রেডিও তর্পণ- কাজী ফয়জল নাসের
মহালয়া এসে গেলো আর মহালয়া এলেই অনেক বাঙালীর মতো আমার মনেও স্বর্গীয় বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্র মহাশয়ের নাম ভেসে ওঠে। তবে তার সাথে সাথেই আমার মনকে ভারাক্রান্ত করে তোলে আর যে নামটা, তা হল ‘রেডিও’। শৈশব-কৈশোরের কত স্মৃতি, কত রোমান্টিকতা জড়িয়ে আছে ওই রেডিওর সাথে।
জন্ম থেকেই বাড়িতে একটা ফিলিপস রেডিও দেখেছিলাম। তখন রেডিও-র একটা বার্ষিক ফি সরকারকে জমা দিতে হতো, যদ্দূর মনে পরে ১৫ টাকার মতো। তাও অনেক বাড়িতে দেখেছি ওই ফি জমা দিতো না (টাকাটা সেই যুগে খুব একটা কম ছিলোনা, তখন আমার দৈনিক টিফিন খরচ ১০ পয়সা, যাতে ৫ পয়সার আলুকাবলির পরে ৫ পয়সার আইসক্রিম বা আমার খুব প্রিয় একটা খাবার চুরোন খাওয়া যেতো) , আর মাঝে মাঝেই গুজব রটতো যে সরকারী লোকজন আসছে, বাড়ি সার্চ করবে…তখন সেই রেডিও লুকোনোর ধূম।
আমার সাথে রেডিওর পরিচয় বা প্রেম একটা বিশেষ অনুষ্ঠানের হাত ধরে। যার নাম ‘বিনাকা গীতমালা’…রেডিও সিলোন…সঞ্চালক আমিন সায়ানি। তখন দেখতাম রেডিও অনুষ্ঠান প্রচারিত হতো সকাল ৬ টা থেকে…আকাশবানী… বিবিধ ভারতী। মিনিট পাঁচেক আগে থেকে পুঁউউউ…শব্দ আরম্ভ হতো আর তারপর একটা অদ্ভূত মিষ্টি ইনস্ট্রুমেন্টাল। তারপর প্রথমেই ‘বন্দে মাতরম’। তারপর কি যে সব বলতো ফ্রিকোয়েন্সি…মেগা-হার্ৎজ…সে সব মাথায় ঢুকতো না।
আমি জানতাম রেডিও মানে দারুন সব গান… অস্ট্রেলিয়ায় বিষেণ সিং বেদী-র ভারত টেস্ট খেলতে গেলে ভোর সারে চারটে থেকে সুশীল দোশীর ধারা-বিবরনী অথবা মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল খেলা থাকলে…’সবুজ গালিচা বেছানো মাঠ, স্বর্গোদ্যান ইডেন থেকে বলছি পুষ্পেন সরকার’।
কি অসাধারণ সব অনুষ্ঠান। একদম সকালে ‘ঝরোখা’ তে বলে দিতো সারাদিনের অনুষ্ঠান সূচি। আমরা তখন থাকতাম খিদিরপুর-এর এক বস্তি এলাকায়। সকাল থেকেই জানালার বাইরে অশ্রাব্য খিস্তি-খেউড়। আর সেই কারণেই আমাদের বাড়ির নিয়মানুযায়ী সকালে পড়াশুনোর সময়েও রেডিও চলতো… যাতে বাইরের গালাগালি কানে না ঢোকে। পড়তে পড়তেই শুনতাম সঙ্গীত সরিতা…যদিও সেটা আমার মোটেও মনোমত অনুষ্ঠান ছিলোনা। প্রতিদিন হিন্দুস্থানি ক্লাসিকাল সঙ্গীতের কোন এক বিশেষ রাগ নিয়ে অনুষ্ঠান হতো। আমার দাদা ছিলো এর নিয়মিত শ্রোতা। এরপর একটা খবর হতো…ইংরাজি না হিন্দি তা ঠিক মনে পড়েনা। তার পরেই হোতো ‘ভুলে বিসরে গীত’…পুরাতন হিন্দি গানের খনি। সকলে ওই পর্যন্তই শোনা হতো। দুপুরে স্কুল থেকে ফিরে শুনতাম ‘মন চাহে গীত’…৩ টে বা সাড়ে ৩ টে হবে। তখনই পরিচয় বিহারের (এখন বোধহয় ঝাড়খণ্ড) দুটো জায়গা যার একটা ‘ঝুমরি তালাইয়া’ আরেকটা ‘বরকাকানা’। প্রত্যেক গানের শুরুতেই শুনতাম সেখান থেকে কেউ না কেউ গানের অনুরোধ জানিয়েছেন। ভাবতাম ওখানকার মানুষজন কতই না গান ভালোবাসেন।
আমার আর একটা প্রিয় অনুষ্ঠান ছিলো সন্ধ্যে ৭ টার ‘খেল সমাচার’…সারাদিনের যাবতীয় খেলার খবর পাওয়া যেতো তাতে। এদিকে বাংলা খবর বলতে ছিলো দুপুর দেড়টার আর সন্ধ্যে সাড়ে সাতটার কলকাতা-ক এর সংবাদ আর দুপুর আড়াইটে ও সন্ধ্যে পৌনে আটটার স্থানীয় সংবাদ। তবে সবকিছু ছাপিয়ে ছিলো বিবিধ ভারতী-র মাস্টারস্ট্রোক জয়মালা। মূলত সেনা জওয়ান-দের পছন্দের গান শোনানো হতো তাতে। সেখানেই প্রথম পরিচয় ল্যান্স-নায়েক, সুবেদার প্রভৃতি সেনাবাহিনীর পদের সাথে। বিশেষ আকর্ষণ ছিলো (সম্ভবত) শনিবার রাতের বিশেষ জয়মালা। একজন বিখ্যাত ব্যক্তিকে আনা হতো…তিনি সেনা জওয়ান- দের প্রশ্নের উত্তর দিতেন আর তারসাথে শোনাতেন নিজের পছন্দের গান। সেখানেই পেয়েছি লতা মঙ্গেশকর, আশা ভোঁসলে, সুনীল গাভাসকর, বিষেণ সিং বেদী, বিজয় এবং আনন্দ অমৃতরাজ, ইন্দর সিং…রাজেশ খান্না, ধর্মেন্দ্র, আশা পারেখ আরো কত পছন্দের নাম। এছাড়া ছিলো হাওয়ামহল। রাত ১০ টা থেকে হতো ‘ছায়াগীত’…বেশীরভাগ দিন আলো নেভা অবস্থায় বিছানায় শুয়ে ওই ছায়াগীত শুনতে শুনতেই ঘুমের কোলে ঢলে পড়তাম। তখন রাত সাড়ে দশটা মানে বেশ রাত বলে মনে করা হতো আমাদের বাড়িতে।
অনেক পরে…যখন ক্লাস নাইন বা টেনে পড়ি, আলাপ হলো শ্রাবন্তী মজুমদারের মিষ্টি ন্যাকা ন্যাকা কন্ঠের সাথে…রোববারের বোরোলিনের সংসার। ‘ত্বক যদি কেটে যায়…ফেটে যায়… খসখসে যদি হয়, রোদ্দুরে ঝলসায়…সারা গায়ে মেখে নিন…সুরভিত অ্যান্টিসেপটিক ক্রীম বোরোলিন’ – অনেক বিখ্যাত গানের কলির মতো এও তখন আমাদের ঠোঁটে লেগে থাকতো আর সঙ্গে অসাধারন সব নাটক। তার আগে নাটক বলতে কলকাতা-ক এর শনিবার আর রবিবার দুপুর দেড়টা সম্ভবত। শ্রাবন্তী মজুমদারের আর এক অবিস্মরণীয় অনুষ্ঠান ছিলো শনিবার দুপুরে…’ওয়েসিস মনের মতো গান, মনে রাখা কথা’। এখনো ‘দিদিভাই’ বলে কাউকে ডাকতে শুনলে শ্রাবন্তী মজুমদারের কথাই সবার আগে মনে পড়ে। এছাড়াও ছিলো বুধবার রাতে ‘গজকুমার রঙ্গসভা’। সেইসব রেডিওর স্বর্ণযুগ।
তারপর কবে যেন সেই রেডিও খারাপ হয়ে গেলো, বাড়িতে এলো ‘মারফি’-র ট্রানজিস্টর। রেডিও-ট্রানজিস্টরের কফিনে শেষ পেরেক পুঁতে দিলো টেলিভিশন আর মোবাইল ফোন। এখনও এফ.এম. রেডিও রয়েছে রেডিওর পরম্পরা কে টিকিয়ে রাখতে, কিন্তু সেই জৌলুশ বোধহয় আর নেই। তাই এখনো মহালয়া এলে মহিষাসুরমর্দিনীর মতোই রেডিও নামটাও আমার মনে এক অনন্য নস্টালজিয়া বয়ে নিয়ে আসে যাকে আমি আজও সযত্নে বুকের এক কোনে লালন করে চলেছি…
আর আমি নিশ্চিত আমার মতো আরো অনেকের-ই বুকের কোনে উঁকি মারলে রেডিও-র প্রেমে যে ঘা, তার হাল্কা দাগ দেখতে পাওয়া যাবে।
WhatsApp এ নিউজ পেতে জয়েন করুন আমাদের WhatsApp গ্রুপে
আপনার মতামত বা নিউজ পাঠান এই নম্বরে : +91 94745 60584