শরীয়তুল্লাহ সোহন, ওয়েব ডেস্কঃ
শিক্ষায় জাতির মেরুদন্ড। শিক্ষায় জাগিয়ে তুলে একটি সুপ্ত, অনগ্রসর, পিছিয়ে পড়া জাতিকে। সঠিক মূল্যায়ন ভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে দিয়ে সম্ভব একটি আদর্শ সমাজ বা সার্বিকভাবে একটি আদর্শ রাষ্ট্র গঠন করা। আর এই শিক্ষা অর্জনের প্রধান মাধ্যম বিদ্যালয়। বিদ্যালয়ের আদর্শ পরিবেশে যোগ্য শিক্ষকদের তত্ত্বাবধানে প্রতিটি শিশু পুঁথিগত শিক্ষার পাশাপাশি সঠিক মূল্যবোধের শিক্ষা গ্রহণ করে। তাই প্রতিটি বিদ্যালয় প্রতিটি শিক্ষার্থীদের কাছে পরম শ্রদ্ধার ও ভালোবাসার। প্রতিটি ছাত্রছাত্রীদের কাছে বিদ্যালয় একটি দারুণ আনন্দের জায়গা। কিন্তু আজ যে ছাত্রছাত্রীদের কাহিনী শোনাচ্ছি, তাদের কাছে বিদ্যালয় ছিল মরুভূমির মরীচিকার মতো বিভীষিকাময় ভয়ংকর জায়গা। আর এই রকম ভয়ংকর বিদ্যালয়ের বর্ণনা দিয়েছেন ৬২ বছর বয়সী ব্যারি কেনেডি নামের এক কানাডিয়ান আদিবাসী ছাত্রী। যাকে শৈশবে জোরপূর্বক ওই বিদ্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। অভিভাবকদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে প্রতিটি আদিবাসী শিশুদের ওই সব বিদ্যালয়ে নিয়ে যেত ততকালীন প্রশাসন। এমনই সব ভয়ংকর তথ্য প্রকাশ করেছেন আল-জাজিরার একটি প্রতিবেদন।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ১৮৩১ সাল নাগাদ কানাডায় ১৩৯ টি আবাসিক স্কুল চালু করা হয়। কানাডার আদিবাসীদের সংস্কৃতি, ভাষা, পারিবারিক ও সাম্প্রদায়িক বন্ধন মুছে ফেলে তাদের আধুনিক সমাজের অংশ হিসেবে তুলে ধরার লক্ষ্যে এই স্কুল গুলো চালু করা হয়। এই স্কুলগুলোতে প্রায় দেড় লক্ষ আদিবাসী শিশু পড়াশোনা করেছে। এই সমস্ত আদিবাসী শিক্ষার্থীদের তাদের সংস্কৃতি থেকে ফিরিয়ে আধুনিক সংস্কৃতির অংশ হিসেবে তুলে ধরতে গিয়ে তাদের উপর বহু নৃশংসভাবে অত্যাচার করা হয়েছে। বহু বিতর্কের মধ্যে ধীরে ধীরে স্কুল গুলো বন্ধ হয়ে যায়। সবশেষে ১৯৯৬ সালে শেষ বিদ্যালয়টি বন্ধ করে দেয় কানাডিয়ান সরকার।
এই সমস্ত বিদ্যালয়ের ভয়াবহতা জানাতে গিয়ে ব্যারি কেনেডি বলেন, তাঁর বয়স যখন আট বছর তখন তাঁর চোখের সামনে একজন শিক্ষার্থীকে সমাধিস্থ করা হয়। তাঁকেও একাজে সহায়তা প্রদানে বাধ্য করা হয়েছিল। এভাবে তাঁকে মাত্র ৮ বছর বয়সে এমন ভয়াবহ কাজে বাধ্য করেছিল। এ তো গেল মৃত্যুর প্রসঙ্গ, তিনি আরও জানিয়েছেন, রাতের বেলায় তাদের পাহারা দেওয়ার জন্য নৈশ প্রহরীদের নিয়োগ করা হতো। তারা প্রতি রাতে তাদের ওপর যৌন নির্যাতন চালাতো। শুধু ব্যারি কেনেডি নয় তাঁর বোনের সাথে এমন ঘটনা ঘটেছিল।
ব্যারি কেনডিদের কিভাবে স্কুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, এ ব্যাপারে বলতে গিয়ে তিনি জানান, “তিনি ও তাঁর সাত ভাইবোন একসাথে তাঁদের বাবা-মায়ের সাথে থাকতেন। একদিন দরজার দিকে তাকিয়ে দেখেন কয়েকজন ব্যক্তি তাঁদের বাড়ি অভিমুখে আসছেন। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন, কানাডিয়ান সরকারের প্রতিনিধি, একজন ছিলেন ধর্মযাজক ও একজন ছিলেন বিদ্যালয়ের প্রতিনিধি। তাদের বাবা-মায়ের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাঁকে এবং তিন বোনকে জোরপূর্বক তারা তুলে নিয়ে যায়। কেনেডির বাবা-মা কোনভাবেই ওইসব স্কুলে পাঠানোর পক্ষপাতী ছিলেন না। কারণ তারা জানতো ঐ সব স্কুলে কিভাবে শিক্ষা দানের নামে নির্যাতন করা হয়। কিন্তু তাদের কোন উপায় ছিলনা। কারণ, বাবা-মা যদি তাদের সন্তানদের পাঠাতে অসম্মতি জানাতো, তাহলে বাবা-মায়েদের তুলে নিয়ে গিয়ে জেলে নির্যাতন চালাতো।
কেনেডি আরও জানিয়েছেন, তাঁকে প্রথমে ওই স্কুলে নিয়ে যাওয়ার পর গির্জার মতো একটি ভবনের সামনে গাড়ি দাঁড় করিয়ে, তাঁর তিন বোনকে ওই ভবনের মধ্যে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর কেনেডিকে নিয়ে যাওয়া হয় ছেলেদের আবাসিক ভবনে। কেনেডি ভয় পেয়ে পালানোর চেষ্টা করে কিন্তু প্রচেষ্টায় ব্যর্থ হন। এরপর শুরু কেনেডির ওপর নানা রকম নির্যাতন। প্রথমে মাথা থেকে পা পর্যন্ত কালো পোশাকে ঢাকা এক নারী তাকে অনাবৃত করে প্রচন্ড ঠান্ডা জলে স্নান করান। তারপর তাকে একটি তোশকে ঢেকে, কিছু কাপড় দিয়ে কক্ষে পাঠানো হয়। এই সমস্ত কক্ষেই চলত দিনের পর দিন যৌন নির্যাতন। কানাডার সাসকাচুয়ান প্রদেশের কু অ্যাপেল ভ্যালিতে মেরভাইল বিদ্যালয়ের এই ভয়ংকর পরিবেশে টানা ছয় বছর নানা নির্যাতনের মধ্য দিয়ে কাটান। ১১ বছর বয়সে মানসিকভাবে বিধ্বস্ত হয়ে বেরিয়ে আসেন তিনি । এর পর তাকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে বহু সংগ্রাম চালাতে হয়েছে। তাঁর মা এবং সৎ বাবার সহযোগিতায় আসতে আসতে সে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসেন। বর্তমানে তিনি নয় সন্তানের পিতা। ক্যারি দি কেটল ফার্স্ট নেশনের প্রধান হিসেবে দুবার দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি।
আরও পড়ুনঃ শেষকৃত্য সম্পন্ন করতে যাওয়ার পথে ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ গেল একই পরিবারের ১০ জনের
কেনেডির এই বিদ্যালয়ের নৃশংসতার আর একজন প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী হলেন ৭৯ বছর বয়সী উরসুলিন রেডউড। তিনি যে কক্ষে অবস্থান করতেন সেই কক্ষে তাঁর বয়সী তার এক চাচাতো বোনও থাকতো। তাদের বয়স তখন ছিল প্রায় ৯ বছর মতো। তিনি বলেন, প্রতিদিন এক সন্ন্যাসীর বিশেষ শব্দে তাদের ঘুম ভাঙতো। তবে একদিন দেখেন তাঁর চাচাতো বোন জোয়ানি সেই শব্দে উঠছে না। পরে সন্ন্যাসী তাঁকে দিয়ে উঠানোর চেষ্টা করা হয় কিন্তু দেখা যায় জোয়ানি মারা গেছে। পরে জানা যায় এমন ঘিঞ্জি পরিবেশে থাকার ফলে তাঁর যক্ষ্মা হয়ছিল যদিও স্কুল কর্তৃপক্ষ এব্যাপারে কোন খবর জানায়নি তাঁর দিদিকে। তাঁর বোনকে কোথায় সমাহিত করা হয়েছিল, এ ব্যাপারেও কোন কিছু জানতেন না তিনি।
আদিবাসীদের সভ্য করার নামে শিক্ষাঙ্গন তৈরি করে এমন নরকীয় ঘটনা ঘটানো হত, তা সম্প্রতি জানা গেছে। ওই সমস্ত স্কুলের ক্যাম্পাস গুলো খনন করে মিলেছে হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রীর মৃত দেহের কঙ্কাল। আল-জাজিরার প্রতিবেদন অনুযায়ী গত জুনে ঐ স্কুলে ৭৫১ টি খবর চিহ্নিত করা হয়েছে। ওই জায়গা পরিদর্শনে ব্যারি কেনডি যান এবং অতীতের ভয়ানক স্মৃতি মনে করে কান্নায় ভেঙে পড়েন। চলতি বছর মে মাসের শেষের দিকে ফার্স্ট নেশনের তথ্য অনুযায়ী ঐ স্কুলে প্রায় ২১৫ টি কঙ্কাল খুঁজে পাওয়া যায়। একটি তদন্তকারী সংস্থা জানিয়েছেন ঐ সমস্ত স্কুলের ক্যাম্পাসে প্রায় ৫-৬ হাজার ছাত্র-ছাত্রীর দেহ সমাহিত করা হয়েছে।
যে সমস্ত ছাত্র-ছাত্রী স্কুল ক্যাম্পাসে মারা গেছে বা সমাহিত করা আছে খুঁজে শনাক্ত করতে একটি টিআরসি নামে সংস্থা ১৫ হাজার মার্কিন ডলার দাবি করে। ২০০৯ সালে সংস্থাটি কানাডিয়ান সরকারের কাছে এই অর্থ মূল্যে দাবি করেন কিন্তু কানাডা সরকার তা দিতে অস্বীকৃতি জানায়। ফলে বাধ্য হয়ে আদিবাসীরা নিজে তহবিল সংগ্রহ করে সংস্থাটির হাতে তুলে দেয়। চলতি বছরের গোড়ার দিক থেকে তদন্ত শুরু করেছে সংস্থাটি।
WhatsApp এ নিউজ পেতে জয়েন করুন আমাদের WhatsApp গ্রুপে
আপনার মতামত বা নিউজ পাঠান এই নম্বরে : +91 94745 60584