বাবরী মসজিদ ধংসের ২৫ বছরে সাম্প্রদায়িকতা ও ফ্যাসিবাদ বিরোধী মিছিল ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান:-
সুমিত ঘোষ
২৫ বছর আগে, নয়াউদারবাদের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের সূচনা সম্মেলন হিসেবে উগ্রহিন্দুত্ববাদীরা নিজেদের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষায় ধ্বংস করেছিল বাবরী মসজিদ। এই নয়াউদারবাদী বিশ্বায়নের সার কথা হল মুষ্টিমেয় অভিজাত শ্রেণীর জন্য বিলাস-বাহুল্য আর সিংহভাগ মানুষের জন্য ‘কৃচ্ছসাধন’।
ফলে আজ হিন্দু ধর্মের ‘কৃচ্ছসাধন’-এর বাণী শক্তি যোগাচ্ছে মোদী সরকারের নোট বাতিল, জি এস টি, বাধ্যতামূলক আধার, বিফ ব্যান, অ্যান্টি রোমিও স্কোয়াড গঠন কিংবা খুচরো ব্যবসায় প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের মত পদক্ষেপগুলিকে। লিবারহান কমিশন বাবরী কাণ্ডে অটল বিহারী বাজপেয়ী, এল কে আদবানি, তৎকালীন ইউপি-র মুখ্যমন্ত্রী কল্যান সিং-এর সমালোচনা করার সাথে সাথে তৎকালীন আইবি-র জয়েন্ট ডিরেক্টর মলয় কৃষ্ণ ধর এবং প্রধানমন্ত্রী নরসিমা রাও ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এস বি চবন-কেও দায়ী করেন। ফলে একথা আজ স্পষ্ট যে বাবরী মসজিদ ধ্বংস ছিল এদেশে নয়াউদারবাদের উদ্বোধনী ধামাকা। বর্তমানে আদবানি, মুরলি মনোহর যোশী, উমা ভারতীদের ওপর বাবরী কাণ্ডে অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের অভিযোগ সুপ্রিম কোর্টে পুনর্বহাল থাকাকালীনই মোহন ভাগবত, সুরেন্দ্র জৈনরা খোলাখুলি হুঁশিয়ারি দিচ্ছে আগামী বছরই অযোধ্যায় রাম মন্দির নির্মাণের কাজ শুরু হবে এবং সেখানেই বসবে ধর্ম মহাসভা।
বিশ্বজোড়া গভীর অর্থনৈতিক সংকটের এই পরিস্থিতিতে বুর্জোয়া নিয়ম-কানুনগুলো মেনে যখন দেশ চালানো সম্ভব হচ্ছে না তখন ফ্যাসিবাদী কায়দায় মুসলমান সম্প্রদায়কে শারীরিক, মানসিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক নিপীড়নের মাধ্যমে শূলে চড়িয়ে আসলে দেশের সাধারণ মানুষের মগজে আঘাত হানছে রামের বানর সেনা। নয়াউদারবাদ গভীর সংকটে নিমজ্জিত হতেই আবার মাথা চাঁড়া দিয়ে উঠছে “মন্দির ওয়হি বানায়েঙ্গে” কলরব।
একদা গোধরা গণহত্যার পরপরই ‘বিজেপি আর অচ্ছুত নয়’ বলে এন ডি এ-তে শামিল হওয়া মমতা আজ দাঙ্গা বিরোধী গাল পাড়লেও পশ্চিমবঙ্গের শেষ ৫ বছরের প্রতিটি দাঙ্গায় তার দলের যোগ সুস্পষ্ট। নীতিশ কুমারের মত ‘গদ্দার’ এবং কংগ্রেসের সঙ্গে জোট বেঁধে পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট ও উত্তর প্রদেশে অখিলেশদের নির্বাচনী পরাজয় যখন বি জে পি বিরোধী মহাজোটকে প্রশ্নের মুখে ফেলছে, তখন বৃহত্তর বাম ঐক্যের পরিচায়ক হিসেবে বিভিন্ন বামপন্থী সংগঠনের ডাকে সাম্প্রদায়িকতা ও ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলন ‘অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো’।
৬ই ডিসেম্বর, ২০১৭… বাবরী মসজিদ ধংসের মত নারকীয় ঘটনার ২৫ বছরপূর্তি উপলক্ষ্যে সাম্প্রদায়িকতা ও ফ্যাসিবাদ বিরোধী মিছিল সংগঠিত হয় শিয়ালদহ স্টেশন বিগবাজার চত্বর থেকে বাগবাজার বাটা পর্যন্ত। বিধান সরণীর আর এস এস দপ্তরের কাছে মুষ্টিমেয় গেরুয়া সমর্থকরা জড় হলেও মিছিলের বহর দেখে তারা গোলমাল করার সাহস দেখায়নি। পিপ্ল্স্ ব্রিগেড, হকার সংগ্রাম সমিতি, অসংগঠিত ক্ষেত্র শ্রমিক সংগ্রামী মঞ্চ সহ মোট ২০টি বামপন্থী সংগঠনের এই মিছিলে অংশগ্রহণ মুখরিত করে তোলে কলকাতার রাজপথ-‘আম্বানির সরকার আর নেই দরকার’, ‘রোটি কাপড়া অউর মকান, মাঙ্গ রহা হ্যায় মজদুর কিষাণ’, ‘হাম মেহনত কি কিমাত মাঙ্গা হ্যায়, দাঙ্গা বড়া মেহঙ্গা হ্যায়’…।
মিছিল শেষে বাগবাজার বাটা চত্বরে সাম্প্রদায়িকতা ও ফ্যাসিবাদ বিরোধী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। ‘আমি শুনেছি সেদিন নাকি, তুমি তুমি তুমি মিলে, তোমরা সদলবলে সভা করেছিলে’… মৌসুমি ভৌমিক, পারভীন সুলতানা, নবকুমার রায়, কল্যান সেন বরাট, নীতিশ রায়, অমিত কালি, বিমল দে, নীলিম গঙ্গোপাধ্যায়, শ্যামসুন্দর দাস বাউলদের মত শিল্পীর প্রতিবাদের হাতিয়ার হয়ে ওঠে সঙ্গীত। সুদেষ্ণা দত্তগুপ্তের নৃত্যানুষ্ঠানের মাধ্যমে ‘সম্প্রীতি’ পরিবেশন ছাড়াও ‘পিপ্ল্স্ ব্রিগেড কালচারাল ইউনিট’-এর পক্ষ থেকে সমরেশ বসুর বিখ্যাত নাটক ‘আদাব’ মঞ্চস্থ হয়, যা আকৃষ্ট করে পথ চলতি সাধারণ মানুষকে। কান্ডীরের পক্ষ থেকে মঞ্চস্থ হয় ‘আবার খেলা শুরু’। বিভিন্ন সংগঠনের ফ্যাসিবাদ বিরোধী রাজনৈতিক বক্তব্যের মাঝে এই কৃষ্টি সন্ধান দিল প্রকৃত বিকল্পের- ‘নয়াউদারবাদ ও ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সকল শোষিত ও নিপীড়িত মানুষের জনজোট গড়ে তুলুন’।
(লেখক:-সুমিত ঘোষ ‘পিপ্ল্স্ ব্রিগেড’ সংগঠনের সদস্য)
WhatsApp এ নিউজ পেতে জয়েন করুন আমাদের WhatsApp গ্রুপে
আপনার মতামত বা নিউজ পাঠান এই নম্বরে : +91 94745 60584