নেগেটিভ, পজিটিভ, মাইথোলজি, ফ্যান্টাসি সব ধরনের চরিত্রে অনবদ্য এক নাম জেসমিন রায়। নিউজফ্রন্টের সঙ্গে নিজের কিছু কথা শেয়ার করলেন অভিনেত্রী। প্রশ্ন দিলেন নবনীতা দত্তগুপ্ত।
নবনীতাঃ জেসমিন তোমার টেলিজার্নি বহুদিনের। সবথেকে বেশি সাড়া কোন চরিত্রের জন্য পেয়েছো?
জেসমিনঃ আমি খুব লাকি যে আজ অবধি যে কটা চরিত্রই করেছি, সবকটার জন্যই সাড়া পেয়েছি। রাস্তাঘাটে, শপিং মলে লোকে দেখে চিনতে পেরেছে। চরিত্রের নাম ধরে ডেকেছে। তবে, ‘ত্রিনয়নী’তে যেহেতু আমার চরিত্রের নামও জেসমিন ছিল তাই লোকে দেখলে বলত- “তুমি জেসমিন না?” তখন আসল নাম আর চরিত্রের নাম– দুটোই এনজয় করতাম।
নবনীতাঃ নেগেটিভ, পজিটিভ, বেগম, রাধা—- মোটামুটি সব ধরনের চরিত্রেই সমান সাবলীল অভিনয় দেখিয়েছো তুমি৷ এগুলোর মধ্যে কোন চরিত্রটা নিজেকে বেশি তৃপ্ত করেছে তোমায়?
জেসমিনঃ আমার মতে, অভিনেতারা যে চরিত্রটাই করে অত্যন্ত মন দিয়েই করে। কারণ নিজের সেরাটা সকলের কাছে সে তুলে ধরতে চায়। সেভাবে আলাদা করে বলাটা খুব কঠিন নবনীতা দি। তবু যদি বলতেই হয় বলব রাধার চরিত্রটা আমার কাছে বেশি আদরের৷ তারও একটা বিশেষ কারণ আছে। ভাটপাড়া আমার হোমটাউন। ওখানে আমাদের বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত রাধা-কৃষ্ণের মন্দির। আমি কৃষ্ণভক্ত। ফলে রাধিকারও ভক্ত আমি। আমার দাদুর দাদু প্রতিষ্ঠা করেছিলেন আমাদের বাড়ির মন্দির। দাদু এতকাল মন্দিরের সব কাজ করতেন। দাদুর পাশাপাশি বাবাও করতেন মন্দিরের সব কাজ। দাদু ২০০৯ সালে মারা যাওয়ার পর তার দেখাশোনা আমার ঠাম্মা করেন। ঠাম্মা আমার রাধার চরিত্র দেখে মুগ্ধ হয়ে গেছিলেন। এখনও বলেন, যতগুলো চরিত্র করেছি রাধা নাকি সেরা।…
নবনীতাঃ তার মানে তুমি ভগবানে বিশ্বাসী।
জেসমিনঃ অসম্ভব রকমের। আর তাই আমি মাইথোলজিক্যাল চরিত্র বেশি ভালোবাসি। অষ্টম প্রহরের কীর্তন হয় আমাদের বাড়িতে। কীর্তনীয়ারা আমাদের বাড়িতে এসে থাকেন। কত লোক আসে বাইরে থেকে।
নবনীতাঃ নিজের মনের মানুষটির সঙ্গে ব্যাক টু ব্যাক তিনটে সিরিয়াল- ভক্তের ভগবান শ্রী কৃষ্ণ, আরব্য রজনী, পাণ্ডব গোয়েন্দা। প্রেম টা কি রাধা-কৃষ্ণ চরিত্র পাওয়ার আগে থেকেই? নাকি পরে?
জেসমিনঃ পরে। ‘ভক্তের ভগবান শ্রী কৃষ্ণ’ করার সময়েই ওকে চিনি। খুব একটা ট্র্যাক ছিল না আমার। মাস পাঁচেকের ট্র্যাক ছিল আমার। ১৫-২০ দিন সেটে শুটিং করেছি। বাকি সময় নলবন ২-তে চলত বৃন্দাবনের শুটিং। তখন থেকে দুজনের দুজনকে ভাল লাগা। পরে বুঝলাম ওটা ভাল লাগা নয়, ওটার নাম ভালোবাসা।…
নবনীতাঃ কে আগে ভালোবাসা প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছিলে?
জেসমিনঃ দুজনেই। বলতে হয়নি কারোকে। এমনিতেই বুঝে গেছিলাম একে অপরকে।
নবনীতাঃ দুজনের অফস্ক্রিন কেমেস্ট্রি অনস্ক্রিনে কতটা সুবিধা দিয়েছে?
জেসমিনঃ দেখো, রাধা-কৃষ্ণের চরিত্রে থাকাকালীন প্রেমের শুরুয়াত। বেশিদিন আমার ট্র্যাক ছিল না। তারপর ‘আরব্য রজনী’ও বেশিদিন চলেনি। আমাদের সেভাবে ঘনিষ্ঠ কোনও সিনে দেখানোও হয়নি। মোদ্দাকথা, আমাদের খুব একটা দেখানোও হয়নি। আরেকটু দেখানো যেত আমাদের। ফলে, খুব একটা মজা করে কাজটা করিনি আমরা। তবে, অফস্ক্রিনের কেমেস্টি যদি কিছুটা হলেও অনস্ক্রিনে সাহারা দিয়ে থাকে তা হলে সেটা ‘পাণ্ডব গোয়েন্দা’তে। ওটায় একে অপরের প্রেমিক প্রেমিকা হয় মজা পেয়েছি, প্রশংসাও পেয়েছি।
নবনীতাঃ হইচইতে ‘শুভারম্ভ’ করলে। বাস্তবে কি খুব শিগগিরই কোনওকিছুর শুভারম্ভ হওয়ার চান্স আছে?
জেসমিনঃ না, এই পরিস্থিতিতে কোনও কিছুর শুভারম্ভ নিয়েই ভাবছি না। ভাবতে ভয় লাগে। বিয়ের কথাও ভাবছি না। তুমি জিজ্ঞেস করার আগেই বলে দিলাম (হেসে)।
নবনীতাঃ শুভমিতার মতো কি জেসমিনও সুর পাগল?
জেসমিনঃ ভীষণ। কিন্তু দুঃখের বিষয় আমি গান গাইতে পারি না। গান শুনতে ভালোবাসি। আমার মা খুব ভাল গান করেন। বাড়িতে কীর্তন শুনে বড় হয়েছি। সুরের সঙ্গে আলাপ জন্মের পর থেকেই। আমার দাদু রোজ সকালে ফুল তুলে এসে ট্রেপরেকর্ডারে ঠাকুরের গান বাজিয়ে দিতেন। সকাল ৮ টা অবধি চলত গান। সেই গানেই ঘুম ভাঙত আমাদের।
নবনীতাঃ বাহ!
জেসমিনঃ আমি এখনও গান শুনি সময় পেলেই। সেদিনের সঙ্গে আজকের পার্থক্য, দাদু চালিয়ে দিতেন গান। আর আজ নিজেকে চালিয়ে শুনতে হয়।
নবনীতাঃ হইচইতে দিব্যাশা আর সত্যমের সঙ্গে স্ক্রিন শেয়ারিং কেমন লাগল?
জেসমিনঃ খুব ভাল৷ দিব্যাশাকে চিনতাম না। সত্যমকে চিনতাম। কারণ ও সিরিয়াল করে। সত্যম মামদো চরিত্রটা দারুণ ফুটিয়েছে। অসাধারণ। দিব্যাশাও অনবদ্য। খুব কমফর্ট ফিল করেছি এই ইউনিটের সঙ্গে কাজ করে। এটাই আমার প্রথম ওয়েব সিরিজ। তাই এক্সাইটমেন্ট লেবেলটাও তুঙ্গে ছিল।
আরও পড়ুনঃ লকডাউনে ঘরে বানান ফুডকা স্পেশাল ডিশ, দেখুন ‘রান্নাবান্না’
নবনীতাঃ ওয়েব সিরিজের সংখ্যা বাড়লে কি সিরিয়াল থেকে বিরতি নেবে? যেহেতু আজকের দিনে দাঁড়িয়ে ওয়েব সিরিজ অনেক বেশি স্পষ্ট কথা বলে। বলা ভাল অনেক সাহসী। সেন্সরের কাঁটাছেড়া নেই।
জেসমিনঃ না। সিরিয়াল আমার কাছে অপশন না। ওটা আমার ফার্স্ট চয়েজ (Choice)। সিরিয়ালকে সঙ্গে রেখে যা করার করব। তাছাড়া ওয়েব সিরিজ কিংবা সিনেমার কাজ তো টানা অনেকদিন ধরে চলে না। ফলে, চ্যানেলের সঙ্গে কনট্র্যাক্টে না থাকলে ছুটি পেয়ে যাব। কনট্র্যাক্টে থাকলে মানে লিড রোলে থাকলে সেই ছুটি পাওয়া মুশকিল৷ কিন্তু সিরিয়াল ছেড়ে আমি যাব না কোথাও।
নবনীতাঃ ভক্তকূলের কাছ থেকে কেমন সাড়া পাও?
জেসমিনঃ খুব পাই। কত যে আমার নামে ফেক প্রোফাইল তার ইয়ত্তা নেই। কিন্তু সেগুলো হার্মফুল নয়। দেখিনি তেমন কিছু। দেখলে রিপোর্ট করব। ওরা আমার ছবি শেয়ার করে আমাকে ট্যাগ করে। তবে, ওদেরকে আমি বলি আমার নামটা যেন চেঞ্জ করে দেয়। জেসমিন আর রায়ের মাঝখানে বা পাশে যদি অন্যকিছু জুড়ে দেয়। ওরা সেটা করেছে। আমি এর মধ্যে কোনও অন্যায় পাই না। ওরা আমাকে পছন্দ করে আর ভালোবাসে বলেই তো আমার নামে প্রোফাইল খুলেছে। না হলে খুলত? কীসের ঠেকা ওদের? তবে, হ্যাঁ যদি আমার নাম ভাঙিয়ে কোনও খারাপ কাজ করে সেটা অন্যায়। তাহলে আমি স্টেপ নেব।
নবনীতাঃ জীবনে প্রথম কারোকে অটোগ্রাফ দেওয়ার কথা মনে পড়ে?
জেসমিনঃ না গো। আমি যখন অটোগ্রাফ দেওয়ার মতো জায়গা পেয়েছি ততদিনে সেলফি চলে এসেছে।
নবনীতাঃ স্বপ্নের কোনও চরিত্র?
জেসমিনঃ অনেক আছে। পেজ ভর্তি হয়ে যাবে নিউজ ফ্রন্টের। তবে, এক লহমায় যেটা বলতে পারি সেটা হল, ‘বরফি’তে প্রিয়াঙ্কা চোপড়ার চরিত্রটা পেলে আনন্দে আত্মহারা হয়ে যাব।
আরও পড়ুনঃ বন্ধু ভিকির সঙ্গে রুকমার অনন্য উদ্যোগ কমিউনিটি কিচেন, শামিল আরও দুজন
নবনীতাঃ ক্ষেপ আক্ষেপ?
জেসমিনঃ নেই। যা ডিজার্ভ করি না তার থেকে অনেক বেশি পেয়েছি।
নবনীতাঃ অবসরে কী করো?
জেসমিনঃ গান শুনি, সিনেমা দেখি। তাছাড়া আমার একটি পোষ্য আছে, ল্যাব্রেডর। ওকে নিয়েই কেটে যায় সারাদিন। কলকাতায় আমি একা থাকি। কাছেই আমার এক চাইল্ডহুড ফ্রেন্ড থাকে। তারও একটা পোষ্য আছে। আমি সেখানেও যাই আমার পোষ্যটিকে নিয়ে। এছাড়া ওকে নিয়েই সারাদিন ব্যস্ত থাকি। ওকে খাওয়ানো, ওর দেখাশোনা- এভাবেই কেটে যায় ছুটিগুলো।
নবনীতাঃ ইন্ডাস্ট্রিতে এসে কারো কাছ থেকে অভিনয়ের ব্যাপারে কোনও সাহায্য পেয়েছো?
জেসমিনঃ সানন্দা টিভিতে আমার প্রথম সিরিয়াল ‘ভোলা মহেশ্বর’। আমিই দুর্গা, পার্বতী, কালী হয়েছিলাম। আমি যেহেতু থিয়েটার করতাম তাই ক্যামেরা ফ্রেন্ডলি ছিলাম না একেবারে। দুটো প্ল্যাটফর্ম একেবারে আলাদা। আমি ক্যামেরার সামনে চেঁচিয়ে কথা বলে ফেলতাম মঞ্চের মতো। বকা খেতাম। বাথরুমে গিয়ে কাঁদতাম। নাটকে চিত্রনাট্য পড়ে মুখস্থ করে বলার সময় পেতাম। রিহার্সাল করতাম।টিভিতে তেমনটা নয়। স্ক্রিপ্ট হাতে পেয়ে একটু পড়ে বুঝে নিয়ে শটে যেতে হয়। আমি খেই হারিয়ে ফেলতাম। সেই সময় আমার সহ অভিনেতা অর্ণব দা এবং ডিরেক্টর তন্ময় দা আমায় খুব সাহায্য করেন। কীভাবে কী করব ওঁরাই শেখান আমায়।
নবনীতাঃ ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ পাওয়া না পাওয়ার ব্যাপারে নেপোটিজম, লবি, গডফাদার শব্দগুলো খুব কাজ করে। এই ব্যাপারে কী বলবে?
জেসমিনঃ ইন্ডাস্ট্রি কেন? নেপোটিজম তো স্কুল থেকেই দেখে আসছি। স্কুলে যাদের মায়েরা টিচার থাকে তারা বেশি সুবিধা পায় সবকিছুতে। প্রত্যেকটা মানুষই নিজের লোককে বেশি মাইলেজ দেয়। আমি হলে দেব না? দেবই তো। তুমি হলেও দেবে। তাহলে শুধু ইন্ডাস্ট্রি এই দোষে দুষ্ট হবে কেন?
নবনীতাঃ বড়পর্দায় কোন পরিচালকের সঙ্গে কাজ করার খুব ইচ্ছে?
জেসমিনঃ অনেকের সঙ্গে। তবে এই মুহূর্তে এক বাক্যে আসে দুটো নাম, কৌশিক গাঙ্গুলি এবং শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। ওঁদের কোনও ছবি একবার না, বারবার দেখতে ইচ্ছে করে।
আরও পড়ুনঃ স্পেশাল চাইল্ডদের ভ্যাকসিনের ব্যবস্থা করলেন ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত, পাশে আছেন উডল্যান্ডের সিইও
নবনীতাঃ যারা সিরিয়ালে ব্যস্ত থাকে তারা ওয়েব, বড় পর্দায় ডাক কম পায়- কথাটা প্রচলিত। কারণ সিরিয়ালে কাজ করলে সময় বের করা চাপের। তুমি কী বলবে?
জেসমিনঃ আমার ক্ষেত্রে তেমন কিছু হয়নি৷ করলাম তো ওয়েব সিরিজ। সিনেমা হয়ত করিনি। চ্যানেলের সঙ্গে কনট্র্যাক্টে থাকলে অফার পেলে নেওয়া কঠিন হয় জানি। কিন্তু কেউ সিরিয়ালের ভাল অভিনেতা হলে শুধু সিরিয়ালে ব্যস্ত থাকার কারণে ডাক কম আসে ওয়েব সিরিজ বা সিনেমা থেকে- এটা আমার জানা নেই।
নবনীতাঃ কোভিড পরিস্থিতিতে নিজেকে কীভাবে সাবধানে রাখছ। মনের দিক থেকে পজিটিভ রাখছ কীভাবে?
জেসমিনঃ হাত স্যানিটাইজ করছি, মাস্ক পরছি। বাইরে থেকে যা কিনে আনছি তা ভাল করে ধুয়ে স্যানিটাইজ করে জায়গায় রাখছি। বাইরে থেকে এসে সবার আগে বাথরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে তারপর ঘরে ঢুকছি। আর মন? আমি অনেক প্রিয়জনকে হারিয়েছি এই করোনা আবহে। মন ভাল নেই। তাই তোমার সঙ্গে লাইভে আসতে চাইনি। এত কথা হাসিমুখে লাইভে এসে বলার ক্ষমতা এই মুহূর্তে আমার নেই। মন ভাল রাখার চেষ্টা করছি। পারছি কই? গান শুনছি, সিনেমা দেখছি আর পোষ্যর দেখাশোনা করে অন্যমনস্ক থাকার চেষ্টা করছি।
নবনীতাঃ ভাল থেকো জেসমিন।
জেসমিনঃ তুমিও। টেনশন থেকে দূরে রাখো নিজেকে।
WhatsApp এ নিউজ পেতে জয়েন করুন আমাদের WhatsApp গ্রুপে
আপনার মতামত বা নিউজ পাঠান এই নম্বরে : +91 94745 60584