পল্লব দাস,বহরমপুরঃ
লোকসংস্কৃতির অন্যতম ধারা আলকাপ।পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ,বীরভূম ও মালদহ জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে প্রচলিত একটি লোকনাট্য শৈলী।পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য ছাড়াও বিহারের পূর্ণিয়া এবং ঝাড়খণ্ডের দুমকা জেলাতেও এক সময় জনপ্রিয় ছিল এই পালাগান।এই গানের উদ্ভব কোথায়,কীভাবে হয়েছিল তা সঠিক করে বলা এক দুরূহ ব্যাপার।
প্রখ্যাত লেখক ও প্রাবন্ধিক সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ একসময় আলকাপের সাথে প্রত্যক্ষ ভাবে জড়িয়ে ছিলেন।১৯৮২ সালে ‘দেশ’পত্রিকায় উনি একটি প্রবন্ধ লেখেন ‘আলকাপ,নাট্যরীতি এবং আর্ট থিয়েটার’। লেখক সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ নিজেই এই পালাগানের সাথে যুক্ত ছিলেন সেই জন্য উনি খুব কাছ থেকে এর অধ্যয়ন করতে সমর্থ হয়েছেন।সিরাজের মতে,আলকাপ নামের উৎপত্তি বা জন্ম সম্ভবত উত্তরবঙ্গেই,তবে এনিয়ে অনেকে অনেক মত পোষণ করেন।কেউ বলেন মুর্শিদাবাদের জঙ্গিপুর অঞ্চল থেকে এর জন্ম আবার বাংলাদেশের রাজশাহী থেকেও এর ধারা এসেছে বলে শোনা যায়।নাট্যকার এবং লেখক প্রদীপ ভট্টাচার্য বলেন,”অনুমান করা যায় মাত্র” অর্থাৎ সঠিক ভাবে আলকাপের উৎস সন্ধান বা কে প্রথম এটা মঞ্চস্থ করেন সেটা নির্দিষ্ট করে বলাটা সম্ভব নয় ।
মুর্শিদাবাদ জেলার ঐতিহাসিক গুরুত্বের সাথে সাথে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ভান্ডার যথেষ্ট সমৃদ্ধ।
কাঁসার বাসন,শোলা শিল্প ও মৃৎ শিল্প যেমন আছে তেমনি আছে এই জেলার নাট্যদল ও লিটল ম্যাগাজিনের জনপ্রিয়তা।পালাগানের একটা শাখা আলকাপ,জেলায় একসময় এর খুব কদর ছিল।এই জেলাতে ও ‘আলকাপ’ একটি লুপ্তপ্রায় লোকনাট্য সংস্কৃতি। কৌতুকধর্মী এই লোকনাট্যের অভিনয়ের বিষয় পৌরাণিক,গ্রাম্যকাহিনী অথবা সামাজিক। দশ-বারোজন শিল্পী নিয়ে আলকাপের দল গঠিত হয়।দলের প্রধানকে বলা হয় মোড়ল বা সরকার উনি গোটা নাটকের পরিচালনা ও সঞ্চালনার দায়িত্বে থাকেন তার সাথে থাকে একজন ভাঁড়,যে হাস্য রসের সৃষ্টি করতেন ।
আলকাপের ভাষায় যাকে বলা হয় ‘ক্যাপ্যাল’।
দলে থাকে দু’জন পুরুষ যারা নর্তকি যারা ‘ছোকরা’ ও ‘ছোকরি’ নামে পরিচিত এরা সেজে নাচ গান আর অভিনয় করত।ছোকরি বাছাই করা বেশ কঠিন কাজ ছিল ছোটো থেকেই এদের মেয়েদের চলন বলন শিখিয়ে গড়তে হতো তার ওপর গানের গলা থাকাটা ছিল আবশ্যক।আর থাকত দু-তিন জন যন্ত্র বাদক যারা ঢোল, হারমোনিয়াম, খঞ্জনী, বাঁশি তবলা ইত্যাদি বাজাতো আর দোহার। রাত্রিবেলায় উন্মুক্ত মঞ্চে আলকাপের অনুষ্ঠান হয় সাধারণত গ্রামের কর্মবিরতির পর শুরু হওয়া আনন্দ শুরু হতো উঠোনে বা ফাঁকা জায়গায়।নাচ,গান,ছড়া ,কৌতুক রস সমন্বয়ে ব্যাঙ্গাত্মক এক পালাগান ছিল আলকাপ।গম্ভীরা থেকে আলকাপ এই সৃষ্টি বলে অনেকে মত পোষণ করেন।নাট্য শিল্পী রাহুলদেব ঘোষ জানান ‘গম্ভীরা ‘থেকে আলকাপ কে আলাদা করেছে এর কিছু বৈশিষ্ট -আলকাপে সংলাপ ও অভিনয় সুনির্দিষ্ট কোনো আঙ্গিক নয়। উপস্থাপনীয় বিষয় সম্পর্কে একটা অস্পষ্ট ধারণা নিয়ে আসরের চাহিদা অনুযায়ী শিল্পীরা তা ফুটিয়ে তোলে।আলকাপ স্বতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষ এটিতে নাচ-গান-তামাসায় প্রধান ছিল।
আলকাপের প্রাণপুরুষ ওস্তাদ ঝাঁকসু।পঞ্চাশের দশকের তাঁর দল ছিল গোটা বাংলায় জনপ্রিয়তার শিখরে। শোনা যায় ওস্তাদ ঝাকসুর আলকাপ দলে বাঁশি বাজাতেন সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ,ঐ দলেই ছিলেন সুধীর দাস ছোকরি হিসেবে অভিনয়ে যার নাম ছিল বেশ জনপ্রিয়। লোকসংস্কৃতির গবেষক অধ্যাপক শক্তিনাথ ঝাঁ ২০০০ সালে ‘ঝাকসু’ নামে গ্রন্থ প্রকাশ করেন, আলকাপ সম্বন্ধে অনেক অজানা তথ্য পাওয়া যায় এই গ্রন্থে। সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের তথ্য লেখ্য ‘মায়মৃদঙ্গ’ আলকাপ নিয়ে কাহিনী উন্মোচন করে।’মায়া মৃদঙ্গ’ অবলম্বনে রচিত নাটক ‘মায়া’ স্যাস পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।প্রদীপ ভট্টাচার্যের প্রযোজনায় আলকাপ নিয়ে নাটকটি মঞ্চস্থ হয়। মুর্শিদাবাদের সাগরদীঘি,ভগবানগোলা,জীবন্তি ,কান্দী বিভিন্ন জায়গায় আলকাপ একসময় জনপ্রিয় ছিল।পরবর্তীতে মিশ্রণ আসে এই আলকাপে যার জন্য বর্তমানে অনেকেই সেই আদি গ্রামীণ আলকাপ সংস্কৃতির সাথে মেলাতে পারেন না।অনেকেই মনে করেন আলকাপে মহিলা শিল্পীদের প্রবেশ
পরবর্তীতে এর পরিবর্তন আনে।মিশ্রণটি ‘পঞ্চরস’ নামে এক নতুন রঙ্গরসের সৃষ্টি করেছে ।
আলকাপ আর হয়ত নেই।টেলিভিশন , মোবাইলে ইন্টারনেট,আধুনিক বিনোদনের মাধ্যম গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়ায় আলকাপ গানের জনপ্রিয়তা হ্রাস পেয়েছে এবং তা ক্রমশ বিলুপ্ত হওয়ার পথে এগিয়ে চলেছে।
মূলত পৃষ্ঠপোষকতা নেই বলে সংস্কৃতির এই সম্পদ হারাতে বসেছে আজ।বাংলা লোকসংস্কৃতি সম্বন্ধে সোচ্চার কিছু মানুষ জন এর হাত ধরে এই লুপ্ত প্রায় সংস্কৃতি হয়ত আবার নতুন দিক পাবে।
আরও পড়ুনঃ সাংবাদিক নিগ্রহে ডিজিপিকে স্মারকলিপি কোচবিহার প্রেস ক্লাবের
WhatsApp এ নিউজ পেতে জয়েন করুন আমাদের WhatsApp গ্রুপে
আপনার মতামত বা নিউজ পাঠান এই নম্বরে : +91 94745 60584