ঐতিহ্যের আলোকে মাদ্রাসা শিক্ষার ভবিষ্যৎ

    0
    1031

    আসিকুল আলম(শিক্ষক)

    (ভারতের শিক্ষা ইতিহাসে মাদ্রাসা শিক্ষা একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। বলা ভালো মাদ্রাসা শিক্ষার অবদান অস্বীকার করে এদেশে শিক্ষা ইতিহাস রচনা অসম্পূর্ণ।কিন্তু ইতিহাসের গতি পথে রাজনীতির বিভিন্ন পালাবাদলের বাঁকে মাদ্রাসা শিক্ষা বারবার জর্জরিত বহু প্রশ্নবাণে।সেই বির্তকের যথার্থতা কতটা ইতিহাস সম্মত? কিবা প্রয়োজন সমান্তরাল এই শিক্ষা ব্যবস্থার? শিকড়ের রস খুঁজে ভবিষ্যতের অন্বেষণে এই লেখা।আজ প্রথম পর্ব। সর্বস্তরের পাঠকের মূল্যবান মতামত ও গঠন মূলক কঠোর সমালোচনা কাম্য। যা এই অন্বেষণকে সমৃদ্ধ করবে।)

    -: প্রথম পর্ব :-

    বর্ণময় ঐতিহ্য ও বিবিধতায় ভারত এক বৈচিত্র্যময় দেশ শক,হুন, পাঠান, মোঙ্গল, পর্তুগীজ কিংবা ব্রিটিশ নানান সময়ে তাঁদের কিছু না কিছু ছাপ রেখে গেছেন এ দেশের ঐতিহাসিক পটভূমিতে। ব্রহ্মচর্য থেকে গুরুগৃহে পাঠ দানের সমান্তরালে নানা ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা অঙ্কুরিত হয়। সময়ের আবর্তন গতিতে কিছু শিক্ষা ব্যবস্থা মহীরুহ রুপ ধারণ করলেও বাকি সব, হয় অঙ্কুরে কিংবা তার কিছু পরে লুপ্ত হয়েছে।

    চিত্রে কলকাতা মাদ্রাসা কলেজ, ওয়েলেসলি স্কোয়ার, ১৮৪৮

    ইতিহাসের বিভিন্ন দশায় ঘাত প্রতিঘাতের মধ্যে বেড়ে ওঠা অন্যতম ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা ব্যবস্থা হল মাদ্রাসা।অষ্টম শতাব্দীর গোড়ায় মহম্মদ বিন কাসেমের ভারত জয়ের মাধ্যমে এদেশে মাদ্রাসা শিক্ষার এক প্রকার গোড়াপত্তন হয়। তৎকালীন পুঁথিগতশিক্ষা ও ধর্মশিক্ষা দান প্রথা ছিল অনেকটাই একই মুদ্রার এ পিঠ ও পিঠ। বৈদিক যুগের ব্রাহ্মণরাও এই প্রথার বিপরীতধর্মী ছিলেন না।

    ঐতিহাসিক ক‍্যালকাটা মাদ্রাসা

    ভারতে মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা মুহাম্মদ ঘোরীর হাত ধরে ও পরবর্তীকালে সুলতানি আমলে তা বিশেষ উৎকর্ষতা লাভ করে। তবে সুলতানি আমলে এক বিশেষ পদক্ষেপ লক্ষ্য করা যায়। মাদ্রাসা গুলোতে ইসলামী ও সাধারণ শিক্ষাদানের উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয় এবং তৎসঙ্গে সুলতানরা ধর্মীয় আলোচনার জন্য মসজিদ নির্মাণের উপরেও যথেষ্ট গুরুত্ব দেন। এক্ষেত্রে মাদ্রাসাগুলোকে শিক্ষা দানের স্থান হিসেবে গড়ে তোলার মৌলিক প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়।

    সুদূরপ্রসারী চিন্তা ভাবনা থেকে মোগল শাসকরা অনুভব করেন, জনগণের শিক্ষা হল শাসকের দায়িত্ব। একটি বিশেষ বিভাগ খোলার মাধ্যমে আকবর মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নতি সাধন করতে চেয়েছিলেন।রাজকার্য পরিচালনা, যুদ্ধক্ষেত্রে পরামর্শ দান, রাজবাড়ির শিক্ষা দীক্ষা, আইনি ক্ষেত্রে , তৎকালীন শাসকরা প্রায়শই মাদ্রাসাতে শিক্ষিত উলেমাদের মুখাপেক্ষী থাকতেন।

    ওড়গ্রাম চতুস্পল্লী হাই মাদ্রাসা যার ৬০% ছাত্র-ছাত্রী অমুসলিম

    ব্রিটিশরা তাঁদের রাজত্বকালে শাসনকার্য ও আদালতের আইন কানুন পরিচালনার জন্য শিক্ষিত মুসলিমদের মুখাপেক্ষী থাকতেন। অনেক অফিস কাছারির দায়িত্বও তাদের হাতে ন্যস্ত থাকত।

    উক্ত আলোচনা থেকে স্পষ্ট যে মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা বিভিন্ন জাতির হাত ধরে বহু উত্থান পতনের মাধ্যমে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করেছে। মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার উপর মন্তব্য করতে গিয়ে ইংরেজ ঐতিহাসিক হান্টার উল্লেখ করেন, “এ দেশটা আমাদের দখলে আসার আগে মুসলমানরা শুধু শাসনকার্যেই নয়, শিক্ষা ক্ষেত্রেও ভারতের শ্রেষ্ঠ জাতি ছিল।”

    দেশ স্বাধীনের বহু বছর পরেও আমাদের মধ্যে মাদ্রাসা ও মানব সম্পদ উন্নয়নে তার যথাযথ ভূমিকা সম্পর্কে অস্পষ্ট ধারণা রয়েই গেছে।
    মাদ্রাসা কি? সাধারণ বিদ্যালয়ের থেকে এর আলাদা ভূমিকাই বা কি? মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা কতখানি ধর্মনিরপেক্ষতা বজায় রাখে? ইত্যাদি ইত্যাদি।

     

    “মাদ্রাসা” একটি আরবি শব্দ; যার অর্থ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। যেমন বাংলা শব্দ বিদ্যালয় কিংবা ইংরেজি শব্দ SCHOOL তেমনই ভাবে ‘মাদ্রাসা’ শব্দের অর্থ পাঠভবন। অর্থাৎ বলা যেতে পারে, ভাষাভেদে ভিন্ন নাম। উদ্দেশ্য এক ও অভিন্ন। তাই মাদ্রাসা কেবলমাত্র মুসলিমদেরই প্রতিষ্ঠান এমনটা হতে পারে না যেমন মিশন স্কুল বলতে শুধুমাত্র খ্রীষ্টানদের প্রতিষ্ঠান আমরা ভাবি না।
    আবার এও ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে যে মাদ্রাসা হল ধর্মীয় শিক্ষার প্রতিষ্ঠান।
    এক সময়ে মাদ্রাসাগুলোকে ভাবা হতো থিয়োলজি পড়ার পীঠস্থান এবং ভবিষ্যতে ছাত্র ছাত্রীরা ধর্মীয় প্রচারক বা প্রবক্তাতে পরিণত হোন।
    বহু পূর্বেই যখন মসজিদে কিংবা পাঠশালায় ইমাম ও মোয়াজ্জিনরাই শিক্ষাদান করতেন তখনও তাদের শিক্ষাদান শুধুমাত্র কোরান ও হাদিসের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলনা। প্রাথমিক চিকিৎসা, বংশ শাস্ত্র,অশ্ব চালনা, যুদ্ধবিদ্যা, হস্তলিপি বিদ্যা, শরীর চর্চা ইত্যাদি পাঠদানও করা হত।

    বর্তমানে আধুনিক পাঠক্রমে মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার সুদূরপ্রসারী বিস্তার রয়েছে। মূলধারার সমস্ত বিষয় সংযোজিত হয়েছে আধুনিক পাঠক্রমে। যদিও থিয়োলজি ও আরবিক ভাষা শিক্ষা সিলেবাসের কিছুটা অংশ জুড়ে রয়েছে।পশ্চিমবঙ্গে মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা বহির্বিশ্বেও যথেষ্ট গুরুত্ব পায়। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, এরাজ্যের মাদ্রাসাগুলোতে প্রচুর হিন্দু ছেলেমেয়েরা পড়াশুনো করছে। এখানেই আমরা ভারতবাসীরা সাম্যের গান গাওয়ার যথার্থতা খুঁজে পাই। নবজাগরণের পথিকৃৎ রাজা রামমোহন রায়, মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থায় ধর্মনিরপেক্ষতার নিদর্শন স্থাপনে উজ্জ্বল নক্ষত্র। গতানুগতিক সংস্কৃত ও ইংরেজি শিক্ষার পাশাপাশি পাটনা মাদ্রাসায় আরবি ও ফারসি বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করেন।

    শুধুমাত্র ইতিহাস নয়, বর্তমানের কাঁধেও ভর করে এগিয়ে চলেছে মাদ্রাসাতে ধর্মনিরপেক্ষতার দৃষ্টান্ত। ২০১৩ সালের এক পত্রিকার সমীক্ষায় দেখা গেছে, ওড়গ্রাম চতুস্পল্লী হাই মাদ্রাসা নামক পশ্চিমবঙ্গের এক মাদ্রাসাতে ৬০ শতাংশ অমুসলিম ছাত্র ছাত্রীরা পড়াশোনা করে। উক্ত মাদ্রাসা বাদ দিয়েও সারা রাজ্যে অসংখ্য মাদ্রাসাতে অমুসলিম ছাত্র ছাত্রীরা পড়াশোনা করছে। তথাকথিত গোঁড়া ব্যক্তিদেরকে ভুল প্রমাণ করেছে কৃতী প্রশমা শ্বাসমল যে কিনা ২০১৭ সালে মাদ্রাসা বোর্ড আয়োজিত মাধ্যমিক পরীক্ষায় দশম স্থান দখল করেছে। ভুরভুরি এমন উদাহরণ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে।

    প্রশমা শ্বাসমল ও আল আমিন মিশনের সেক্রেটারী নুরুল ইসলাম(ছবি -TwoCircles.net)

    মতান্তরে এ ভাবনাও কাজ করতে পারে, যদি মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা পুরোপুরি ধর্মনিরপেক্ষ হয় এবং সাধারণ বিদ্যালয়ের পাঠক্রমের থেকে আলাদা নয়, তাহলে তো মাদ্রাসাগুলোকে তো সাধারণ বিদ্যালয়ের সংগে অন্তর্ভুক্তি করতে বাধা কোথায়?

    আমরা যদি মুসলিমদের শিক্ষা ব্যবস্থার ইতিহাস পর্যবেক্ষন করি, মাদ্রাসা শিক্ষার যথার্থতা খুঁজে পাবো। এ দেশের বুকে অনেক স্বৈরাচারী থেকে জনহিতৈষী শাসকের আগমন হয়েছে। দুশো বছর ব্রিটিশ শাসনও দেখেছি । কিন্তু কোনও ক্ষেত্রেই মাদ্রাসা শিক্ষার গতি থামিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা দেখা যায়নি। দেশের বুকে কখনো মানবতাবাদকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে রেনেঁশা আসেনি, এসেছে ধর্ম সংস্কার ও কুসংস্কারমুক্ত সমাজ গঠনের প্রচেষ্টার মাধ্যমে। পাশ্চাত্য শিক্ষাও যথেষ্ট গুরুত্ব পেয়েছে। সমাজের সর্বস্তরের শিক্ষার অগ্রগতির জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে স্কুল, কলেজ ইত্যাদি। কিন্তু মুসলিমদের শিক্ষার জন্য মাদ্রাসা গুলোই ছিল এক ও অন্যতম। তাই এইরকম ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা ব্যবস্থার সুদূরপ্রসারী বিস্তার অবশ্যই প্রয়োজন। হেলেন কেলারের মতে, “শিক্ষার চূড়ান্ত ফলাফল হচ্ছে সহনশীলতা।” তাই সমাজে সহনশীলতা ও মূল্যবোধ গঠনে মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার উজ্জ্বল ভবিষ্যত রক্ষার দায়িত্ব আমাদের সবার।      (চলবে….)

     

    লেখক:-শিক্ষক

    (ছবি-সংগৃহীত)

    নিউজফ্রন্ট এর ফেসবুক পেজে লাইক দিতে এখানে ক্লিক করুন
    WhatsApp এ নিউজ পেতে জয়েন করুন আমাদের WhatsApp গ্রুপে
    আপনার মতামত বা নিউজ পাঠান এই নম্বরে : +91 94745 60584

    LEAVE A REPLY

    Please enter your comment!
    Please enter your name here