স্বনামের আড়ালে যামিনী রায় ধ্বংস করেছে হতভাগ্য এক প্রতিভাঃ প্রদোষ পাল

    0
    1070

    প্রথম পর্ব

    ধরা যাক আপনি খুব বড় শিল্পী। দেশজোড়া আপনার নামডাক। ছবির বাজারে চাহিদা এতো, এঁকে ক্রেতাদের জোগান দিতে হিমসিম খেয়ে যাচ্ছেন। হঠাৎ একদিন অজ পাড়া গাঁয়ের এক যুবক আপনাকে চিঠি দিল। এমন একটা সময় (১৯৪৯) যখন চিঠি ছাড়া যোগাযোগের প্রায় উপায় ছিল না। যুবকটির চিঠি পড়ে জানলেন সেও ছবি আঁকে। আপনার একজন গুণমুগ্ধ ভক্ত। সংবাদপত্রে আপনাকে নিয়ে যে প্রতিবেদন বেরিয়েছে তাতে ছাপানো ছবি দেখেই তার এই মুগ্ধতা। আর কোনোভাবে আপনাকে জানার উপায় ছিল না তার। কারণ ঐ অজ গাঁয়ে সংবাদপত্র ছাড়া আর কোনো ভাবে ছাপাই ছবি দেখার উপায় ছিল না তার।

    যুবকটির লেখা ও চিঠির সঙ্গে খসড়া আকারে পাঠানো ছোটো ছোটো ছবি আপনাকে মুগ্ধ করলো। শত ব্যস্ততা সত্বেও আপনি ছেলেটিকে চিঠি দিয়ে জানালেন আপনার মনের কথা। স্বাভাবিক ভাবেই আপনার মতো বিখ্যাত শিল্পীর প্রশংসা পেয়ে দ্বিগুন উৎসাহে দিন রাত সে ছবি আঁকতে থাকলো।

    নিবন্ধকারের সংগ্রহ থেকে প্রাপ্ত

    চিঠি দেওয়া নেওয়া, খসড়া পাঠানো চলতে থাকলো প্রায় দু বছর। আপনি যুবকটিকে তখনও চোখেই দেখেননি, কিন্তু তার আঁকা ছবি, ঝরঝরে গুছিয়ে চিঠি লেখা দেখে আপনি তাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করে দিলেন। নিজের ছেলের মতো আপন করে ভালোবেসে ফেললেন। ওদিকে সে উদগ্রীব আপনার সঙ্গে দেখা করার জন্য। প্রায় দু বছর পর আপনার বাড়িতে এল দেখা করতে। গ্রাম্য গরিব যুবক সাধারণত যেমন হয় তেমনই। শুধু আচার ব্যবহার, কথাবার্তা এবং অবশ্যই ছবি আঁকাতে আর পাঁচজনের থেকে আলাদা। কয়েকদিনের মধ্যে বাড়ির সবার কাছেও সে প্রিয় হয়ে গেল। আপনার স্ত্রী নিজের ছেলের মতো তাকে ভালোবেসে ফেললেন। বাড়ির অন্যান্যরাও দ্রুত তাকে আপন করে নিলেন।

    শুরু হলো নতুন এক অধ্যায়। প্রতি তিন মাস অন্তর সে আপনার বাড়িতে আসে। সঙ্গে করে নিয়ে আসে ইতিমধ্যে যা এঁকেছে সব। প্রতিবারে এলে কয়েকদিন করে থেকে যায়। চিলেকোঠার একটা ঘর তার জন্য বরাদ্দ হয়েছে। সেখান থেকে সে দ্যাখে কতো গণ্যমান্য ব্যক্তিরা বাড়িতে আসছেন আপনার সঙ্গে দ্যাখা করতে। স্বাভাবিক, যেহেতু আপনি ভারতবর্ষের অন্যতম অগ্রগণ্য শিল্পী। গণ্যমান্যদের আসারই কথা। অজ পাড়াগাঁয়ের যুবকটি ওপর থেকে দ্যাখে, সাহস করে কোনোদিন নিচে আসে না অন্যান্যদের সামনে। আপনার এতো পছন্দের একজন সন্তান সম, তবুও আপনি কোনোদিন আপনার পরিবারের বাইরে কারো কাছে ওর কথা বলেননি। কারো সঙ্গে কোনোদিন পরিচয় করিয়ে দেননি। ঘুনাক্ষরেও কাউকে জানতে দেননি যুবকটির কথা।

    নিবন্ধকারের সংগ্রহ থেকে প্রাপ্ত

    ওদের পরিবার যেহেতু খুবই গরিব, স্বাভাবিক ভাবেই তার বাবা মা পরিবার কিছুতেই চাইছিল না ছবি আঁকুক সে। অজ পাড়াগাঁয়ে কি ভবিষ্যত ছবি আঁকার? বাবা মা ও পরিবার চাপ দিতে থাকে ছবি আঁকা ছেড়ে দেওয়ার জন্য। বিশেষ করে বাবা। ছবি আঁকা নিয়ে প্রায়ই রাগারাগি করেন। তিনি চান ছেলেকে বিয়ে দিয়ে সংসারি করতে। বিয়ে দিলে যদি ছেলের মাথা থেকে ছবি আঁকার ভূত তাড়ানো যায়! এক পয়সা রোজগার তো দূরের কথা উল্টে রঙ কাগজের খরচ বেরিয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। ইতিমধ্যে সে আপনাকে বাবা বলে। আপনিও বাবাজীবন বলে সম্বোধন করেন তাকে। তো সেই বাবার স্মরনাপন্ন হলো ছেলে। কী করবে সে? তার নিজের বাবা যে কিছুতেই চায় না তার ছবি আঁকা! চিঠি দিল আপনাকে। অপনি চিন্তায় পড়লেন, একি কথা, এতো ভালো ছবি আঁকে ছেলেটা। যার ভবিষ্যত উজ্জ্বল। তাকে ও পথ থেকে সরিয়ে দেওয়া খুবই অন্যায়। চিঠি লিখলেন ওর বাবা’কে। বুঝিয়ে বললেন ছেলের প্রতিভার কথা। ওর ভবিষ্যত উজ্জ্বল। লেগে থাকলে কিছু হবেই।

    ভারতবর্ষের বিখ্যাত শিল্পী যখন বলছেন ছেলের ভবিষ্যত উজ্জ্বল, তখন তো মেনে নিতেই হবে। মেনে নিলেন তার বাবা। পরিবারের প্রয়োজনে ছেলের বিয়েও দিলেন। বৌমাকে চিঠিতেই আশীর্বাদ করলেন আপনি। একবার বৌমাকে নিয়ে ঘুরে যেতেও বললেন কলকাতায়। সেই মতো নববধুকে নিয়ে সে আপনার সঙ্গে দ্যাখা করেও গেল।

    প্রতি তিন মাস অন্তর যাতায়াত চলতেই থাকলো। আর প্রতিবারেই সঙ্গে করে নিয়ে আসতো তার আঁকা ছবি। আপনার বাড়িতেই রেখে দিয়ে চলে যেত সমস্ত ছবি। আপনি কখনো কখনো চিঠি মারফৎ কোনো ছবির বিষয় বলে দিতেন। ছেলেটি সেসব বিষয়ের ওপর ছবি এঁকে নিয়ে আসতো। আপনি অবশ্য বিনিময়ে সাহায্যও করতেন ওকে। যেমন, মাসিক ১০ টাকা করে মানিঅর্ডারে ওর নামে টাকা পাঠাতেন। বিয়ে করার পর ১০ টাকা বেড়ে হয়েছিল ১৫ টাকা। স্থানীয় গ্রামাঞ্চলের পট বা গাছের তলায় মানত করা টেরাকোটার ঘোড়া ইত্যাদি সংগ্রহ করে আনার জন্য অবশ্য বাড়তি টাকা পাঠিয়েছেন।

    এই যাতায়াত চলেছিল এক আধ বছর নয়। দীর্ঘ ২৩ বছর। চিঠি দেওয়া নেওয়া ইত্যাদি। আশ্চর্যের ব্যাপার! এই দীর্ঘ ২৩ বছর পরিবারের বাইরে একজনেরও কাছে পুত্রসম আপনার প্রিয় পাত্রটির কথা বলেন নি। কারো সঙ্গে কোনো দিন আলাপ পর্যন্ত করিয়ে দেননি। শুধু তাই নয় একবার আপনি যখন ঘোর অসুস্থ হয়ে বিছানায়। আর্টকলেজের ছাত্রছাত্রী সহ নানান মানুষ আপনাকে রোজ দেখতে আসছেন। আর ঠিক এমনই একটা সময় ওর আসার কথা আপনার বাড়ি। উপায় কী? তড়িঘড়ি আপনার ছেলে টেলিগ্রাম করে ওকে আসতে বারণ করলেন।
    ঝোলা থেকে বেড়াল বেরিয়ে পড়লো কী? তেমনই তো গন্ধ। সাধারণত আমাদের পারিবারিক জীবনে কী ঘটে? প্রিয়জন অসুস্থ হলে প্রিয়জনকে খবর দেওয়া হয়। এবং প্রিয়জনরা দেখা করতে আসে। এ যে উল্টো কেস! পুত্রসম প্রিয়জনকে অসুস্থ বাবাকে দেখতে আসতে বারাণ করা! তাও টেলিগ্রাম করে! বাপের জন্মে শুনেছেন?

    আরো অবাক হতে চান? দু এক বছরের মধ্যে সেই ভারত বিখ্যাত শিল্পী বাবার মৃত্যু হল অথচ পরিবারের তরফ থেকে একটা টেলিগ্রাম পর্যন্ত করে জানালো হলো না সে কথা। সংবাদপত্রে বিখ্যাত বাবার মৃত্যু সংবাদ জানল যুবক। গ্রামের বাড়িতে মস্তক মুন্ডন করে বাবার শ্রাদ্ধও করে সে।

    গ্রাম্য যুবকের জীবন থেকে একটা অধ্যায় মুছে গেল। মুছে গেল প্রতি তিন মাস অন্তর যাতায়াত কালে তেইশ বছর ধরে সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়া প্রায় দু’হাজার ছবির অস্তিত্ব। বাবাকে লেখা তার প্রায় আটশো চিঠি অদৃশ্য হয়ে গেল। ভাবী পৃথিবীর জন্য রয়ে গেল শুধু তাকে লেখা বাবার প্রায় সাড়ে তিনশো খানা চিঠি। আর প্রতি মাসে মানিঅর্ডারের সময় বাবার হাতের লেখা এক দু লাইনের একটা ছোট্ট চিরকুট। ছেলেটি প্রত্যেকটি মানিঅর্ডারের চিরকুট গুছিয়ে রেখেছে স্বযত্নে। কূল দেবতার পাশে রেখেছে শিল্পী বাবার ছবি। রোজ দু বেলা পূজো করে।

    বাবা যে কী সর্বনাশ তার করে দিয়ে গেছেন, গ্রাম্য ওই সরল যুবকের পক্ষে বোঝা সম্ভব ছিল না। আর তার খেসারৎ দিয়ে যেতে হলো জীবন সায়াহ্নের কয় বছরে।

    নিবন্ধকারের সংগ্রহ থেকে প্রাপ্ত

    আবার বলি, ধরা যাক আপনি বড় শিল্পী। ওই যে গ্রাম থেকে ছেলেটি আপনার চরণে নিজেকে উজাড় করে দিল, আপনার মতো দক্ষ শিল্পী তার ছবি দেখেই বুঝতে পারলেন আপনার প্রতি গভীর মুগ্ধতা আসলে ওকে দিয়ে আপনার ছবিরই আঙ্গিকে আঁকিয়ে নিচ্ছে। আপনার বোঝার কথা, যত দক্ষতাই থাক একজন প্রতিষ্ঠিত শিল্পীর অনুকরণে আর একজন ছবি আঁকলে কোনোদিনই তার পক্ষে বেশিদূর যাওয়া সম্ভব নয়। একজন অজ পাড়াগাঁয়ের যুবক, শিল্প জগত সম্পর্কে কিছুই যার ধারণা নেই। সে আপনার চরণে নিজেকে সঁপে দিয়েছে। গুরু স্থানীয় প্রতিষ্ঠিত আপনার তো উচিৎ ছিল তাকে নিজের পথ খুঁজতে বলা। তা না করে আপনি কী করলেন? আপনার অনুকরণের স্পষ্ট ছাপ থাকা সত্বেও প্রশংসায় ভরিয়ে দিয়ে তাকে গাছে তুলে রেখে দিলেন। মাটির যে কী ভূমিকা কিছুই সে জীবনে জানতে পারল না। আপনাকে ছবির জোগান, পটের জোগান, টেরাকোটার পুতুল জোগাড় করে এনে দিত বলে এই গ্যাস খাওয়ানো? তাহলে কী ‘বাবাজীবন’ সম্বোধন বা নিজের ছেলের আসনে বসানো সহ নানান গপ্প আপনি করেছেন, আপনার স্ত্রী করেছেন সেটাও কী ঐ স্বার্থের জন্য? অভিনয়?
    কেউ যদি নিজ সন্তান সম কাউকে ভাবে তবে কোন পৃথিবীতে তাকে রেখে যাচ্ছেন, সেটা চিন্তা করবেন না? আপনি কি বোঝেন নি, আগামী পৃথিবী ওর নকল করা ছবির স্টাইল নিয়ে হাসাহাসি করবে? অথচ আপনিও জানেন, আমরা যারা একটু আধটু আঁকা আঁকি করি, আমরাও জানি, সে যুগে নকল করাটাও কত কঠিন ছিল। প্রথমত যুবকটি যে অজ গ্রামে থাকত সংবাদপত্র ছাড়া অন্য কোনো মাধ্যমে ছবি দেখার কোনো উপায় ছিল না। দ্বিতীয়ত, কোনো ছবির প্রিন্ট প্রায় সে যুগে সহজলভ্য ছিল না। শহরে বাবার বাড়ি ছাড়া আর কোনো জায়গায় দীর্ঘ তেইশ বছর সে যায়নি। ফলে কোনো পত্রপত্রিকা সংগ্রহ করা সম্ভব ছিল না। তৃতীয়ত, বিখ্যাত শিল্পী বাবার স্টুডিওতে ঢোকার অনুমতি যে তার ছিল না তা আগেই বলেছি। তবে কোন দক্ষতায় বাবার স্টাইলে ছবি সে আঁকতে পারতো? আর এই দক্ষতা খুব হেলাফেলা করার মতো? শিল্পী বাবা কিন্তু একবারের জন্যও হেলাফেলা করেন নি। বুঝেছিলেন রত্নটিকে গুছিয়ে জল হাওয়া দিয়ে লালন করতে পারলে অনেক ফল দেবে। সেই ফলের জন্যই কী তবে নিজের পথ খুঁজে নেওয়ার সন্ধান দেখান নি? তাই কী ফলার গাছটিকে আগামী পৃথিবী থেকে আড়াল করে রেখেছিলেন? দীর্ঘ তেইশ বছর কারো সঙ্গে পরিচয় করান নি? পরিবারের বাইরে একজনও জানেন নি? এমনকি অসুস্থতার সময় পাছে সে এলে সব ওলট পালট হয়ে যায়, তাই তড়িঘড়ি ছেলেকে দিয়ে টেলিগ্রাম পাঠিয়েছিলেন? আর যেই আপনি পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন, গাছের কদর নিমেষে শূণ্যতে পরিণত হলো? এতোদিন ফল খাওয়া গাছটাকে একটা খবরও দিলেন না আপনার ছেলেরা। ‘বাবাজীবন’, ‘ভাই’ সব ফুৎকারে উড়ে গেল? বাকী জীবন কী অসহনীয় অবস্থায় সে কাটাল তার কোন খোঁজ রাখলেন না কেউ!

    এতোক্ষন যা বললাম, এর এক বর্ণও মিথ্যে নয়। কল্পনা নয়। সমস্ত প্রমান রয়েছে বিখ্যাত বাবার লেখা চিঠিতে। আসলে এমনই হয়, ইতিহাসকে আড়াল করে রাখতে চাইলেই কী আড়াল করা যায়? ঘটনাচক্রে আমাদের হাতে যে এতোগুলো চিঠি এসে পড়বে কে ভেবেছিল?
    আশাকরি আপনারা ইতিমধ্যে বুঝে নিয়েছেন কাদের কথা বলতে চাইছি। স্বনামধন্য শিল্পী যামিনী রায়, আর হতভাগ্য যুবক বসন্ত কুমার জানা’র কথা।

    আমার দাদা অতীশ পালের নিরলস চেস্টায় (সমস্ত চিঠি আমার দাদা অতীশ পালের কাছে সংগৃহীত) ২০০৫ সালে বসন্ত জানার অকথিত অধ্যায় জন সম্মুখে আসে। সে সময় মিডিয়ার অতি রঞ্জিত সংবাদ পরিবেশন আর কিছু ধূর্ত ধান্দাবাজ, ঘোলা জলে মাছ ধরা মানুষদের জন্য ব্যাপারটা প্রচার পেলেও জনমানসে কিছুটা বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। আর তার পরিণামে শেষ বয়সে বসন্ত বাবুকেও যেমন কিছু শিল্পীদের দ্বারা অপমানিত হতে হয়, আমাদের দাদা ভাইয়ের ওপরও নেমে আসতে থাকে চরম টিকা টিপ্পনী, অপমানজনক মন্তব্য। এবং একঘরে করার প্রবনতা। যা আজও কম বেশি বর্তমান।

    যাক, সে অনেক কথা। পরে আবার বলবো। আপতত কিছু চিঠি এই লেখার সঙ্গে পেশ করলাম যা যামিনী রায়ের স্বহস্তে লেখা।

    নিউজফ্রন্ট এর ফেসবুক পেজে লাইক দিতে এখানে ক্লিক করুন
    WhatsApp এ নিউজ পেতে জয়েন করুন আমাদের WhatsApp গ্রুপে
    আপনার মতামত বা নিউজ পাঠান এই নম্বরে : +91 94745 60584

    LEAVE A REPLY

    Please enter your comment!
    Please enter your name here