নিজস্ব প্রতিবেদন,মুর্শিদাবাদঃ
মুর্শিদাবাদ পিছিয়ে পড়া জেলা। শুধু পশ্চিমবঙ্গে নয়, গোটা ভারতের পিছিয়ে পরা জেলাগুলির অন্যতম। অথচ, মুর্শিদাবাদ নাম শুনলেই প্রথমে যা চোখের সামনে আসে নবাব সিরাজের বণিকদের জন্য দেশ হিতের জন্য পলাশীর প্রান্তরের লড়াই, বিশ্বসঘাতকতায় লুটিয়ে পরা স্বাধীনতা। এই স্মরণগ্রন্থী পেরিয়ে অনেকে মুর্শিদাবাদের কথা ভাবতে গিয়ে নবাবী ইমারতগুলির পাশাপাশি জলছবির মতো মনে এঁকে নেন আমের বাগান। সাধারণ, অসাধারণ আমের প্রজাতি যা যুগ যুগ ধরে না জানি কত মানুষের রসনাকে তৃপ্ত করে চলেছে, যা এই মুর্শিদাবাদের মাটির অবদান। যেখানে কৃষক, সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ নিজেদের পরিচর্চা আর শরীরের ঘাম ঝরিয়ে দেশের মানুষের জন্য পৌঁছে দিচ্ছে ফলের রাজা আমকে।
এ প্রসঙ্গে কোহিতুর আমের কথায় আসি,যাকে অনেকে জানেন এবং ভাবেন এক্সক্লুসিভ আম হিসাবে। কোহিতুর আমের ফলন এক পরিশ্রমী পদ্ধতির ফসল। নবাবী আমল থেকেই কোহিতুরের উপস্থিতি রয়েছে এই অঞ্চলে। নবাবী আদবকায়দায় কোহিতুর আমকে সংরক্ষণ করতে হয়। কোহিতুরের খোঁজ করতে গিয়ে নিউজ ফ্রন্টের দল এসে পৌঁছালো রইস মির্জার আমবাগানে যা বর্তমানে কৃষ্ণনগরের চার্চের মালিকানায় রয়েছে। এখানে এসে পরিচয় হলো আলী হাসানের সাথে।
আলী দা একজন আপাত স্থায়ী কর্মচারী এই বাগানের। তার কাছেই শুনলাম কোহিতুরকে গাছ থেকে পারার পর তুলোর মধ্যে রাখতে হয় প্রায় এক সপ্তাহ। শুধু রাখলেই হবে না, প্রতি বারো ঘন্টা অন্তর আমের অবস্থার পরিবর্তন করার জন্য উল্টানো হয়। কোনো একভাবে দীর্ঘদিন ধরে একে রাখা উচিত নয়। “আমকে খাবার আগে কোনোভাবেই চাপ দেয়া যাবে না”- জানালো আলী দা।
প্রশ্ন করলাম তুলোর মধ্যে রাখার প্রয়োজন কি? আলী দা উত্তরে জানালো “কোহিতুর আম থেকে যে আঠা বেরোয় সেটিকে ধরে রাখা দরকার সঠিক স্বাদের জন্য”। এত শ্রম দিয়ে সংরক্ষণ করা আমের চাহিদা নিশ্চয় অনেক? প্রশ্ন শুনে আর এক অস্থায়ী কর্মচারী নজরুল মালিক আমাদের বললেন, “কোথায় চাহিদা? এ তো বাগান থেকেই পচে যায়, বা আসে পাশ থেকে আসা গ্রামবাসীরা কাঁচা কোহিতুর নিয়ে যায়”।
মুর্শিবাদের আমের চাহিদা গোটা বিশ্ব জুড়ে কিন্তু নবাবী আমলের এইসব গাছের সংরক্ষণ বা এর সাথে যুক্ত কর্মচারীদের অর্থনৈতিক পরিস্হিতির হাল হকিকত শহুরে মানুষদের লজ্জা দেবে। রইস মির্জার বাগানের আয়তন প্রায় ৬০০ বিঘে। যার মধ্যে প্রায় একশো খানেক আমের প্রজাতি রয়েছে। অধিকাংশের নামই কর্মচারীদের জানা নেই। যেগুলি জানেন তার মধ্যে রয়েছে কোহিতুর, কোহিনুর, গোলাপখাস, সাদুল্লাহ (হিমসাগর), ল্যাংড়া, চিনিচম্পা, রানী, ইনাদ পশিন, নবাব পসন্দ প্রভৃতি। অধিকাংশ আমই নবাবী আমলে বিভিন্ন শঙ্কর আমের প্রজাতি।
এত বিভিন্নতা আমের থাকলেও সরকার বা প্রশাসনের তরফ থেকে কোনো সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেই।আম বাগানের কর্মচারীরা অধিকাংশই দৈনিক মজুরিতে এইসব বাগান গুলোতে কাজ করেন, ফলে স্থায়ী পরিচর্চা পায় না গাছগুলি। স্থায়ী কর্মচারীরা মাসে তিন থেকে চার হাজার টাকা বেতন পান। ফলনের সময় চলে গেলে কেউ ইটভাঁটা, অন্যের জমিতে চাষ করেন। বাজারে আড়ৎদার জানালো এখানক থেকে আম উত্তর ও উত্তর পূর্ব ভারতে রপ্তানি হয়। আমের ব্যবসায় চাষীরা এবছর ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন। প্রথমের দিকে দাম কিছুটা থাকলেও কিছু সময় পরেই দাম পড়ে যায়। বাগানে কর্মচারীরা জানান এবছর এক বিশেষ ধরণের পোকা বেশ কিছু আমের গাছকে ক্ষতিগ্রস্থ করেছে, এ ছাড়া হঠাৎ কালবৈশাখী বা বৃষ্টির জন্য প্রচুর মুকুল ঝরে যায়। এর ওপর রয়েছে অসমতাপূর্ণ বাজার, যার ফলে প্রায় সব ধরণের চাষিরাই জীবনের অধিকাংশ সময় কৃষিজাত উৎপাদনে লাভের মুখ দেখতে পান না, আম বাগানের চাষীরাও এর বাইরে নন।
দুই ছেলে মেয়ে এবং স্ত্রী কে নিয়ে অলিদার সংসার মাত্র চার হাজার টাকায় চালানো বেশ কষ্টকর হয়ে পড়ে।
“তবু এখানে কাজ করেন কেন?”
প্রশ্ন শুনে অলিদার প্রসন্ন জবাব “বাড়ির জন্যে আম নিয়ে যেতে পারি, বাচ্চারা খুব মজা করে খায়”।
মুর্শিদাবাদ তার সুমিষ্ট আমের জন্য রসনা পিপাসি মানুষদের আকৃষ্ট করে বহুদিন ধরেই, কিন্তু সে রসনা যারা বাজার অবধি পৌঁছে দিচ্ছে তারা ‘নুন আনতে পান্তা ফুরায়’ যাপনের মধ্যে প্রতিদিন বাঁচেন। সরকার উন্নয়নে ব্যস্ত।
WhatsApp এ নিউজ পেতে জয়েন করুন আমাদের WhatsApp গ্রুপে
আপনার মতামত বা নিউজ পাঠান এই নম্বরে : +91 94745 60584