
চিরন্তন ভারতের চরিত্র বদলের যে কর্মসূচি নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় এসেই নিয়েছিলেন তাঁর সতীর্থরা তার পরিপূর্ণতা দিলেন হরিয়াণাতে ট্রেনের ভিতরে কিশোর ছাত্র জুনেইদকে নৃশংস ভাবে খুন করে।বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যের চিরন্তন ভারতকে এক গণসন্ত্রাসের ভারতে পরিণত করবার বর্বরোচিত প্রক্রিয়া মোদি ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকেই শুরু হয়েছিল।সেই নারকীয় প্রবণতার বিভৎস প্রয়োগ দেখা গেল পবিত্র ঈদের দুদিন আগে হরিয়ানার একটি লোকাল ট্রেনের কামরার ভিতরে।
একই পরিবারের তিন ভাই ফিরছিল দিল্লি থেকে ঈদের বাজার সেরে গাঁয়ের বাড়ি হরিয়ানার খাটোলিতে।শাকির, হাসিম ও জুনেইদ এই তিন ভাই একটি নিম্নবিত্ত মুসলমান পরিবারের ছেলে। সামান্য কিছু সম্বল জুটিয়ে গিয়েছিল দেশের রাজধানীতে খুশির ঈদের বাজার করতে।তিন ভাইয়ের ই তাড়া ছিল ঘরে ফেরার। কারণ, অপেক্ষা করছেন মা। ছেলেরা ঈদের বাজার সেরে ঘরে ফিরলে রোজা ভাঙবেন বলে প্রতীক্ষায় ছিলেন জননী। ফিরলো ছেলে জুনেইদের লাশ। আর দুই ছেলে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে দিল্লির এইমসে।
রাষ্ট্রযন্ত্র এই ঘটনাকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টার ত্রুটি করে নি। আবার এই ঘটনা তাঁদের ” আচ্ছে দিনে” র শীবাকীর্তনের তাল কেটে দিতে পারে বলে তাকে ধামা চাপা দেওয়ার চেষ্টাও কম করে নি।হরিয়ানার বিজেপি সরকারের পুলিশ ঘটনা ঘটবার পর ই তড়িৎ গতিতে বলে দিয়েছিল যে; বিষয়টির ভিতরে সাম্প্রদায়িক গন্ধ কিছু নেই, একেবারেই ট্রেনের সিট দখল কে ঘিরে মামুলি ঝগড়া।প্রশ্ন হলো, ট্রেনে বসবার সিট নিয়ে গোলমালের সঙ্গে ধর্ম পরিচয়ের সম্পর্ক টা কি?ট্রেনের সিট নিয়ে সহযাত্রীর সঙ্গে গোলমাল হলে ছুরি চালানোর বিষয়টি কি কোনো সাধারণ ঘটনা?সাধারণ যাত্রীরা কি ছুরি নিয়ে ঘোরে ট্রেনে?
মোদি কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকেই দেশপ্রেম, সহিষ্ণুতা ইত্যাদি বিষয়কে কেন্দ্র করে গোটা দেশ কে হিন্দু – মুসলমানে আড়াআড়ি করে বিভক্ত করবার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গিয়েছিল।গোলওয়ালকরের ” সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ” এর প্রতিষ্ঠার লক্ষে সংখ্যালঘু মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষদের উপর আর্থ – সামাজিক নির্যাতন বল্গাহীন হয়ে উঠতে শুরু করেছিল। একই প্রান্তিক অবস্থাতে নিয়ে আসা হয়েছিল দলিত সম্প্রদায়ের মানুষদেরও। বস্তুত আর এস এসের নাগপুরস্থ সদর দপ্তর যাদের “হিন্দু ” বলে দেগে দিচ্ছে তারা ছাড়া এদেশের প্রত্যেকটি মানুষকেই দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পর্যবসিত করবার একটা ফ্যাসিস্ট সুলভ মানসিকতা গত তিন বছর ধরে দাদরির শেখ আখলাখ থেকে শুরু করে কালবুর্গী, গোবিন্দ পানসারে হয়ে রোহিত ভেমুলাতে পরিণতি পেয়েছিল।কৈরানাতে মুসলমানদের উপর আর্থ- সামাজিক অত্যাচার জানান দিচ্ছিল কোন গণসন্ত্রাসের দিকে প্রবাহমাণ ভারতবর্ষকে ঠেলে দিতে চলেছে অসভ্য বর্বর আর এস এস এবং তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি।এক ই কথা প্রযোজ্য খোদ প্রধানমন্ত্রী মোদির নিজের রাজ্য গুজরাটের ” উনা” তে হিন্দু সন্ত্রাসীদের হাতে দলিতদের উপর ভয়াবহ সন্ত্রাস সম্পর্কে।
দিল্লি থেকে হরিয়ানার গাঁয়ে নিজেদের বাড়ি ফেরার পথে দিল্লি – মথুরা লোকাল ট্রেনে জুনেইদরা গোরুর মাংস খাচ্ছে বলে তাদের উপর উন্মত্ত রাজনৈতিক হিন্দুদের সশস্ত্র হামলার পর গোটা দেশব্যাপী তীব্র ধিক্কার উঠলেও হিন্দু সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শিবির কিন্তু এই বর্বরতা সম্পর্কে সম্পুর্ণ নীরবতা অবলম্বন করে চলেছে।খুশির উৎসব ঈদ খোদ কলকাতাতে পর্যন্ত এই গণসন্ত্রাসের আবহাওয়াতে ম্রিয়মান ভাবে পালিত হয়েছে।হিন্দু সাম্প্রদায়িকদের তাঁবেদারি করবার জন্যে যারা বলতে শুরু করেছিলেন যে; তিন তালাক নিয়ে বিজেপির বলিষ্ঠ অবস্থানের জেরে উত্তরপ্রদেশের মুসলমান সমাজের মহিলারা দুহাত ভ’রে সে রাজ্যের সদ্য সমাপ্ত বিধানসভার ভোটে বিধানসভার ভোটে ভোট দিয়েছে, তাদের উদ্দেশ্যে চপেটাঘাত স্বরূপ খবরের কাগজে একটি খবর বেরিয়েছে যে, সে রাজ্যের মুসলমানদের একটা বড়ো অংশ কেবলমাত্র প্রাণটুকু বাঁচাতে ফেজ টুপি পড়া ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। মন্তব্য নিষ্প্রোজন।
জুনেইদের ঘটনার পরেও গণসন্ত্রাসের ভূগোল করে বর্বর হিন্দুত্ববাদীরা কিভাবে গোটা দেশে ছড়িয়ে দিচ্ছে তার নগ্ন উদাহরণ হলো ঝাড়খন্ডের গিরিডি জেলার দেওরি থানা এলাকার বেরিয়া- হাতিটাঁড় গ্রামে গোহত্যার জিগির তুলে গোটা গ্রামের মুসলমানদের উপর নারকীয় হামলার ভিতর দিয়ে।গিরিডি শহর থেকে বেশ খানিকটা দূরে গ্রামের লাগোয়া একটি মৃতগরুকে মুসলমানেরা খুন করেছে — এই হুজুগ তুলে স্থানীয় মহম্মদ উসমান আনসারির বাড়িতে শখানেক উন্মত্ত রাজনৈতিক হিন্দু হামলা করে।উসমানের পরিবারের লোকেদের বেধড়ক মারধর করে সেই উন্মত্ত হিন্দুত্ববাদীরা।উসমানের অপরাধ, সে দুধ এবং দুগ্ধজাত সামগ্রীর ব্যবসা করে। তাই রটিয়ে দেওয়া হয় ওই মৃত গরুকে খাওয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে সে হত্যা করেছে।উসমানের বাড়ি আগুণে একদম ভস্মীভূত করে দেয় রাজনৈতিক হিন্দু দস্যুরা ।দাদরি,নগাঁও, দিল্লি – মথুরা লোকাল ট্রেন, আলওয়ার, বল্লভগড়ের পর গিরিডি দিয়ে গণসন্ত্রাসের পরিবেশকে গোটা ভারতে সেঁটে দেওয়ার ” বীর” বিক্রমে এগোচ্ছে অসভ্য বর্বর হিন্দুত্ববাদীরা।।
-গৌতম রায়, বিশিষ্ট লেখক ও অধ্যাপক।
WhatsApp এ নিউজ পেতে জয়েন করুন আমাদের WhatsApp গ্রুপে
আপনার মতামত বা নিউজ পাঠান এই নম্বরে : +91 94745 60584