(তালিব হুসেইন। ২৮ বছর বয়সী বাকরওয়াল উকিল-এক্টিভিস্ট কাঠুয়ার ৮ বছরের শিশুকণ্যার ধর্ষণ-হত্যার সুবিচারের সংগ্রামে সামনে থেকে লড়ছেন)
আমার মা আমাকে জন্ম দিয়েছিলেন উধমপুরের কুদ-এ। আমাদের যাযাবর পরিবার তখন কাশ্মীরের দিকে পরিযাণ (মাইগ্রেট) করছিল তাঁদের পশুপাখির পাল নিয়ে। আমি আমার বাবা মাকে হারায় ২০১৪ সালের বন্যায়। এক রাতে তাদের তাঁবু ভেসে গেছিল।
আমি বিরলের মধ্যে বিরলতমর এক উদাহরণ, যে জম্মু-কাশ্মীরের বাকরওয়ালদের মত এক যাযাবর পশুপালক উপজাতি গোষ্ঠির সন্তান হয়েও উচ্চশিক্ষার সুযোগ পেয়েছে। ‘গুড সামারিটান’রা আমার পড়াশোনার খরচ যুগিয়েছে এবং আমাকে এলএলবি পাস করতে সহযোগিতা করেছে।
যদিও আমি নয়া দিল্লীতেই ট্রেইনিশীপ পাই তথাপি আমাকে কয়েকমাসের মধ্যেই বাড়ি ফিরে আসতে হয়। গো-রক্ষা-নজরদারী হঠাৎ এমন বেড়ে যায় যে আমার পরিবারের পক্ষে পশুপাল নিয়ে পারাপার করা একরকম অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। প্রতিদিনই আমাদের সম্প্রদায়ের কেউ না কেউ গৌ-গুন্ডাদের পেটানি খাচ্ছিল। সেই সময়ই আমি ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নিই। জম্মু ও কাশ্মীরের সমাজের সবচেয়ে প্রান্তিক আমার নিজের মানুষগুলোর অধিকারের জন্য সংগ্রাম করব বলে।
এইভাবেই প্রতিষ্ঠিত হয় অল ট্রাইবাল কো-অর্ডিনেশন কমিটি (এটিসিসি) যা আমাদের রাজ্যে বনাধিকার আইন এবং এসসি-এসটি নির্যাতন নিবারণ আইন লাগু করার নাগরিক অধিকার আন্দোলনকে নেতৃত্ব দেবে। আমাদের রাজ্যের নিজস্ব সংবিধান আছে।
আমরা আমাদের প্রথম প্রতিবাদ সংগঠিত করি যখন জানুয়ারির ১৭ তারিখ হীরানগরে এই বালিকাটির নৃশংসভাবে ক্ষতবিক্ষত দেহ উদ্ধার হয়। যখন আমরা দেখলাম যে স্থানীয় পুলিশ দুস্কৃতীদের আড়াল করার চেষ্টা করছে তখন আমরা আরো মানুষজনকে মোবিলাইজ করা শুরু করি।
জানুয়ারীর ২১ তারিখ আমরা একটি প্রতিবাদ প্রদর্শন সংগঠিত করি। আমাকে গ্রেপ্তার করে দুই দিন হীরানগর থানায় আটক রাখা হয়। পুলিশ আমাকে এমনকি ‘পাব্লিক সেইফটি আইন’-এ কেস দেয়ার হুমকি দেয়। আমার গ্রেপ্তারের পরই কেবল রাজ্য বিধানসভায় বিরোধী বিধায়করা ইস্যুটি তোলে এবং মুখ্যমন্ত্রীর মনযোগ আকর্ষণ করে।
ন্যায্য অধিকারের দাবি তোলার জন্য এই প্রথম আমাকে পুলিশ কাস্টডিতে থাকতে হলো এমনটা নয়। জম্মু বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন আমি আইন পড়ছিলাম তখন ২০১৩ সালেও আমাকে পুলিশ কাস্টডিতে নিয়েছিল। ছাত্র-ছাত্রীদের একটি গ্রুপের সাথে আমি ক্যাম্পাসে প্রতিবাদ প্রদর্শন করছিলাম ভার্সিটিতে গোজ্রি ও পাহাড়ি গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার দাবিতে। এবিভিপি কর্মীদের সাথে আমাদের সংঘাত হয়। আমাদের দাবিকে সমর্থন জানিয়ে যে সমস্ত ছাত্রীরা আমাদের ধর্ণায় অংশ নিয়েছিল তাদের এবিভিপি কর্মীরা বাজে ভাবে হেনস্থা করছিল।
আমার বিরুদ্ধে পুলিশ এটেম্পট টু মার্ডার কেস দেয় এবং সেই ঘটনাক্রমে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমাকে দু’বছরের জন্য সাস্পেন্ড করা হয়।
২০১৩ সালে আমার বিরুদ্ধে আরো একটি এফআইআর হয়। নাগ্রোতায় পুলিশ একজন ড্রাইভারকে হত্যা করেছিল আর আমি অভিযুক্ত পুলিশের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়ার দাবিতে একটি প্রতিবাদ প্রদর্শন সংগঠিত করি। পুলিশ আমাকে আট দিন লকাপে পুরে রেখেছিল।
কিন্তু এসব ঘটনা আমাকে হতাশ করে দিতে পারেনি। আমার মানুষজনদের অধিকারের জন্য উঠে দাঁড়াতে আর মুখ খুলতে আমাকে বিরত করতে পারেনি। পরবর্তীতে, উধমপুরের ডাভার চওকে এক টিভি ডিবেটের সময় বিজেপি এমএলএ-রা আমাকে হেনস্থা করে। যখন আমি বর্ণনা করতে শুরু করি যে বালিকাটি হারিয়ে যাওয়ার পর এবং তার বাবা-মা পুলিশে অভিযোগ জানানোর চেষ্টা করার সময় কীভাবে পুলিশ সুপ্রিম কোর্টের দেয়া গাইডলাইন অবমাননা করেছে তখন স্থানীয় বিজেপি নেতারা ও আরএসএস কর্মীরা আমাকে ধাক্কা মারতে শুরু করে। তারা শুধু এটাই চাইছিল যে আমি যেন কিছুতেই আসল তথ্যগুলি প্রকাশ করতে না পারি, যাতে দক্ষিনপন্থীদের ছড়ানো সমস্ত মিথ্যা প্রচারকে উদ্ঘাটিত করে দিতে না পারি।
হিন্দুত্ববাদীরা আমাকে পাকিস্তানী তকমা দিয়েছে। মুসলিম মৌলবাদীরা আমাকে দোষারোপ করছে কেন আমি মামলাটি এক হিন্দু কাশ্মীরী পন্ডিত আইনজীবির কাছে নিয়ে গেলাম। পরিহাসের বিষয় হলো যেসব মুসলিম এডভোকেডদের কাছে প্রথমে আমি গেছিলাম তারা কেউই মামলাটি নিয়ে এগোতে চায়নি।
সৌভাগ্যক্রমে মিডিয়া গল্পটি তুলে ধরে ও আন্তর্জাতিক মিডিয়ার নজরে আনে।
যখন আমি বালিকাটির ক্ষতবিক্ষত শরীর দেখলাম, আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম যে তার পরিবার সুবিচার না পাওয়া পর্যন্ত আমি থামবনা। মামলাটি যৌক্তিক পরিণতি না পাওয়া পর্যন্ত আমি খালি পায়েও এগিয়ে চলব।
বালিকাটির প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা জ্ঞাপন হতে পারে জম্মু-কাশ্মীরে ‘বনাধিকার আইন’ ও ‘এসসি-এসটি নির্যাতন নিবারণ আইন’ কার্যকর করার মাধ্যমে।
আমরা এতদিন ধরে বারবার যে কথাগুলি বলছিলাম এখন হাই কোর্ট নির্দেশিত ক্রাইম ব্রাঞ্চও সেসব কথাই প্রতিষ্ঠিত করেছেঃ যাযাবর পরিবারগুলিকে সন্ত্রস্ত করে গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দেয়ার উদ্দেশ্যেই বালিকাটিকে যতটা নৃশংসভাবে সম্ভব আঘাত করা হয়েছে। এই দুইটি আইনের অনুপস্থিতিতে সব রকম সম্ভাবনাই থেকে যাচ্ছে ভবিষ্যতে আবার বারবার এই গরীব যাযাবর মানুষগুলিকে বিভিন্নভাবে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু বানানোর।
(আশুতোষ শর্মাকে বলা কথাগুলি, ‘ন্যাশনাল হেরাল্ড’-এ প্রকাশিত। ইংরেজি থেকে অনুবাদ মলয় তেওয়ারীর)
https://www.nationalheraldindia.com/campus/kathua-case-in-the-absence-of-law-the-nomads-will-be-targeted-again-says-bakarwal-lawyer
WhatsApp এ নিউজ পেতে জয়েন করুন আমাদের WhatsApp গ্রুপে
আপনার মতামত বা নিউজ পাঠান এই নম্বরে : +91 94745 60584