পিয়া গুপ্তা,উত্তর দিনাজপুরঃ
বিশ্বকর্মা পুজো মানেই বাঙালির কাছে আকাশজোড়া ঘুড়ির আলপনা।অসংখ্য ঘুড়ির ভেলায় কৈশোর আর যৌবনের মাঞ্জায় লেগে আছে ঘুড়ি ওড়ানোর বহু স্মৃতি।
যে ছেলেটা কোনওদিন সকাল দেখেনি,সেও বিশ্বকর্মা পুজোর দিনে সূর্য ওঠার আগেই ঘুড়ি-লাটাই নিয়ে ছাদে উঠে যায়।এক সময় ছিল যখন বিশ্বকর্মা পুজো তে বিভিন্ন বাড়ির ছাদ থেকে ভেসে আসত ‘ভো কাট্টা’ চিৎকার।
সমস্বরে চিৎকারের সঙ্গে সঙ্গে বেজে উঠত কাঁসর-ঘণ্টা।ঘুড়ি ওড়ানোকে কেন্দ্র করে চলে অলিখিত এক প্রতিযোগিতা। তবে যুগ পাল্টেছে।যুগের সাথে হারিয়ে যাচ্ছে বিশ্বকর্মা পূজোতে বাঙালির সেই প্রাচীন ঘুড়ি উড়ানোর রেওয়াজ।
একটা সময় ছিল যখন ছোটো থেকে বড়ো বাড়ির সকলে মিলেই বিশ্বকর্মা পুজো উপলক্ষ্যে আকাশের ঘুড়ির ঝাঁকে ভরিয়ে তুলতো৷আজ বরং মোবাইল গেম,ফেসবুক,ইন্সটাগ্রামের দৌলতে হারিয়ে যেতে বসেছে বাঙালির সেই প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী ঘুড়ি উৎসব।
এখন আর স্বাধীনতা দিবস কিংবা বিশ্বকর্মা পুজোর দিন বাড়ির ছাদে ছাদে ভো-কাট্টা বলে ঘুড়ি ওড়ানোর প্রতিযোগিতা দেখা যায় না৷বুধবার বাঙালির ঘরে ঘরে পূজিত হবেন বিশ্বকর্মা।তাই রাজ্যে ছোট-বড় সমস্ত কলকারখানা থেকে শুরু করে সরকারি অফিস সর্বত্র সেজে উঠেছে পুজোর আয়োজনে। প্রতিবারের মতো সারি সারি ঘুড়ির পসরা সাজিয়ে বসে রয়েছেন দোকানিরা।তবে দিনে দিনে কমে যাচ্ছে ক্রেতার সংখ্যা।
হালের অনলাইন গেমসের রোমাঞ্চও নেই ঘুড়ি ওড়ানোর মধ্যে।তবুও জনপ্রিয়তায় পতঙ্গবাজির এখনও কোনও প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। বর্ষাকাল ছাড়া সারা বছর ঘুড়ি ওড়ানোর মরশুম।তবে রংবেরঙের ঘুড়ি একদিনের রাজা হয়ে ওঠে অবশ্যই বিশ্বকর্মা পুজোর সময়।
আরও পড়ুনঃ বিশ্বকর্মা পূজার আগে শেষ তুলির টান দিতে ব্যস্ত মৃৎশিল্পীরা
ঘুড়ির এই মরশুম শুরু হতেই কালিয়াগঞ্জ এর মহেন্দ্রগঞ্জ, তারাবাজার, কালীবাড়ি সহ অনেক এলাকায় অস্থায়ীভাবে ঘুড়ি–লাটাই–সুতোর পসরা সাজিয়ে বসে পড়েন দোকানিরা। পাশাপাশি পান–বিড়ির দোকানেও ঘুড়ি–লাটাই বিক্রি হতে দেখা যায়।ময়ূরপঙ্খী,চাঁদিয়াল, মোমবাতি,পেটকাটি,চৌকো ঘুড়ির পাশাপাশি প্লাস্টিক ঘুড়িও দোকানে প্রজাপতির মতো ঝলমল করে।
পাশাপাশি বিক্রি হয় মাঞ্জা সুতো, লাটাই।কাঠের পাশাপাশি বিক্রি হয় ফাইবারের লাটাইও।কালিয়াগঞ্জের এক ঘুড়ি বিক্রেতা বলেন, ‘প্রতিবার বিশ্বকর্মা পুজোর আগে আগে ঘুড়ির দোকান নিয়ে বসি।তবে বর্তমানে বাচ্চাদের ঘুড়ি ওড়ানোর সময় কোথায়?ফেসবুক হোয়াটসঅ্যাপ নিয়েই তারা দিনরাত্রি ব্যস্ত থাকে।
বন্ধুদের সাথে একসাথে ঘুড়ি ওড়ানো ঘুরতে যাওয়া এখন প্রায় কমেই গেছে।এখন যদিও আগের মত ঘুড়ি বিক্রি হয় না।তবে বিশ্বকর্মা পূজো উপলক্ষ্যে আজ ও কিছু কিছু ছেলেমেয়েরা এসে এই দিনটির জন্য কিছু ঘুড়ি কিনতে আসে।তবে আগের মতো আর তেমন ঘুড়ির চাহিদা নেই।
ঘুড়ি বিক্রেতা সঞ্জয় বসাক জানালেন, ‘গত বছরের থেকে এবার রে অনেকটাই কম এসেছে ঘুড়ির বিক্রি।আবহাওয়া খারাপ থাকার কারণে অনেক টাই ঘুড়ি বিক্রি এবারে কমে গেছে। যদিও ক্রেতা টানতে ঘুড়ি–সুতো–লাটাই একসঙ্গে নিলে ডিসকাউন্টও দেওয়া হচ্ছে।
ঘুড়ি ব্যবসায়ী নীলমণি সেন জানান, “স্পেশ্যাল কোয়ালিটির ঘুড়ি তৈরি করি বলে বাজারে আমাদের সুনাম দীর্ঘদিনের।আমাদের তৈরি ঘুড়ি বাজারে ৮ থেকে ২০ টাকা দামে বিক্রি করি।”
একসময়ে পাকা রাস্তা থেকে গলি, বাড়ি, বহুতলের ছাদ, পাড়ার খেলার মাঠ থেকে ভেসে আসতো ছেলে–বুড়োদের সমবেত কণ্ঠে তীব্র চিৎকার ভোকাট্টা। হাওয়া থাকুক বা না থাকুক, রোদ উঠুক বা না উঠুক বিশ্বকর্মা পুজোয় ভাদ্রের আকাশ থাকে ঘুড়িতে রঙিন। তবে আজ সে সব কিছু প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে।
বাঙ্গালী শ্রমিক বিশ্বকর্মা পুজোয় আজও অনন্দ করেন, কিন্তু গৃহস্থের বাড়ির ছাদে আর সেজে উঠে না সেই ঘুড়ির ভোকাটা৷ সময়ের সাথে সাথে বাঙালীর ঐতিহ্য গুলোও আজ হারিয়ে যেতে বসেছে।
WhatsApp এ নিউজ পেতে জয়েন করুন আমাদের WhatsApp গ্রুপে
আপনার মতামত বা নিউজ পাঠান এই নম্বরে : +91 94745 60584