফ্রি স্কুল স্থাপন করতে শুরু করেন। আঞ্জুমানের স্কুলগুলি ক্রমশঃ করপোরেশন স্কুলে রূপান্তরিত হয়। আশুতোষ ও রোকেয়ার অনুরাগী ফজলুল হক, আবুল কাশেমের নেতৃত্ত্বে সেকালে শিক্ষাবর্জনের আত্মঘাতী নীতি অগ্রাহ্য করে মুসলমান সমাজ আধুনিক স্কুল স্থাপনে ব্রতী হন। বাংলায় গ্রাম শহরে জাতি ধর্ম নির্বিশেষে দারিদ্র্য পীড়িত অন্ধকার ঘর শিক্ষালোকিত হতে থাকে।
    রোকেয়ার প্রয়াণে আঞ্জুমানে খাওয়াতীনে ইসলামের কর্মধারা বহমান রাখেন তাঁর হাতে গড়া নেত্রীবৃন্দ:- ১)সাকিনা সুলতানা মুয়াজ্জেদা M.A. B.L. তিনি নারী ভোটাধিকার আন্দোলনে জন্মলগ্নের থেকে নেত্রী। তাঁর পিতা ইরাণ থেকে নির্বাসিত স্বাধীনতা সংগ্রামী আগা মইদুল ইসলামের ৫ কন্যাই ছিলেন গ্র্যাজুয়েট, সাকিনা দ্বিতীয়া। তাঁদের 4 মেডিকেল কলেজ রোডের বাড়িতে ‘হাবলুল এ মতীন’ পত্রিকা অফিস ও খুজিস্তা আখতার বানুর অর্থে গভর্ণেস পরিচালিত বালিকা মাদ্রাসা ছিল। কলকাতায় এই ভবনে ১৬.২.১৯১৩ মহিলা সভায় রোকেয়া প্রথম ভাষণ দেন। সাকিনা কলকাতা হাইকোর্টে প্রথম মুসলমান মহিলা আইনজীবী। তাঁর স্বামী ছিলেন I.C.S. সাখাওয়াত স্কুল 1927 সাল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বীকৃতি লাভের সময় সাকিনা প্রধান শিক্ষয়িত্রী। তিনি রোকেয়ার স্মৃতিরক্ষার ভারপ্রাপ্তা হন। তিনি করপোরেশনে নির্বাচিত কাউন্সিলার। তাঁর বাড়িতে 14 মিডল রোডে Scavengers Womens’ Union প্রতিষ্ঠা করে সভানেত্রী হয়ে ‘ধাঙড়রাণী’ আখ্যা প্রাপ্ত হন। তাঁদের জন্য দাবীপত্র পেশ করে ধর্মঘট করেন। বিশ্বযুদ্ধকালে বৃটিশ সরকার তাঁকে ভারত থেকে অপসরণ করে। রোকেয়া অনুগামী এই মুক্তিসংগ্রামীর কন্যাকে বিবাহ করেন তালতলার শান্তি মুখার্জী। এই অনন্যা মানবাধিকার কর্মী অধুনা জনমানস থেকে বিস্মৃত।
    ২)শামসুননাহার মাহমুদ M.A, M.B.E.(১৯০৮-৬৪) প্রথম রোকেয়া জীবনী লেখিকা। মাত্র সতের বছরে বিধবা তাঁর মা আসিয়া খাতুন কন্যা শামসুন নাহারকে বলতেন, রোকেয়া অসামান্যা,তাঁর জীবনের ঘটনাবলী লিখে রাখতে। নিজেই কথাচ্ছলে রোকেয়া জীবনের অজস্র উপকরণ সংগ্রহ করেন। সম্ভবতঃ রোকেয়া ওঁর সঙ্গে শিশুশিক্ষা নিয়ে মতবিনিময় করেছেন। সন্তানপালনে আসিয়া খাতুন সর্বকালের আদর্শ জননী। ‘বুলবুল’ সম্পাদক ভাইবোন হবিবুল্লাহ বাহার ও শামসুন নাহার নিজেদের গড়েছেন, সমাজের হতাশা দূর করে জাতিগঠনে সার্থক হয়েছেন। রোকেয়ার অনুপ্রেরণায়, শামসুন নাহার বাংলাভাষী মুসলমান সমাজে দ্বিতীয় মহিলা গ্র্যাজুয়েট হয়েছেন,স্বামী-সন্তান,সংসার-সমাজের প্রতি সব দায়িত্ব পালন করে। সেজন্য স্কুলভবনে তাঁকে আন্তরিক সম্বর্ধনা দিয়ে রোকেয়ার জীবনাবসান হয়। রোকেয়ার স্বপ্ন পূর্ণ করতে আঞ্জুমানের মুখ্য দায়িত্ব গ্রহণ করেন শামসুন নাহার মাহমুদ। ১৯৩৬ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক মহিলা সম্মেলনে তাঁর ভাষণ বিশ্বসমাজের স্বীকৃতি অর্জন করে। দরিদ্র শিশু ও মহিলাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য,সংস্কৃতি ও সুস্থ জীবিকার স্বার্থে, নির্বাচনে মহিলা প্রতিনিধি আসন সুনিশ্চিত করার লক্ষ্যে তাঁর সুচিন্তিত লেখা ও সংগঠিত ভূমিকার জন্য তাঁকে ১৯৪৪ সালে M.B.E. দেওয়া হয়। লেডী ব্রেবোর্ণ কলেজ প্রতিষ্ঠাকালে তিনি বাংলার অধ্যাপক হন। দেশভাগ হতে ঢাকা ইডেন কলেজে অধ্যাপনা ও নিখিল পাকিস্তান মহিলা সমিতির আন্দোলন মাধ্যমে, তিন তালাক ও বহুবিবাহ প্রথার দুরাচার বন্ধ করেন। রোকেয়ার এই সার্থক উত্তরসূরী রামমোহন, বিদ্যাসাগরের মত ধর্মশাস্ত্র কোরাণের যথাযথ ব্যাখার মাধ্যমে ধর্মের নামে অবিচার ও বৈষম্য সমগ্র পাকিস্তানে আইনের মাধ্যমে নিবারণ করে, ইসলামের মানবাধিকার বার্তা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেছেন। নজরুল স্নেহধন্য বাংলাদেশ মুক্তিশহিদ মামুন মাহমুদ তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র।
    ৩)আনোয়ারা বাহার চৌধুরী (১৯১৯-৮৭) রোকেয়ার সাক্ষাৎ ছাত্রী ও দেশভাগ কালে সাখাওয়াত স্কুলের প্রধান শিক্ষয়িত্রী ছিলেন।শৈশবে মাতৃহারা আনোয়ারা তাঁর মাসী সাহিত্যিক মামলুকুল ফাতেমা খানমের স্নেহে মানুষ। স্বশিক্ষিতা সাহিত্যিকা মিসেস এম.ফাতেমা খানমের নারীশিক্ষা ছিল ধ্যান জ্ঞান। রোকেয়ার মতই তিনি স্বনামে ‘বেগম’ লেখা পরিহার করতেন। আনোয়ারা বেথুন কলেজ থেকে বি.এ. পাশ করার আগে তাঁর সব বিবাহ প্রস্তাব তিনি তৎক্ষণাৎ নাকচ করেছেন। শামসুননাহার তাঁর বড়ভাই হবিবুল্লাহ বাহার সঙ্গে বিবাহ প্রস্তাব দিলে তিনি “স্ত্রীর প্রতি স্বামীর কর্তব্য” বিষয়ে হবু বর কে রচনা লিখতেবলেন। নজরুল স্নেহধন্য, রেকর্ড জয়ী মহামেডান ফুটবল অধিনায়ক,বুলবুল সম্পাদক হবিবুল্লাহ বাহার সন্তোষজনক রচনা লিখে তাঁকে তুষ্ট করেন। মাতৃহারা মেয়ে যে ‘ফ্যালনা’ নয়, সমাজ ও পাত্র, পরে পৃর্বপাকিস্তানের প্রথম স্বাস্থ্যমন্ত্রী, সচেতন হলেন। কলেজ জীবনে আনোয়ারার রবীন্দ্রসংস্কৃতির সঙ্গে নিবিড় পরিচয় হয়। “রবীন্দ্রসাহিত্যের সদর-খিড়কি,অন্দর-বাহির, অলি-গলি, সব তাঁর মনোদর্পণে। বাংলা সাহিত্যের এমন সার্থক সাধক আর দেখিনি” লিখেছেন সহকর্মী শহীদ জননী জাহানারা ইমাম। রবীন্দ্রনাথ রোকেয়ার শিক্ষাভাবনা ‘নন্দনচর্চায় হৃদয়বৃত্তির বিকাশ’ এই বোধ সংস্কৃতিমনস্ক আনোয়ারা বাহারের অন্তরের সম্পদ। সম্মিলিত মহিলা সংগঠনের উদ্যোগে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজিত ১৯৪১ সালে ২৪ আগস্ট রবীন্দ্রস্মরণ সভায় ‘আঞ্জুমানে খাওয়াতীনে ইসলাম’ সম্পাদিকা হিসাবে তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি ছিলেন লেডী ব্রেবোর্ণ কলেজে আংশিক সময়ের বাংলা অধ্যাপক। স্কুলে ও কলেজে তাঁর ছাত্রী, ‘বহুরূপী’র অন্যতমা মুখ্যঅভিনেত্রী সাজেদা আসাদ গভীর কৃতজ্ঞতায় স্মৃতিচারণ করেন, ‘শিল্পসংস্কৃতির মাধ্যমে ভাঙা মনে শান্তি দিতে তাঁর জুড়ি ছিলনা’। তিনি স্কুলে চিত্র, নৃত্য, সংগীত, আবৃত্তি, অভিনয় প্রচলন করে ছাত্রীদের আনন্দের জগৎ সৃষ্টি করেন। ঢাকায় সব বাধা অগ্রাহ্য করে তাঁর নতুন স্কুলে “সুরবিতান” সংস্কৃতিকেন্দ্র এবং পরে স্বজনবন্ধুদের সহায়তায় ‘বুলবুল একাডেমী’ প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁদের সংস্কৃতিপ্রসার সার্থক হয়। রবীন্দ্রভক্ত, রোকেয়ার এই প্রিয় ছাত্রী ও তাঁর সাথীদের অবদানে বাংলাদেশে ‘জাতীয় উৎসব’ হয়েছে ‘নববর্ষ’,ভাষাদিবস। শৈশবে মাতৃহারা আনোয়ারা মধুর ব্যক্তিত্বে পরিচিত সর্বজনের হন ‘মাতৃসমা’।
    বেগম সুফিয়া কামাল (১৯১১- ৯৯) রোকেয়ার স্কুল প্রতিষ্ঠার বছরে বরিশালে জন্মগ্রহণ করেন। শিক্ষায় অগ্রসর বরিশালে স্বচ্ছল পরিবার থেকে তখন ভারতখ্যাত মহিলা শিক্ষাবিদ থাকলেও, সম্পন্ন মুসলমান পরিবারে কয়েক জনের গৃহশিক্ষা ছাড়া কোন মহিলার প্রথাগত শিক্ষা ছিলনা। সুফিয়ার শৈশবে তাঁর বাবা আধ্যাত্মিক টানে সংসার ছেড়ে চলে যেতে, মা গভীর সংকটে পড়েন। শিশু সুফিয়ার আকুলতায় মা ছেলে বেশে বড়োদের অগোচরে তাকে দিনকয়েক পাঠশালায় পাঠিয়েছেন। সাতবছরে মায়ের সাথে কলকাতা এসে তিনি রোকেয়াকে দেখেছেন। ‘সম্ভ্রান্ত’ পরিবার স্কুলে ভর্তি করেনি।বাড়িতে বাংলা নিষিদ্ধ, লুকিয়ে বইপত্র পড়া। ১৯২৩ সালে স্কুল ছাত্র সৈয়দ নেহাল হোসেনের সঙ্গে বিয়ের পর বরিশাল এসে মুক্তি ঘটে। স্বামীর উৎসাহে সাহিত্য ও সমাজসেবা শুরু। ‘তরুণ’ পত্রিকায় তাঁর কবিতা প্রকাশ হলে স্বয়ং কামিনী রায় বাড়ি এসে আশির্বাদ করেন।সৈয়দ নেহাল হোসেন কলকাতা সেন্ট জেভিয়ার্সে ভর্তি হন। তালতলায় থেকে দম্পতি রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, শরৎচন্দ্র, গান্ধীজী, নেতাজী, সাকিনা সুলতানা, লীলা রায়, শামসুন নাহার প্রমুখ সকল মনীষীর সঙ্গে আলাপ করেছেন, দেশ গঠনের কাজে সাধ্যমত যোগ দিয়েছেন। ১৯২৮ সালে কলকাতা কংগ্রেসে সভাপতি মতিলাল নেহরুর সাথে অভ্যর্থনা সমিতিতে তিনি আঞ্জুমানের প্রতিনিধি রূপে পরিচিত হন। ১৯২৯ থেকে তিনি আঞ্জুমানের স্কুলশিক্ষিকা। রোকেয়ার প্রেরণায় প্রথম মুসলমান মহিলা কলকাতার আকাশে প্লেনে ঘুরে আসেন।তাঁর লেখা ‘সওগাত’ পত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকে। ১৯৩২ সালে রোকেয়ার আকস্মিক প্রয়াণকালে, তাঁর পরমবন্ধু স্বামী সৈয়দ নেহাল হোসেন ক্ষয়রোগে প্রাণ হারান। এই মৃত্যুশোকে, চরম আর্থিক দুর্গতিতে তাঁর জীবন বিপর্য্যস্ত হয়ে যায়। তাঁর শুভকর্ম স্মরণ করে সকল সুজন তাঁর পাশে দাঁড়ান। ক্ষিতীশপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় পরীক্ষা নিয়ে তাঁকে করপোরশন স্কুলে শিক্ষয়িত্রী করেন। আবুল ফজল চট্টগ্রাম থেকে নিয়মিত তাঁর খোঁজ নিতেন। তিনি তখন দুঃখশোকে প্রায় মৃত্যুশয্যায়। সকল শুভানুধ্যায়ীদের উদ্যোগে ১৯৩৯ সালে উচ্চশিক্ষিত উদার সাহিত্যিক কামালুদ্দীন খান সসম্মানে তাঁকে বধূরূপে গ্রহণ করেন। জীবনের অভিজ্ঞতায় সুফিয়া কামাল খাঁটি সোনা হয়ে ওঠেন। সাহিত্যপ্রীতি ও শিল্পবোধ নিয়ে সকল অবিচারের বিরুদ্ধে, ক্ষমতাদর্পীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন। তিনি ছিলেন জাতির বিবেক। তাঁর আদর্শ ছিলেন রোকেয়া। তাঁর শক্তি ছিলঅসহায়, নিপীড়িতদের প্রতি অপরিসীম ভালবাসা। অধুনা বিশ্বে বিদ্যাসাগর রোকেয়া ভাবনায় ‘সকলের জন্য, মাতৃভাষায় যুক্তিবাদী শিক্ষা’ অতীব প্রাসঙ্গিক।
    প্রাণতোষ বন্দ্যোপাধ্যায় সাধারণ সম্পাদক- রি.ভা.র. রোকেয়া ইনস্টিট্যুট অব ভ্যালু এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ, যতীন্দ্রমোহন অ্যাভেন্যু, কলকাতা ৭০০১১২।
    আহ্বায়ক, গবেষণা কেন্দ্র, বিদ্যাসাগর দ্বিশত জন্মবার্ষিকী নন্দনকানন উদযাপন কমিটি সম্মিলিত প্রয়াসে বৌদ্ধ ধর্মাঙ্কুর সভা ১, বুদ্ধিষ্ট টেম্পল স্ট্রীট, কলকাতা ৭০০০১২
    তথ্যসূত্র:
    ১. মতিচূর, রোকেয়া, সুরাহা- সম্প্রীতি সম্পাদনা মীরাতুন নাহার, সলিল চক্রবর্তী, প্রাণতোষ বন্দ্যোপাধ্যায়
    ও পদ্মরাগ, রোকেয়া, প্রকাশক গ্রন্থকর্ত্রী
    ২. দি মুসলমান পত্রিকায় রোকেয়া প্রসঙ্গ, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, লায়লা জামান।
    ৩. মহারাণী সুচারু দেবীর জীবন- কাহিনী, প্রভাত বসু, ই-২৩ সি.আই.টি. বিল্ডিং, কলিকাতা-১৪
    ৪. বেগমরোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন স্মারকগ্রন্থ,সম্পাদক সেলিনা বাহার জামান,বুলবুল পাবলিশিং,ঢাকা
    ৫. রোকেয়া যুক্তিবাদ, নবজাগরণ ও শিক্ষা সমাজতত্ত্ব, সম্পাদনা আনোয়ারুল্লাহ ভুঁইয়া, রোদেলা প্রকাশনী।
    ৬. বেগম শামসুননাহার মাহমুদ স্মারক গ্রন্থ, সম্পাদক সেলিনা বাহার জামান, বুলবুল পাবলিশিং, ঢাকা ৭.আনোয়ারা বাহার চৌধুরী স্মারক গ্রন্থ, সম্পাদক সেলিনা বাহার জামান, বুলবুল পাবলিশিং, হাউস, ঢাকা
    ৮. পথে চলে যেতে যেতে,সেলিনা বাহার জামান, বুলবুল পাবলিশিং হাউস, ঢাকা ৯.শামসুননাহার মাহমুদ ও সমকালীন নারীসমাজের অগ্রগতি, শাহিদা পারভীন,বাংলা একাডেমী, ঢাকা। ১০.দাঙ্গায় শহিদ আমীর হোসেন চৌধুরী, আমিনুর রহমান সুলতান, বাংলা একাডেমী, ঢাকা।
    ১১.বাঙালি মুসলিম নারীর আধুনিকায়ন, সোনিয়া নিশাত আমিন,বাংলা একাডেমী, ঢাকা।
    ১২.জ্যোতির্ময়ী রোকেয়া, এম আবদুর রহমান, বুলবুলপ্রকাশনী, কলকাতা-১৬
    ১৩. সুফিয়া কামাল, সেলিম জাহাঙ্গীর, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী।
    ১৪. নারীমুক্তির পথিকৃৎ, মফিদুল হক, কথা, কলকাতা
    ১৫. ভক্তকবি মধুসূদন রাও ও উৎকলে নবযুগ, অবন্তী দেবী, প্রকাশক অমরনাথ ভট্টাচার্য, কলকাতা- ২৯
    ১৬. রেবা রায়, লুচি যাইথিবা এক প্রভাতী তারা, সুষ্মিতা রথ, কটক।
    ১৭. আত্মচরিত, ফকীরমোহন সেনাপতি, মৈত্রী শুক্ল, সাহিত্য আকাদেমী, নয়া দিল্লী।
    ১৮. কলকাতা কর্পোরেশন গ্রন্থাগার, সৌজন্যে শ্রী শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়।
    ১৯.ভারত সভা, ফেডারেশন হল ও ব্রাহ্মসমাজ গ্রন্থাগার, ধর্মতত্ত্ব পত্রিকা
    ২০.সাক্ষাৎকার: বীরেন রায় ও কিশোয়ার জাহান, R.I.E. (N.C.E.R.T.),ভুবনেশ্বর প্রাক্তনী সমিতি।

    নিউজফ্রন্ট এর ফেসবুক পেজে লাইক দিতে এখানে ক্লিক করুন
    WhatsApp এ নিউজ পেতে জয়েন করুন আমাদের WhatsApp গ্রুপে
    আপনার মতামত বা নিউজ পাঠান এই নম্বরে : +91 94745 60584

    LEAVE A REPLY

    Please enter your comment!
    Please enter your name here