সুলুর স্বপ্ন, সুলুর বেঁচে থাকা -‘তুমহারি সুলু’

0
333

সুলুর স্বপ্ন, সুলুর বেঁচে থাকা ‘তুমহারি সুলু’

পরিচালক : সুরেশ ত্রিবেণী

অভিনয় : বিদ্যা বালান, মানব কাউল, নেহা ধুপিয়া, বিজয় মৌর্য
⭐⭐⭐⭐
৭.৫/১০
ভারতীয় সিনেমায় নারীর বেঁচে থাকা আর লড়াই, স্বপ্ন ও স্বপ্ন ভঙ্গ নিয়ে অনেক সিনেমা হয়েছে। মাদার ইন্ডিয়া, মহানগর, পরমা, পারমিতার একদিন, মৃত্যুদন্ড, দামিনী তার ভিতর কয়েকটি। এই ধারায় একটু ভিন্ন সংযোজন সুরেশ ত্রিবেণী পরিচালিত তুমহারি সুলু। এটাই তাঁর প্রথম কাহিনি চিত্র।এর আগে তিনি অ্যাড ছবি নির্মাণ করতেন।
হিন্দি সিনেমায় এখন এক ধরনের স্বল্প বাজেটের ছবি হচ্ছে মধ্যবিত্ত জীবনের নানা দিকগুলিকে কেন্দ্র করে। ছবিগুলিতে তথাকথিত বৈভবের পরিবর্তে লঘু মননের একটা ব্যাপার থেকে যাচ্ছে। ফলে দর্শক কিছুটা ভিন্নরুচির স্বাদ পাচ্ছেন। আবার সম্পূর্ণ বিনোদনধর্মী ছবিও এগুলি নয়।
তুমহারি সুলু এরকম গোত্রের একটি নিটোল ছবি। ছবির কেন্দ্রে আছে মুম্বাই-র একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের মাঝবয়সী গৃহবধূ সুলোচনা দুবে যে সুলু নামে ও ডাকে বেশি পরিচিত। অসম্ভব প্রাণোচ্ছল এক নারী যে সব সময় কিছু কিছু করতে চায়। নিছক গৃহবধূর পরিচয়ে চাপা পড়তে চায় না। তাই আবাসনের বার্ষিক অনুষ্ঠানে মুখে লেবু চামচ নিয়ে দৌড় হোক কিম্বা রেডিওতে গৃহবধূদের জন্য নানা প্রতিযোগিতাই হোক সবেতে সে অগ্রণী। আর এইভাবেই তার জীবনে এসে যায় অদ্ভূত একটা কাজের সুযোগ। সেটাকে সে ব্যবহার করতে চায় নিজেকে প্রকাশ করতে ও সংসারে আর্থিক কিছু সুরাহা করতেও।
আলবেলি অঞ্জলি -র রেডিও শো-তে সে পেয়ে যায় একটি পুরস্কার প্রেসার কুকার। কিন্তু সুলু আরো বড় স্বপ্ন সে টিভি পাবে। কিন্তু সেই চাওয়া -পাওয়ার ভিতর তার জেদ আর স্বপ্নের কাছে পরাজিত হয় নাগরিক চাহিদা। সুলু ঐ রেডিও সংস্থায় হয়ে যায় মধ্যরাতের রেডিও জকি। তার কাজ মধ্যরাতে কাজ করা অটোচালক, মাতাল, কারখানার কর্মি প্রভৃতির মনপসন্দ গান শোনানো আর তাদের চটুল সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়া। কাজটা সহজ নয়। কিন্তু সুলুর গলা, সহকর্মীর সহায়তা, জেদ তাকে জনপ্রিয় করে তোলে মাদকতা মেশানো গলায় সুলু ভাবির হ্যালো মধ্যরাতের রেডিও মেহমানকে ঘায়েল করলেও এই পেশার ভিতর ঝুঁকিও আছে। সুলু কর্লগার্ল নয়, জকি। ফলে যৌনতা তার প্রধান হাতিয়ার হলেও তাকে প্রশ্ন-উত্তরে দেখাতে হয় ধারালো ছুরির মতো যাতে আহত হয়, কিন্তু স্থূল না হয় ছুরি!
এই সুলু একজন গৃহবধূ তাই স্বামী সংসার, ছেলেনিয়েই তার জগৎ। সেদিকটা চমৎকারভাবে সামলেছে সুলু। ভারতীয় গৃহিণী রূপে একহাতে সামলেছে সংসার, সমালোচনা, সন্তান, স্বামী সব। তবু কোথাও কিছু কম পড়লেই তার উপর নেমে এসেছে তীব্র সমালোচনা। তার বাবা, তার যমজ দুই বোন, এমনকি জকির কাজের জন্য তার অমন বন্ধু স্বামীও কটু কথা শুনিয়েছে। তবু সুলু আর পাঁচটা মেয়ের মতো কেঁদে ভাসায় নি। বরং তার স্বপ্নকে সাকার করতে বাড়িয়ে তুলেছে লড়াই আর জেদ : ম্যায় কর সকতি হ্যায়। এই তার স্পিরিট। এই স্পিরিট সুলুর প্রাণ। ছবিটিরও।

নব্বই দশকের হিন্দি সিনেমার গানে সুলুর জীবন বিভোর। তার মোবাইলের রিংটোন হোক হোক বা বসের জন্মদিনের পার্টি, অথবা এস.পি. বালাসুব্রমণিয়ামের গানের প্যারোডি সবেতেই সেই গান। স্বামীর সঙ্গে অনাবিল জীবন সঙ্গতে তার জীবনের বেঁচে থাকা অন্য মাত্রা পেয়ে যায়। সে জীবনে হারতে জানে না, হারাতেও না। সাকুল্যে তিনজন -এর মধ্যবিত্ত সংসারে একবারই পরাভব নেমে আসে সুলুর জীবনে। সে কেবল ছেলের স্কুলের একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে। সুলু জানান দেয় তার মাতৃ সত্তাকে। কিন্তু ওখানেই সে হারিয়ে যায়না। আবার নতুন আইডিয়া আবার স্বপ্ন! তবু শেষটা অন্যরকম স্বপ্নপূরণের গল্প হয়ে যায়।
অভিনয়ে একেবারে মাতিয়ে দিয়েছেন বিদ্যা বালন। সেন্স অব হিউমার, যৌনতা, শরীরের ব্যবহার, শাড়িতে মধ্যবিত্ত পৃথুলা গৃহবধূর চরিত্রে একাই ছবিটিকে ১৪৪ মিনিট টেনে নিয়ে গেছেন। লগে রহো মুন্নাভাই ছবিতে তার মাদকতা মেশানো গলাই শুনেছিলাম গুড মর্নিং মুম্বই। আর এখানে রেডিও জকির চরিত্রে সুলু ভাবি যখন বলে ওঠে : হ্যালো, সুলুকে সাথ কোন বাত কর রহা হ্যায়? কিংবা উচ্চকণ্ঠে তার হাসি বা নিজের নম্বর বলতে গিয়ে ১০০ উচ্চারণ সবেতেই সেই আালবেলি সুলু ভাবিকে জীবন্ত করেছে।
ছবির সবটা জুড়েই সুলু ভাবি। কিন্তু বিদ্যার অভিনয় অভিব্যক্তিতে চরিত্রটি কখনই যৌনস্থূলতায় পরিণত হয়নি। তার রসিকতা, খুনিসুটি, রাতের জকিসুলভ ছলাকলা, দুঃখ, যণ্ত্রণা প্রকাশ সবেতেই তিনি নিজের পূর্বের অভিনয়গুলিকে ছাপিয়ে গেছেন। কয়েকটি জায়গা আলাদা করে তবু বলার মতো ১. নিম্বু রেস এ দ্বিতীয় হয়েও প্রথমের স্ট্যন্ডে উঠে ছবি নেওয়া। ২. রেডিও অফিসে গিয়ে বলা : টিভি মিল সকতা হ্যায় ক্যায়া?
৩. স্বামীর সঙ্গে নানা খুনসুটি আর মজাদার সংলাপ : মেরেকো পার্টনারশিপ নহি জমতা। সুলুর মথিত কষ্টের ছবি বিদ্যার অভিনয়ে দুবার চমৎকার হয়েছে ১. জকির কাজে বিরক্ত স্বামীর অমতে আর ২. ছেলের স্কুলের আচরণে বিব্রত হওয়ার বেদনায়। মধ্যবিত্ত অল্পশিক্ষিত নারীর জীবনযাপনের নানা সূক্ষ্ম মেজাজ তার অভিনয়ে বড় পাওনা
সুলুর গতিময় জীবন স্বপ্নের দৌড়ে ক্লান্ত অথচ সুলুকে ভালোবাসে এমন বেচারা স্বামী অশোক চরিত্রে অসম্ভব ভালো ও যথাযথ পরিণত অভিনয় করেছেন মানব কউল। রেডিও অফিসের সহকর্মী ও সহযোগীরূপে পঙ্কজ চরিত্রটির নানা সেড চমৎকাট খুলেছে বিজয় মৌর্যের অভিনয়ে। রেডিও কোম্পানির বসের চরিত্রে অনেকদিন পর ভীষণ পরিমিত ও পারফেক্ট অভিনয়ে পাওয়া গেল নেহা ধুপিয়াকে। বসের গাম্ভীর্য ও মানবিকতার সংমিশ্রণে চরিত্রটিতে জীবন এনেছেন তিনি।দীর্ঘ ছবির ড্রামাটিক রিলিফ রূপে গানের ব্যবহার আলাদা গতি আনতে পারেনি। একাধিক সংগীত পরিচালকের মধ্যে গুরু রনধাওয়া, রজত নগপল, তানিষ্ক বাগচি অন্যতম। লক্ষীকান্ত -প্যারেলালের একটি গানকে যথাযথ ব্যবহার করা হয়েছে। গুরু রনধাওয়ার গাওয়া সুন মেরি রাণী গানটি আাগেই অ্যালবামে শোনা। কথা কিছু বদলে ভিন্ন মাত্রা ছবির গানে দেওয়া হয়েছে। গানটির প্রয়োগও চমৎকার। অন্যান্য গানদুটি তেমন জমেনি।
ক্যামেরায় আছেন কলকাতার ছেলে সৌরভ গোস্বামী। সরকারি আাবাসনের ডিটেল তার ক্যামেরায় যেমন সুন্দর তেমনি মধ্যবিত্ত সুলু ও অশেকের সংসারের খুঁটিনাটিও তার ক্যামেরা ধরেছে। ছবির বাজেটের কারণে ইন্ডোর শুট বেশি ফলে তার খুব বেশি কিছু করার ছিলনা এই ডিটেল টুকুকে সুন্দরভাবে ধরা ছাড়া।
আখ্যান নির্ভর এই ছবির সম্পদ সুলুর হয়ে ওঠার উপাখ্যান ও বিদ্যার অভিনয়। তার ভিতরে কয়েকটি দৃশ্য নির্মাণে পরিচালক সুরেশ বেণীর কৃতিত্ব অনস্বীকার্য। আবাসনের খোপে থাকা পায়রার ছটপটানি আর বন্দিত্বকে সুলুর জীবনের সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া হয়েছে। রেডিও অফিসের বৈভবের পাশে মধ্যবিত্ত জীবনে ফ্ল্যাটের আয়তন সংকীর্ণতাকে রেখে জীবনের গোটা চেহারাকে দাঁড় করানো হয়েছে।
এত সবের ভিতর যে প্রাপ্তিতে ছবি শেষ হয় তা নারীর জয়। নারীবাদের কোনো ধ্বজা না উড়িয়ে ভূষণকুমার ও অতুল কাসবেকর প্রযোজিত এই ছবি সুলুর স্বপ্ন ও বেঁচে থাকার কথা বলে আসলে নারীর জগৎ- কেই নির্মাণ করেছেন। যেখানে সুলু ভাবির জগৎ ঘিরে বাস করে আলবেলি অঞ্জলি, অফিসের বস মারিয়া, রাতের ট্যাক্সিচালক। নারীত্বের জগৎ এইভাবে তৈরি হয়েছে। পাশাপাশি নারীর যৌনতাকেন্দ্রিক ট্যাবুকেও
ভেঙেছেন পরিচালক। এমন কাজের সঙ্গে সুলু যুক্ত হয়েছে যাকে যৌনকর্মি বলা যাবেনা অথচ সেক্সি বাচনকে ব্যবহার করে বিনোদন করতে হবে – এই টানাপোড়েনে সুলু কি পিছিয়ে এল? এটা জানতে ছবি দেখতেই হবে। নারীর স্বপ্ন দেখাটা এই সমাজে ও সময়ে খুব জরুরি। সুরেশ ত্রিবেণীর তুমহারি সুলু তাকেই প্রশ্রয় দিয়েছে। এটাই ভরসার কথা।

মানবেন্দ্রনাথ সাহা।

ফিল্ম সমালোচনাড: মানবেন্দ্রনাথ সাহা

নিউজফ্রন্ট এর ফেসবুক পেজে লাইক দিতে এখানে ক্লিক করুন
WhatsApp এ নিউজ পেতে জয়েন করুন আমাদের WhatsApp গ্রুপে
আপনার মতামত বা নিউজ পাঠান এই নম্বরে : +91 94745 60584

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here