চন্দ্রপ্রকাশ সরকার
কথায় আছে, মরার উপর খাঁড়ার ঘা! করোনার কারণে রাজ্যবাসীর করুণদশা ছিলই, হঠাৎ আমপান না আমফান এসে তছনছ করে দিলো সব। এখন পর্যন্ত সরকারি হিসেবে মৃত্যু হয়েছে ৮৬ জনের। শুধুমাত্র দক্ষিণ ২৪ পরগনাতেই ভেঙে গুঁড়িয়ে গিয়েছে ১০ লক্ষ বাড়ি। ভেঙেছে ৫৬টি নদীবাঁধ। প্রাথমিকভাবে ওই জেলায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা ৭৩ লক্ষ! সারা রাজ্যে নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ৬ কোটি অর্থাৎ রাজ্যের জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ।
হাজার হাজার গাছ ধরাশায়ী হয়ে খোদ রাজধানী কলকাতাকে অবরুদ্ধ করে ফেলেছে। ঘটনার চারদিন পরেও সেখানে বিদ্যুৎ নেই, নেই পানীয় জল! ধ্বংসস্তূপের মধ্যে কেবলই অসহায় মানুষের হাহাকার। ১৭৩৭ সালের পর শহর কলকাতা কোনদিন এত বড় বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়নি।
সংবাদমাধ্যমে পশ্চিমবঙ্গের ধ্বংস-চিত্র দেখে কেঁদে ফেলেছেন স্বয়ং রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ। দিল্লি থেকে তড়িঘড়ি উড়ে এসে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সঙ্গে নিয়ে যৌথভাবে আকাশপথে দুর্গত এলাকা পরিদর্শন করেছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। পরিস্থিতি তাঁকেও বিচলিত করেছে। তাৎক্ষণিকভাবে তিনি রাজ্যকে এক হাজার কোটি টাকা দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন। যদিও মুখ্যমন্ত্রীর প্রাথমিক হিসেবে ক্ষতির পরিমাণ অন্তত এক লক্ষ কোটি টাকা।
প্রশ্ন হলো, এই রকম এক অভূতপূর্ব প্রাকৃতিক বিপর্যয়কেও জাতীয় বিপর্যয় হিসেবে ঘোষণা করা হচ্ছে না কেন ? আসলে জাতীয় বিপর্যয় ঘোষণা করা হলেই ত্রাণ ও পুনর্বাসনের যাবতীয় দায়-দায়িত্ব নিতে হবে কেন্দ্রীয় সরকারকেই। হৃদয়হীন কেন্দ্রীয় সরকার সেই দায়-দায়িত্ব নিতে নারাজ। যারা সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা করে এনআরসির নামে কোটি কোটি দেশবাসীকে উৎখাতের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকে, তাদেরকে হৃদয়হীন বলতে আমার বিন্দুমাত্র দ্বিধা নেই।
আরও পড়ুনঃ আমপানের তান্ডবে যেন নিঃস্ব সুন্দরবন
যাই হোক, এতবড় বিপর্যয়কেও জাতীয় বিপর্যয় হিসেবে ঘোষণা না করে তারা পার পাচ্ছে কিভাবে ? আসলে তাদের সামনে এই সুযোগটি করে রেখেছে ২০০৫ সালের জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা আইনটি। ওই আইনের কোথাও সুনির্দিষ্টভাবে বলা নেই যে, বিপর্যয়ের মাত্রা কতটা হলে তাকে ‘জাতীয়’ বলা যাবে।
ফলে এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয় সরকারের মর্জির উপরেই সব সময় নির্ভর করতে হয়। আর কেন্দ্রে যারা যখন ক্ষমতায় থাকে, তাদের প্রধান লক্ষ্য থাকে রাজ্য দখল — ঠিক যেমন রাজ্যে ক্ষমতাসীন দলও চায় ক্ষমতার মূল উৎস পঞ্চায়েতগুলোর নিরঙ্কুশ দখল। সুতরাং মানুষের ক্ষয়ক্ষতি এবং দুঃখ-দুর্দশার ভিত্তিতে সরকারি পদক্ষেপ গৃহীত হওয়ার বদলে তা হয় রাজনৈতিক লাভালাভের অংক কষে! এই মুহূর্তে এই রাজ্যের সরকার বিব্রত-বিপন্ন ও ব্যর্থ হলে কেন্দ্রীয় শাসকদলের সুবিধা বই অসুবিধা নেই! আর মাত্র মাস কয়েকের মধ্যেই এই রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনের দামামা বেজে যাবে। এইরকম এক সন্ধিক্ষণে আমপান যদি এই রাজ্যে তান্ডবলীলা না চালাত তাহলে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তড়িঘড়ি দিল্লি থেকে উড়ে আসতেন কিনা সে বিষয়ে সন্দেহ থেকেই যায়!
(লেখক মুর্শিদাবাদ থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক ‘ঝড়’ সংবাদপত্রের কার্যনির্বাহী সম্পাদক, প্রাবন্ধিক। মতামত ব্যক্তিগত)
WhatsApp এ নিউজ পেতে জয়েন করুন আমাদের WhatsApp গ্রুপে
আপনার মতামত বা নিউজ পাঠান এই নম্বরে : +91 94745 60584