বিষয় সহিষ্ণুতা -আমার কিছু বলার আছে- দেবাশীষ মুখার্জী

0
133

 

“বিষয় সহিষ্ণুতা -আমার কিছু বলার আছে”-দেবাশীষ মুখার্জী

 

দেবাশিস মুখার্জী

উনিশশো সাতচল্লিশ এর দশই মে ‘জামাত-এ-ইসলাম কি দাওয়াত ‘ নামে একটা পুস্তিকা জামাত-এ -ইসলাম কর্তৃক প্রকাশিত হয় I সেখানে লেখা হয়-“”প্রথম অংশে (পড়ুন পাকিস্তানে) আমরা জনমত সংগঠিত করবো যাতে পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র ইসলামী আইনের উপর ভিত্তি করে প্রণীত হয় I অন্য অংশে (পড়ুন হিন্দুস্তানে) আমরা হবো সংখ্যালঘু এবং আপনারা(হিন্দুরা) হবেন সংখ্যাগুরু I আমরা আপনাদেরকে অনুরোধ করবো -,কৃষ্ণজী,বুদ্ধ , গুরু নানক এবং অন্যান্য সাধু-স্যান্টদের জীবন ও শিক্ষ্যা অধ্যয়ন করতে I দয়া করে বেদ ,পুরাণ শাস্ত্র এবং অন্যান্য বই-পুস্তক পাঠ করুন I এইসব থেকে যদি আপনারা কোনো ঐশ্বরিক দিক নির্দেশনা লাভ করেন তাহলে তার ভিত্তিতে আপনারা নিজেদের শাসনতন্ত্র তৈরী করুন I এবং আমাদের সাথে একেবারে আপনাদের ধর্মের লাইন অনুযায়ী ব্যবহার করার জন্যই আমরা আপনাদেরকে অনুরোধ করবো I এ নিয়ে আমরা কোনো আপত্তি করবো না “”-(জামাত-এ -ইস.এ.সলাম :X -rayed by S.E .HASSNAIN .URDU PRESS WEEKLY BOM BAY ও ১৫.০৮.১৯৫৭)
গত আটষট্টি বছর ধরে ভারতবর্ষে হিন্দুত্ববাদী দলগুলো নি:সন্দেহে তাঁদের ধর্ম বেশ গুরুত্ব সহকারেই অধ্যয়ন করছে এবং নিরঙ্কুশ ক্ষমতা লাভ করে দিল্লিতে বসতে
না বসতেই জামাত-এ -ইসলামের উপদেশ অনুসারে দেশের শাসন ব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নিয়েছে I এতে কোনো সন্দেহ নেই I এরা যেভাবে সমস্ত নাগরিকের খাওয়া,পড়া ,চিন্তাধারা নিয়ন্ত্রণ করতে উঠে পরে লেগেছে তা থেকে এই সিদ্ধান্তই স্বাভাবিক বলে মনে হয় I
এই সমস্ত মূলত: আধুনিক সভ্যতার শত্রুরা পারলে সংখ্যালঘু জনগণকে তাদের সমস্ত রকম নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করে জামাত-এ-ইসলামের প্রতিষ্ঠাতা
মওদূদির ইচ্ছা পূরণ করে তাকে বিশেষ শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করার সব রকম রাজকীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে তাতেও কোনো সন্দেহ নেই I


মওদুদির কথা মাথায় রেখে হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তি গুলো অত্যন্ত সক্রিয় হয়ে উঠেছে I
গত কয়েক মাস ধরে এদের যা উৎপাত দেখছি তাতে ভয়ঙ্কর এক অসহিষ্ণুতার অভ্যাস পাচ্ছি যা আগামী দিনে নি:সন্দেহে আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠবে I আর এটা জেনেই
দেশের তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলো এই অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ শুরু করে দিয়েছে I
এইসব ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলোকে তথাকথিত বলায় আমার একটা দায়িত্ব থেকেই যায় ব্যাপারটা খোলাসা করার I আমি এদের তথাকথিত বললাম তার কারণ হলো-
১.শাহাবানু মামলায় এরা মুসলিম সাম্প্রদায়িক শক্তিকে সহিষ্ণুতার পাঠ পড়ায় নি I
২.সালমান রুশদির স্যাটানিক ভার্সেস কে নিষিদ্ধ করার ব্যাপারে মুসলিম সাম্প্রদায়িক শক্তি গুলোর হৈ চৈ এর বিরুদ্ধে সরব হয়ে তাদের সহিষ্ণুতার পাঠ পড়ায় নি I
৩.শ পাঁচেক মুসলিম সাম্প্রদায়িক মানুষের দাঁপাদাঁপিকে পেঁদিয়ে ফ্লাট করার পরিবর্তে তাদের দাবি মেনে তাসলিমাকে দেশ ছারতে বাধ্য করার সময় ও এরা কিন্তু ভুলেও
ওদের সহিষ্ণুতার পাঠ পড়ায় নি I যত সহিষ্ণুতার কথা এইসব দলগুলো তুলে রেখেছে হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তি গুলোর জন্য I
এইসব কারণেই ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলো আজ সাধারণ মানুষের কাছে তথাকথিত হয়ে গেছে Iতা হলেও যে বিষয় নিয়ে এরা সহিষ্ণুতার কথা বলছে তা কিন্তু গুরুত্ব সহকারে
আলোচনা করার দাবি রাখে I
১৯০৬ সালে লর্ড মিন্টোর কাছে আঁগা খাঁ র নেতৃত্বে হিন্দু-মুসলিমদের জন্য পৃথক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা র দাবী জানালো ভারতবর্ষের উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণী স্বার্থ রক্ষাকারী মুসলিম লীগ I এবং সেই দাবি আইনসভায় পাশ হয়ে গেল I পাশ হওয়ার সাথে সাথে ভারতবর্ষে শুরু হয়ে গেল সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে নির্বাচন I শেষ মেষ
কি হলো আমরা দেখলাম ভারত ভাগ হলো ; ভাগ হলো বাংলা পাঞ্জাব, ভাগ হলো মউন্টব্যাটানের কৃতিত্বে কাশ্মীর|আমরা দেখলাম সাম্প্রদায়িক শক্তি সমগ্র উপমহাদেশ জুড়ে এক অভিশাপের মতো বিরাজ করতে থাকলো I

এই অভিশাপের বিরুদ্ধে বহু দেশ বরেণ্য নেতৃ স্থানীয় ব্যাক্তিবৃন্দ আগেও আওয়াজ তুলেছেন এবং এখনো তুলছেন I কিন্তু সাম্প্রদায়িক শক্তি উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে I
কারণটা কি ?কারণটা হলো মূলে কেউই কুঠারাঘাত করেনি I
“সাম্প্রদায়িকতা এসেছে সম্প্রদায় থেকে I সম্প্রদায় এসেছে ধর্ম থেকে I তাই ধর্মই হলো সাম্প্রদায়িকতার মূল I ধর্ম থাকলে সম্প্রদায় থাকবে Iসম্প্রদায় থাকলে সাম্প্রদায়িক শক্তি থাকবে এবং সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাও সংগঠিত হতে থাকবে I সেই দাঙ্গায় জড়িয়ে যাবে রাক্কা,রাখাইন , রংপুর, গোধরা, মুজাফ্ফরপুর,পাকিস্তান,ইরাক,ইয়েমেন, সিরিয়া I
রক্ত ঝরবে সাধারণ মানুষের; নেপথ্য মুনাফা কামাবে বহুজাতিক !
এখন কথা হলো সহিষ্ণুতার পক্ষে গ্রহণ যোগ্য সমাধান কি হতে পারে? উত্তর খোঁজার আগে চলুন ইতিহাস হাতড়ে দেখে নিই কোনো পথ খুঁজে পাওয়া যায় কিনা I

আজ থেকে প্রায় ৪২৭ বছর আগে একজন মানুষ আজকের দিনের সবচেয়ে কাম্য সহিষ্ণুতার পক্ষে
সব চেয়ে বেশি সরব ছিলেন । তিনি বলতেন ধর্মের কারণে কারো বিঘ্ন ঘটানো হবেনা এবং প্রত্যেক
কে তাঁর পছন্দ মতো ধর্ম গ্রহণ করতে দিতে হবে ।
তিনি বলতেন -যুক্তির উপর বিশ্বাস প্রাধান্য পেতে পারেনা । যুক্তি দিয়েই নিজের উত্তরাধিকার সূত্রে
পাওয়া বিশ্বাসকে সমর্থন এবং প্রয়োজন হলে প্রত্যাখ্যান করতে হবে ।
আজ থেকে প্রায় সোয়া চারশ বছর আগে এই অধ্যায়ের শুরুর ‘তিনি’ ,বলতেন -যুক্তি অনুসরণ
করা ও ঐতিহ্যবাদ প্রত্যাখান করার প্রয়োজনটা এত উজ্জ্বলভাবে প্রকট যে তা বিতর্কের ঊর্দ্ধে ।
যদি ঐতিহ্যবাদ সমীচীন হতো ,ধর্মগুরুরা স্ব স্ব পূর্বগামীদের অনুসরণ করতেন এবং নতুন বার্তা
নিয়ে আসতেন না ।
অর্থাৎ এই দুনিয়ায় ধর্ম থাকত একটাই।নতুন ধর্ম আসতোনা ।তিনি আরও একটা কাজ করতেন।
বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের নিয়ে আলোচনা সভার আয়োজন করতেন ।তাঁর সভায় নাস্তিকেরাও আমন্ত্রিত হতেন ।
সেই সময় প্রগতিশীল শিক্ষা -দীক্ষাহীন অনগ্রসর এক রক্ষনশীল সমাজের বুকে তিনি এই যে কাজগুলো
করতেন তা আমি মনে করি এক সাংস্কৃতিক বিপ্লব ! এবং তিনি এই কাজ করতেন সমাজে মূলত:
অসহিষ্ণুতার পরিমণ্ডল কে বিনাশ করার জন্যে ।তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে ভিন্ন ভিন্ন ধর্ম থাকলে
অসহিষ্ণুতাও থাকবে এবং সমাজে হিংসাও থাকবে।এইজন্য তিনি হিংসার থেকে বাঁচার জন্য নিয়ে এসেছিলেন –
দিন-ই-ল্লাহি যা আসলে ছিল বিভিন্ন ধর্মগুলোর সর্বোত্তম সিদ্ধান্তগুলো নিয়ে রচিত সর্বধর্ম সমন্বয়কারী এক
গ্রন্থ ।উদ্দেশ্য ছিল প্রজাদের মধ্যকার দ্বন্দ্বের অবসান ঘটিয়ে সহিষ্ণুতার পরিমণ্ডল সৃষ্টি করা ।
এই মহান মানুষটাকে আমি আর তিনি তিনি করে উল্লেখ করবোনা।মহান এই মানুষটার পরিচয় হলো
তিনি ভারতবর্ষের বাদশাহ আবু ‘ল -ফাথ -জালাল-উদ-দিন মোহাম্মদ আকবর সংক্ষেপে আকবর !
আমরা যাঁরা সহিষ্ণুতার পক্ষে ,সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, হাঙ্গামা ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে তাদের আমি মনে করি যে
বাদশাহ আকবরের দেখানো পথটাকে বিকশিত করে লক্ষ প্রাপ্তিতে এগিয়ে যেতে হবে ।
বিকশিত করার কথা বলছি এইজন্য যে সর্বধর্ম সমন্বয়ের মাধ্যমে অসহিষ্ণুতার বিপক্ষে লড়াই সম্ভব নয় ।
এটা আজ প্রমাণিত সত্য ।এই সমন্বয়ে যেহেতু ধর্ম ব্যাপারটা থেকেই যায়;তাই থেকে যায় ধর্মভিত্তিক
অসহিষ্ণুতাও । উপযুক্ত সময়ে সে তাঁর দাঁত,নখ বার করে ধ্বংসের লীলাখেলায় মেতে ওঠে । তাই আমাদের
যা করতে হবে সেটা সেটা হলো ধর্ম মুক্ত মানবিক সমাজ -যা হবে মানব কল্যানে নিবেদিত প্রাণ।

এখন প্রশ্ন হলো যে ধর্ম মুক্ত মানব সমাজ আমরা কিভাবে গঠন করবো ? আমার মনে হয় এ
ব্যাপারে যে পদক্ষেপ গুলো নেওয়া দরকার তা হলো –
১.ধার্মিক শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভাবে তুলে দিতে হবে।
২.শিক্ষা ব্যস্থায় এক দেশ এক নিয়ম প্রয়োগ করতে হবে ।
৩.পাঠ্যসূচিতে যুক্তিবাদ কে একটা আবশ্যিক বিষয় হিসাবে পড়াতে হবে ।
৪.সম্পূর্ণ ভারতবর্ষে স্কুলের ফর্ম থেকে ধর্মের উল্লেখ ব্যাপারটা থেকে সরিয়ে দিতে হবে ।
৫.সমস্ত ধার্মিক প্রতিষ্ঠানের স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করতে হবে।
৬.ধার্মিক প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত আর্থিক সাহায্য প্রদানকারীগণের সূচি তৈরী করতে হবে।
এবং তাঁরা যে পরিমান দান করে তা নিয়মিত তাদের কাছ থেকে সংগ্রহ করতে হবে।
৭.সমস্ত ধার্মিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্কুল ,কলেজ ,বিশ্ববিদ্যালয় ,হাসপাতাল ,গবেষনাগার ইত্যাদিতে
রূপান্তরিত করতে হবে।
৮.ধর্মের প্রকৃত স্বরূপ, যা সত্যি সত্যি অত্যন্ত অমানবিক ,তা মানুষের সামনে তুলে ধরতে হবে ।
এ কাজ ধর্ম ব্যবসায়ীরা কখনো করবে না ।
৯. আঠার বছরের কম বয়সী দের ধর্ম শিক্ষা থেকে দূরে রাখতে হবে ।
“10. ধর্ম ভিত্তিক সমস্ত ‘পার্সোনাল ল ‘ বাতিল করতে হবে ।

“ঝট করে ধর্ম মুক্ত মানব সমাজের গঠন এর উপায় লিখে ফেললাম কত সহজে !তাই না ? তবে হ্যাঁ , এ তো ঠিক কথাই যে কাজটা লিখে ফেলার মতো সহজ নয় ।এ কথা আমিও জানি
আপনিও জানেন । বাঁধা আসবে । ভয়ঙ্কর বাঁধা ।
বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের দাম ধার্য্য
করা হয়ে গেছে ।শুধু ব্যক্তি বিশেষে একটু উনিশ বিশ হতে পারে ।এটা করেছে দেশের
সাম্প্রদায়িক মদতপুষ্ট অসহিষ্ণু এক দল পশুবৎ প্রাণী ! এক দল প্রকাশ্যে ;বিপরীত শক্তির
দল একেবারে সরব না হলেও বর্তমানে উপযুক্ত সময়ের প্রতীক্ষায় আপাত দৃষ্টিতেও নীরব নয়।
এ হলো দেশের অভ্যন্তরীণ বাঁধা ।আন্তর্জাতিক বাঁধা হলো আমেরিকা ! অবাক হবেন না ।
রাক্কা থেকে রাখাইন পর্যন্ত যদি ধর্ম ভিত্তিক দাঙ্গা হাঙ্গামা না হয় তা হলে দেশটা না খেতে
পেয়ে স্রেফ মারা যাবে । যে হারে অস্ত্র জুগিয়েছে ‘আই এস আই এস’ কে তা কল্পনাতীত ।
আর তার দোসর আরব ও ইসরায়েল তলে তলে মিলে মিশে ব্যাপারটার দীর্ঘস্থায়িত্বের গ্যারান্টি দিচ্ছে ।এ দুটোর সাধারণ শত্রু শিয়া প্রধান ইরান |আমেরিকার ও শত্রু আবার ইরান !এ পর্য্যন্ত ইহুদি -সুন্নি-শিয়া এবং সিআইএ |শুনে রাখুন এর সাথে যোগ হবে হিন্দু আতঙ্কবাদী ।
আমেরিকার সাথে বিজেপি ও বিভিন্ন ধার্মিক দল গুলোর ভালোই সম্পর্ক আছে ;তারা প্রয়োজনে
সব রকম সাহায্য পাবে ।ইসরায়েলের সাথে বিজেপির ও এখন ভালো সম্পর্ক ।এইভাবে দুয়ে দুয়ে চারের মতন বুঝে নিন যে রাক্কা থেকে রাখাইন পর্য্যন্ত অসহিষ্ণুতাপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখলে কার লাভ? ক্ষতিই বা কার ? সে ব্যাপারে কিছু বলার প্রয়োজন আছে কি ? ক্ষতি কার হবে সেটা সবাই জানে | বলাইবাহুল্য সাধারণ মানুষের ।

নিউজফ্রন্ট এর ফেসবুক পেজে লাইক দিতে এখানে ক্লিক করুন
WhatsApp এ নিউজ পেতে জয়েন করুন আমাদের WhatsApp গ্রুপে
আপনার মতামত বা নিউজ পাঠান এই নম্বরে : +91 94745 60584

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here