যাপিত জীবনের পাশে আছে অন্য এক সমান্তরাল জীবন

0
444

যাপিত জীবনের পাশে আছে অন্য এক সমান্তরাল জীবন

মানবেন্দ্রনাথ সাহা-অধ‍্যাপক,বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়

(সমস্ত ছবি-সংগৃহিত)

সমান্তরাল

পরিচালক : পার্থ চক্রবর্তী

অভিনয় : পরমব্রত, ঋদ্ধি, সুরঙ্গনা, সৌমিত্র, কুশল, অপরাজিতা, তনুশ্রী, অনিন্দ্য
⭐⭐⭐⭐
৬.৫ / ১০

বাঙালি মধ্যবিত্ত সর্বদা দুরকম জীবন যাপন করে এসেছে। এক জীবন সে দেখাতে ভালোবাসে, অন্য জীবন সে লুকোতে ভালোবাসে। পারিবারিক সম্মান, পাড়া-প্রতিবেশির দোহায় দিয়ে সে আসলে সত্যটাকেই গোপন করতে চায়। আর সেই চাপে অনেক সুকোমল প্রাণ চাপা পড়ে যায়। প্রতিটি মানুষের নিজের মতো করে বাঁচার ও ভাবার অধিকার আছে। কিন্তু সেটা না বুঝতে চায় পরিবার না বুঝতে চায় রাষ্ট্র!
এই ছবিতে পার্থ মধ্যবিত্তের এক সমান্তরাল গোপন জীবনের কথা শুনিয়েছেন সুজনের জীবন দর্শনের মধ্য দিয়ে : উত্তর কলকাতার মধ্যবিত্ত বাঙালি এক পরিবার। বাবা অবসর নেওয়া অধ্যাপক। তার তিন ছেলে এক মেয়ে। মেয়ে -জামাই গাড়ি দুর্ঘটনায় আচমকা মারা গেলে তাদের সন্তান অর্ক হোস্টেল থেকে মামা বাড়ি আসে। বড় মামী( অপরাজিতা) তাকে সন্তান স্নেহে ভালোবাসে। কিন্তু আপনভোলা, মানসিক ভাবে অসুস্থ মেজোমামা সুজনকে ( পরমব্রত) তার ভালো লেগে যায়। তার চোখ দিয়েই সুজন চরিত্রের মানসিক দহন, বিকৃতকাম ইত্যাদি ধরা পড়লেও সেই সুজনের শিল্পীসত্তার আবিষ্কারক। সুজনের মানসিক সমস্যা আছে। কিন্তু সেই সমস্যাকে গোপন করে ছবিটিকে শেষ পর্যন্ত টেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
পরিচালক ইচ্ছে করেই তা করেছেন। ভাগ্নে অর্কর  সঙ্গে দর্শকও তাকে বিকৃতকাম ভাবতে থাকে। পরিচালক তাই শেষে মোচড়টা দিয়েছেন। আবার তাকে উন্মাদও ভাবতে থাকে দর্শক। অথচ তার ভিতরেই লুকিয়ে আছে জীবনানন্দের কবিতা, বেহালার সুর মূর্ছনা, জীবনের গভীর অন্বষণ। আর তার এই যাপিত জীবনের সবকিছু প্রাণপণে লুকোতে চায় গোটা পরিবার।
অর্কর আবিষ্কারে সুজন কিছুটা খোলা হাওয়া পায়। বাধা সত্ত্বেও অর্ক আর তার বান্ধবি তিতলি তাকে নিয়ে বের হয়। সে এক আনন্দ নিয়ে আনে সুজনের মনে। কিন্তু সুজন একদিন বাড়ি থেকে পালায়। ছোট ভাই (অনিন্দ্য) কড়া হাতে শারীরিক ভাবে তাকে নিগ্রহ করে। এর পিছনেও কাজ করে মধ্যবিত্তের উপরে ওঠার স্বার্থ। পরিবারের দুশ্চিন্তার ভিতরে সুজনকে পাওয়া গেল বেশ্যা পাড়ায়।
অর্কর বান্ধবি তিতলি। তারও কৌতুহল মেজোমামাকে নিয়ে। একদিন সুজন তিতলির শরীরে হাত রেখে বলে : আমার না একটা শরীর চাই, তোর মতো শরীর। এই দৃশ্য দেখে ভুল বোঝে অর্ক। স্বার্থে ঘা লাগায় সেও মামাকে অ্যাসাইলামে রেখে আসতে যায়।
তিতলি বোঝে মেজো মামা কামুক নয়, সে তার শরীরে অন্য কিছু খুঁজতে যায়। এই সুজন আবার কুমোরটুলিতে কাঁচা দেবী মূুর্তিতে হাত দেয়। আশ্চর্য এক জীবন অন্বেষণ করে চলে।
সুজনের ছোট ভাই তাকে নির্বাসনে পাঠাতে চায়, হত্যা করতে চায় আর অর্ক, তিতলি, অর্কর বড় মামি সুজনের প্রতি সংবেদনশীল। অসহায় বাবার আর্তি ঝরে পড়ে তার কথায়। তার কথাতেই জানা যায় সব। গোপনীয়তার সমস্ত কারণ। এই সুজন পরোক্ষভাবে ছোট বৌ-এর সম্মান বাঁচায়। যদিও সেটা আরোপিত মনে হয়। তারপর সকলের কৌতুহল অবসান ঘটিয়ে সুজন বেছে নেয় আত্মহননের পথ। এটাই তার মুক্তি এই সমাজে। “আমারে চিনি না আমি ” তাঁর আত্মহনন কি সেই নিজেকে চেনার খোঁজ নাকি সমাজের প্রতি, পরিবারের মধ্যবিত্ত মানসিকতার প্রতি সপাট আঘাত!
সুজন আসলে গোপনে নারী শরীর কামনা করে। নারী লোলুপ নয় সে, সে নারী হতে চেয়ে এসেছে শরীরের সেই আশৈশব গঠন নিয়ে। তাকে দেখে সেই মেয়েলিপনা বোঝার উপায় নেই। পরিচালক সেটা হতে দিতেও চাননি। একদিন তার নারী শরীর কামনার ইতিবৃত্ত ধরতে গিয়ে অর্ক দেখে নারীবেশী মেজোমামাকে। আর তখনই পিতার হাহাকার ভেসে আসে : ওকে আটকে রেখে পুরুষ মানুষ করতে চেয়েছিলাম।
এই সামাজিক ভয় যা সুজনকে নিজের পছন্দের জীবন বেছে নিতে দেয় নি। জীবন হনন করে নিতে বাধ্য করেছে।
সমান্তরাল ছবিতে প্রধান চরিত্রে পরমব্রতর অভিনয় সুন্দর। তৃতীয় লিঙ্গ বহনকারী সত্তা নিয়ে সে তার প্রকাশকে চমৎকার দেখিয়েছে। মানসিক অসুস্থ সে নয় তবু তাকে তাই করে রাখা হয়েছে – এই অসহায়তা প্রকাশে পরম সফল। আবার অর্কর সংস্পর্শে এসে তার মুক্ত প্রাণের অভিব্যক্তিও ভালোলাগে। অধ্যাপক পিতার অসহায়ত্ব ফোটাতে সৌমিত্র আবার তাঁর সফলতার পরিচয় দিলেন। অর্ক চরিত্রে ঋদ্ধি সেন খুবই সাবলীল। বিশেষত মামার সঙ্গে তার ইন্টারকসনে। তবে তার গলার স্বরের অ্যাডলোসেন্স প্রবণতা এবার কাটানো দরকার! অর্কর বান্ধবির চরিত্রে সুরঙ্গনা একদম যথাযথ। অপরাজিতা ও কুশল চিত্রনাট্যের চাহিদা মতো অভিনয় করে গেছেন। ছোটভাই কৌশিক চরিত্রে অনিন্দ্য বড্ড লাউড। তনুশ্রীর ছোট ভূমিকা ভালোই।
ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্তের সুরে এই ছবির গানগুলি ছবিটিকে আলাদা মাত্রা দিয়েছে। অরিজিৎ সিং, শ্রেয়া ঘোষাল, দেব অরিজিৎ, রূপঙ্করের গাওয়া গানগুলি ছবির আখ্যানে প্রাণের সঞ্চার করেছে। বিশেষত: পরমব্রতর গান : ভালোবাসার গান। তুই ছুঁলি যখন, দেখা হবে বলে, দূরবীন গানগুলি ছবির আবহরূপেও মানিয়েছে।
সুজনের মৃত্যু আর তার প্রতি অবিচারের গ্লানি সকলের ভিতরে একটা অপরাধ ও মনখারাপের বেদনা বহন করে আনে ছবির শেষে। প্রশ্ন ওঠে : আমরা কেন এরকম বলতে পারো?
দুঃখ হয় সুজন ছিল অনেক মানুষের থেকে অনেক বড় মনের মানুষ। আত্মহননের আগে সে চিঠি লিখে যায় অর্ককেই : মানুষকে সম্মান দিস অর্ক, সবরকম মানুষকে।
তবু এই জীবন যেখানে সবরকম বেঁচে থাকা পাশাপাশি চলতে চায়, সমান্তরাল চলতে চায়। ও জীবন রে। তোর মন এক বড় ঘর, এক উঠোন। আমাদের এই জীবন যেখানে স্বার্থ আর পবিত্রতা সমান্তরাল চলতেই থাকে। তাই চেনাটা অন্তহীন : ” খুঁজি তারে আসমান জমিন / আমারে চিনিনা আমি। ” এই সমাজ আমাকে কীকরে চিনবে?

নিউজফ্রন্ট এর ফেসবুক পেজে লাইক দিতে এখানে ক্লিক করুন
WhatsApp এ নিউজ পেতে জয়েন করুন আমাদের WhatsApp গ্রুপে
আপনার মতামত বা নিউজ পাঠান এই নম্বরে : +91 94745 60584

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here